প্রথম লড়াইটা জিতেছেন করবিন

পল ম্যাসন
পল ম্যাসন

জেরেমি করবিনকে ঠেকাতে ব্রিটিশ অভিজাতরা ব্রেক্সিট ফেলে দিতেও প্রস্তুত। এই যুক্তিতেই সব চালাকি করা হচ্ছে, মূলধারার রাজনীতিক ও সাংবাদিকেরা যে ভণ্ডামি ও দোষ স্বীকার করছেন, তার কারণও এটা। এই যুক্তির গভীরতা আছে। ব্রেক্সিট গণভোটের ফলাফল হিসেবে মার্গারেট থ্যাচারের নীতির দ্বিতীয় রূপ নাজিল হওয়ার কথা ছিল, যেখানে করপোরেট কর হার আয়ারল্যান্ডের সমান হবে।

কিন্তু কথা হচ্ছে, করবিন যদি প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে থ্যাচারবাদের নতুন কোনো রূপ আমরা দেখব না। সে কারণেই পিছুটান দেওয়ার এত প্রাণান্ত চেষ্টা। যাঁরা থেরেসা মের জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন, তাঁরা এখন উদারনৈতিক আপসের পারফিউমে সুবাসিত হচ্ছেন।

লেবার পার্টি খুবই সঠিকভাবে কার্ল মার্ক্সকে নির্বাচন থেকে দূরে রেখেছে। কিন্তু যা ঘটল, তা বোঝার জন্য একজন মার্ক্সবাদীর কাজ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি হচ্ছেন ইতালীয় কমিউনিস্ট নেতা আন্তোনিও গ্রামসি, ১৯৩৭ সালে ফ্যাসিবাদীদের কারাগারে যাঁর মৃত্যু হয়। ব্যাপারটা হচ্ছে, করবিনের উত্থান, নির্বাচনে লেবার পার্টির ভালো ফলাফল বা ভবিষ্যতে কী ঘটবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করাটা গ্রামসির জন্য কোনো ব্যাপার হতো না। কারণ, গ্রামসি জানতেন, পরিপক্ব গণতন্ত্রে বামপন্থীরা কী ধরনের লড়াই করছে এবং সেটা কীভাবে জেতা যায়।

গত ছয় সপ্তাহে ঘটনাপ্রবাহের যে অপ্রত্যাশিত মোড় পরিবর্তন হলো, সেগুলো বিবেচনা করুন। জরিপে লেবার পার্টির সমর্থন ছিল ২৫ শতাংশ, কিন্তু নির্বাচনে তারা ৪০ শতাংশ ভোট পায়। দলটির ইশতেহার ফাঁস হলে তাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, কিন্তু এতে করবিনের জনপ্রিয়তা সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায়। ব্রিটেনে সন্ত্রাসী হামলা হলো, যার পরিপ্রেক্ষিতে টোরি পার্টির জনপ্রিয়তা নিচে নেমে গেল।

এসব কিছুই হওয়ার কথা ছিল না। এর মধ্য দিয়ে রাজনীতির ‘সাধারণ জ্ঞান’ উপেক্ষা করা হলো। গ্রামসিই প্রথম এটা বুঝতে পারেন যে শ্রমিকশ্রেণি ও বামপন্থীদের লড়াইটা হচ্ছে এই সাধারণ জ্ঞানকে অমান্য করার। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই সর্বজনগ্রাহ্য সাধারণ বোধই অভিজাতদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখে, এমআইফাইভ, বিশেষ শাখা বা সেনাবাহিনীর জেনারেলরা নয়।

আপনি একবার এটা গ্রহণ করলে করবিনের অর্জনের মাত্রা বুঝতে শুরু করবেন। এমনকি না জিতলেও তিনি প্রকাশ্যে নব্য উদারনীতিবাদের যুক্তি ধ্বংস করে দিয়েছেন। তার সঙ্গে জাত্যভিমানী জাতীয়তাবাদী অর্থনীতিকে পিছুটান দিতেও বাধ্য করেছেন। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের কাছে ব্রেক্সিট অপ্রত্যাশিত উপহার ছিল। সবচেয়ে কোমলরূপেও এটি ১০ বছরের জন্য ব্রিটেনকে ব্যাহত করেছে। এর কারণে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হবে, তার সঙ্গে সুদের হার বেড়ে যাবে এবং অপরিমেয় অর্থ পাচার হবে। এটা সস্তা শ্রমের সরবরাহ ব্যাহত করবে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির বাজার হারানোর হুমকি আছে।

কিন্তু ব্রিটিশ শাসক অভিজাত ও ব্যবসায়ীরা একই সত্তা নয়। তাঁদের স্বার্থ ভিন্ন। ব্রিটিশ অভিজাতরা ব্যবসায়ীদের থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁরা হেজ ফান্ড পরিচালনাকারী বৈশ্বিক অভিজাত, সম্পত্তির ফাটকা কারবারি, তেল শেখ ও টাউট-বাটপারদের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই শেষোক্ত শ্রেণির স্বার্থে থেরেসা মে কানজারভেটিভ পার্টিকে উদার বিশ্ববাদী দল থেকে কট্টর ব্রেক্সিটপন্থীতে পরিণত করেছেন।

ব্রেক্সিটের কঠিন পথে চিরস্থায়ী সংকট সৃষ্টি হবে। তার সঙ্গে সৃষ্টি হবে চিরস্থায়ী কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি ও শত্রুর দল, অর্থাৎ ব্রাসেলস ও সামাজিক গণতন্ত্র। এই পরিস্থিতি আর্থিক খাতে সন্দেহ সৃষ্টির জন্য আদর্শ। করবিন শুধু লেবার ভোটারদের মধ্যে শক্তি সঞ্চার করেননি; তিনি সাবেক ইউকিপ ভোটার, গ্রিনস ও প্রথম ভোটারদের কাছে টানতে পেরেছেন। অন্যদিকে মধ্যপন্থী উদার সালারিয়াত কৌশলী হয়ে ভোট দিয়েছে।

গ্রামসি আমাদের শিখিয়েছেন, শাসকশ্রেণি রাষ্ট্র দিয়ে শাসন করে না। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্র হচ্ছে শেষ শক্তিশালী অবস্থান। তো অভিজাতদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে হলে রাষ্ট্রের সুরক্ষায় নির্মিত পরিখা একের পর এক দখল করতে হবে।

গত গ্রীষ্মে নেতৃত্বের দ্বিতীয় দফা প্রতিযোগিতার সময় এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে অভিজাত শক্তির সামনের সারির পরিখার অবস্থান লেবার পার্টির একদম মাঝখানে। দলটির ডানঘেঁষা অংশ স্নায়ুযুদ্ধের সময় এই পরিখা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। তারা যুক্তি দিল, অভিজাতরা কখনোই বিপ্লবী বাম নেতা ও কর্মসূচি নিয়ে দলকে চলতে দেবে না। ফলে তারা নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য তিক্ত লড়াই চালাল।

যে মুহূর্তে লেবার পার্টির ইশতেহার ফাঁস হলো এবং তার সমর্থন বেড়ে গেল, সেই মুহূর্তেই লেবার পার্টির ডানপন্থী অংশের পরাজয় হয়। সে কারণে তারা দ্বিতীয় পরিখায় চলে যায়, কিন্তু সেটাও ঠিকঠাক কাজ করেনি। এতে তারা জেতেনি, এরপর নেতা নির্বাচনে আরেকটি নির্বাচন হয়। তৃতীয় পরিখাটি ছিল ট্যাবলয়েড ও তার সম্প্রচার সহযোগীরা। এটাও অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ এমন একটি পার্টিকে ভোট দিয়েছেন, যাদের গায়ে এমন কালিমা লেপন করা হয়েছিল যে এরা ‘ব্রিটেনের শত্রুকে সমর্থন’ দিচ্ছে। এ ছাড়া তারা সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারে নমনীয়, যাদের হাতে ‘রক্ত লেগে আছে’।

গ্রামসি এর কারণটাও ঠিকঠাক বুঝতেন। গ্রামসি বলেছেন, প্রতিটি মানুষই বুদ্ধিজীবী। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৩০-এর দশকের সমাজতন্ত্রীদের তিনি বলেছেন, রাষ্ট্র নিয়ে আচ্ছন্ন না হয়ে শাসকশ্রেণির আদর্শের বিরুদ্ধে ধৈর্য ধরে দীর্ঘ পরিখা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।

তো এখন বামপন্থীদের পরবর্তী কাজটা হবে অহংকার ত্যাগ করা। তাদের এই ভ্রান্তি বাদ দিতে হবে যে একটা বজ্র আঘাতে ব্রিটিশ শাসক অভিজাত শ্রেণির প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদ করে বিপ্লবী বামদের ক্ষমতায় বসানো যাবে। প্রথম যে লক্ষ্যটা তারা অর্জন করতে পারে, তা হলো টোরিদের একক বাজারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জায়গায় ফেরত যেতে বাধ্য করা, যেটা ইউরোপীয় আদালতের অধীনে সম্পন্ন হবে। এরপর ব্রেক্সিট আলোচনার দিকনির্দেশনা প্রণয়নে আন্তপার্টি বন্দোবস্ত করতে হবে তাদের। কিন্তু তাদের কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি পরিত্যাগে বাধ্য করাই হবে প্রকৃত পুরস্কার।

এখন কনজারভেটিভরা যদি ব্রিটিশ ব্যবসা ও জনগণের স্বার্থ না দেখে বৈশ্বিক চোরদের সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে ডাউনিং স্ট্রিটে করবিনই আসবেন।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া।

পল ম্যাসন: ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক।