ভালো বনাম আজেবাজেট!

সের্জিও লেওনের ১৯৬৬ সালের মাস্টারপিস ওয়েস্টার্ন দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি সিনেমাটির প্রতি অর্থনীতিবিদদের অনেক ঋণ। অর্থনীতির যেকোনো বড় পদক্ষেপ বা বাজেটের ভালো-মন্দ বিশ্লেষণে অর্থনীতিবিদেরা যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছেন এই সিনেমার নামটি। বিশেষ করে বাজেটের ঠিক পরে সম্ভবত এমন কোনো দেশ পাওয়া যাবে না যেখানে বাজেটের ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’ নেই। নাম ব্যবহারের ওপর কোনো আবগারি শুল্ক বসানো হলে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে লাভবান হতেন সিনেমাটির প্রযোজকেরা।

যেকোনো বাজেটের ভালো বা মন্দ দুটোই থাকে। একই প্রস্তাব অনেকের জন্য ভালো হলেও অন্য কারও জন্য হয়তো মন্দ প্রভাব ফেলে। কিন্তু সমস্যা হলো, আজকাল অনেক বাজেটেই আগলি বা কুৎসিত কিছু প্রস্তাবও থাকে। সুতরাং শেষ বিচারে বাজেট খালি ভালো বা মন্দের মধ্যেই আটকে থাকে না।

বড় না ছোট—এ নিয়ে বাজেটের আলোচনা সম্ভবত আমরা ছাড়া আর কেউই করেন না। বাজেট কত বড় বা আকার কত—এই আলোচনা আজকের বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অবান্তর বলা চলে। পাশের দেশ ভারতের বাজেট বক্তৃতা পড়লেও কত টাকার বাজেট, তা সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। পরের দিনের পত্রিকায়ও সহজে পাওয়া যায় না এ পরিসংখ্যানটি। কারণ, বাজেট কত বড়, তাতে সাধারণ মানুষের তেমন কিছু যায়-আসে না। বরং বাজেটের প্রভাবটাই আসল। বড় বাজেট দেওয়ার ঘোষণার মধ্যে যতটা আছে রাজনীতি, ততটা নেই অর্থনীতি। বাজেটের ভালো বা মন্দ নির্ভর করে বাজেট সংখ্যায় নয়, বরং বাজেট বরাদ্দের নীতি ও অগ্রাধিকার এবং রাজস্ব প্রস্তাবে।

ভালো বাজেট

দীর্ঘ সময় ধরে শিল্পে সংরক্ষণ দেওয়া ভালো না খারাপ, সে বিতর্ক সব সময়ের। তারপরও নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী বেশ কিছু স্থানীয় শিল্পকে আরও বেশি সংরক্ষণ-সুবিধা দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রকৌশল খাত অন্যতম। এর ফলে এসব খাতে বিনিয়োগ বাড়ার কথা। এবার পোশাকশিল্পে করপোরেট হারও কমানো হয়েছে ৫ শতাংশ। এতে এখানে নতুন বিনিয়োগ আসার কথা। এ ছাড়া বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে। এ খাতে অবশ্যই বাংলাদেশের সম্ভাবনা বাড়ছে।

এবারের বাজেটে নতুন একটা দিকও দেখা গেল। বাজেটকাঠামো যেসব অনুমানের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয়েছে, তার একটি তালিকা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আমরা সবাই জানি, অর্থনীতির অনেক কিছুই অনুমানের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হয়। তবে অনুমান অবশ্যই বাস্তবতার কাছাকাছি হতে হয়। এই সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও অর্থমন্ত্রীর এই অনুমান অবশ্যই একটি ভালো দিক। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সব সময়ই বাজেটকে একটা মানবিক চেহারা দেয়। বাজেটকে খানিকটা মানবিক করতে অর্থমন্ত্রী এবারও পিছিয়ে থাকেননি।

মন্দ বাজেট

বাজেট বক্তৃতা বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ অংশের একটি। এদিক থেকে এই বাজেটকে মন্দ বলা যায়। ১৫০ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতা সম্ভবত বিশ্ব রেকর্ড। বাজেট বড় হোক, কিন্তু অহেতুক বাজেট বক্তৃতা বড় করার মধ্যে তেমন কোনো কৃতিত্ব নেই। বাজেটে এমন অনেক কথা আছে, তা না থাকলেও চলে। অনেক বাড়তি কথা বলা হয় বলেই বাজেটের আসল কথাটা থাকে না। কিংবা অনেক কথার ভিড়ে হারিয়ে যায়।

বাজেট দেওয়ার পর অনেকেই জানতে চান দাম বাড়া-কমার বাইরে তাঁদের জন্য কী কী আছে। কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় সুনির্দিষ্টভাবে এর কোনো উল্লেখ থাকে না। বাজেটে তরুণদের জন্য কী আছে, নারীদের জন্য কী আছে, শিক্ষার্থীদের জন্য কী আছে, সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য কী আছে, বিনিয়োগকারীদের জন্য কী আছে—এসব কোনো কুইজ প্রতিযোগিতার প্রশ্ন হতে পারে। সুতরাং যত দিন এ ধরনের বাজেট বক্তৃতার বড় ধরনের সংস্কার না হবে, তত দিন এটি অবশ্যই মন্দ বাজেট।

নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন চালু করায় সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। ধারণা ছিল ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা খানিকটা বাড়াবেন অর্থমন্ত্রী। আভাসও দিয়েছিলেন বাজেটের আগে। বিনিয়োগকে উৎসাহ দিতে করপোরেট কর কমানোর কথাও বলেছিলেন। কিন্তু বাজেটে পরিবর্তন হয়নি। এগুলো সবই মন্দ বাজেটের উদাহরণ। এই বাজেট সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির হবে না।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর বাজেটকে তাঁর শ্রেষ্ঠতম বাজেট বলেছেন। নয় বছর আগে শুরু করেছিলেন এক লাখ কোটি টাকার কম দিয়ে, আর এবার তা চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রীর গর্ব সম্ভবত এখানেই। কিন্তু যে বাজেটের ৩২ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় বেতন-ভাতা ও পেনশন খাতে, ১৭ শতাংশ সুদ পরিশোধে এবং সাহায্য ও মঞ্জুরি খাতে বরাদ্দ আরও ১৭ শতাংশ, সেই বাজেটের বিশালত্ব নিয়ে আলাদা করে গর্ব করার কিছু থাকে না। কেননা, অনুন্নয়ন খাতে বরাদ্দ দেওয়ার পর অর্থমন্ত্রীর হাতে থাকে খুব কম অর্থই। বিশাল এই অনুন্নয়ন বাজেটের কারণেই রাজস্ব আদায়ের চাপের মধ্যে থাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আর রাজস্ব আদায়ের বাড়তি চাপটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পড়ে সৎ ও নিয়মিত করদাতাদের ওপর।

কুৎসিত বাজেট

ব্যাংক আমানতের ওপর অর্থমন্ত্রী এবার আবগারি শুল্ক বাড়িয়েছেন। টাকাটা খুব বেশি না এটা ঠিক, আবার আবগারি শুল্ক আরোপও নতুন নয়। তবে এর মাধ্যমে সাধারণ সঞ্চয়ীদের কাছে যে সংকেতটা গেল, সেটাই খারাপ। সারা বিশ্ব যেখানে ব্যাংক ব্যবস্থায় সব ধরনের লেনদেন নিয়ে আসার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে, সেখানে উল্টো সংকেত দেওয়া হলো যে ব্যাংক ব্যবস্থায় অর্থ রাখা হলে সরকার নানা ছুতোয় কিছু টাকা কেটে নিতে পারে। তা ছাড়া সময়টাও আবগারি শুল্ক বাড়ানোর জন্য অনুকূল ছিল না। আমানতের সুদের হার এখন মূল্যস্ফীতির চেয়েও বেশি। অর্থাৎ প্রকৃত সুদের হার ঋণাত্মক। এর ফলে ব্যাংকে টাকা রাখলে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি। এ সময়ে যত সামান্যই হোক, টাকা কেটে রাখলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবেই।

সমস্যা আরও আছে। সাধারণ মানুষ আমানত রাখে ব্যাংকে। এই আমানত থেকেই উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয় ব্যাংকগুলো। কিন্তু এ ঋণের একটি বড় অংশই ফেরত আসে না। খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক বড় ধরনের মূলধন ঘাটতিতে পড়ে আছে। সরকারি এই ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে অর্থমন্ত্রী নতুন বাজেটে আরও দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন। বরাদ্দের এই অর্থ কিন্তু এসেছে সাধারণ মানুষের করের টাকা থেকেই। বাজেটে এর চেয়ে খারাপ দিক আর কী হতে পারে।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন শিরোনামে পুরো একটি অধ্যায় রেখেছেন। এটি ভালো বাজেট অংশে যেতে পারত। এই অধ্যায়ের নয়টি পৃষ্ঠা পড়ার পর সেই ভাবনা আর থাকল না। সুশাসনের সমস্যা বাংলাদেশে প্রকট। কিন্তু তার কোনো প্রতিফলন পাওয়া গেল না এই অধ্যায়ে। খেলাপি ঋণ, দুর্নীতি, টাকা পাচার—এসব নিয়ে বাজেটে তেমন কোনো কথাবার্তাই নেই। বাজেট পড়ে মনে হবে না এসব বাংলাদেশের আদৌ কোনো সমস্যা। বক্তৃতায় এই নয় পৃষ্ঠা না থাকলেও তেমন কোনো সমস্যা হতো না।

অবশ্য সরকার যে সুশাসনের ঘাটতি নিয়ে খুব চিন্তিত, তারও কোনো প্রমাণ নেই। বরং এসব হয়েই থাকে—এ রকম একটা ভাবনা অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। বাজেটের পরদিন আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল ব্যাংক খাতের দুর্নীতি ও আত্মসাৎ নিয়ে। অর্থমন্ত্রীর জবাব ছিল, সব দেশেই এ রকম হয়ে থাকে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছিলেন, সরকারি ব্যাংক সরকারের হয়ে অনেক কাজ করে। সুতরাং এদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সরকার ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখুক, আপত্তি নেই। সমস্যা হচ্ছে এ জন্য অর্থ দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেই। দুর্নীতির পুরস্কার সম্ভবত আমাদের দেশেই দেওয়া হয় সবচেয়ে বেশি। এসব কারণেই বাজেট শেষ পর্যন্ত ভালো-মন্দের মধ্যে না থেকে আরও খারাপ কিছু হয়ে যায়।

পাদটীকা

জনপ্রিয় ব্রিটিশ লেখক জেফরি আর্চার পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন। কনজারভেটিভ পার্টির ডেপুটি চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তাঁর একাধিক বই বেস্টসেলারের তালিকায় ছিল। তার ‘ক্লিন সুইপ ইগনেশিয়াস’ গল্প দিয়েই লেখাটা শেষ করছি।

ইগনেশিয়াস আগারবি নাইজেরিয়ার ১৭তম অর্থমন্ত্রী হওয়ার সময় কেউ খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু দ্রুতই তিনি সবার মনোযোগ কেড়ে নিলেন। ঘুষ, দুর্নীতি আর অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তাকে দুর্নীতির দায়ে জেলে পুরলেন, ঘুষ নেওয়ার দায়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক গ্রেপ্তার হলেন। খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল ইগনেশিয়াসের। দুর্নীতি ঝেঁটিয়ে বিদায় করছেন বলে নাম হয়ে গেল ‘ঝাড়ু ইগনেশিয়াস’। অর্থমন্ত্রীর সর্বশেষ বাজেট রিপোর্ট পড়ার পর একদিন ডেকে পাঠালেন রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল ওটোবি। সব ধরনের সমর্থনের আশ্বাসও দিলেন। আর উপহার দিলেন একটি পিস্তল, শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতে।

ইগনেশিয়াসের এবার লক্ষ্য সুইস ব্যাংকের টাকা পাচারকারীরা। একদিন চলেও গেলেন জেনেভায়। গারবার অ্যাট সিয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে একটা জীর্ণ ব্রিফকেস হাতে ইগনেশিয়াস হাজিরও হলেন সেখানে। দ্রুতই কাজের কথায় এলেন। চাইলেন তাঁর দেশের নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের সব তথ্য। এ জন্য রাষ্ট্রপ্রধানের দেওয়া অনুমোদনের চিঠিও দেখালেন। কিন্তু ব্যাংক চেয়ারম্যান তথ্য দিতে রাজি হলেন না। নাছোড়বান্দা ইগনেশিয়াস নানা ধরনের লোভ দেখালেন, ব্যবসা বাড়ানোর কথা বললেন। কিন্তু কাজ হলো না। মক্কেলের তথ্য কোনো অবস্থাতেই চেয়ারম্যান দিতে রাজি হলেন না। এরপর ইগনেশিয়াস ভয় দেখাতে শুরু করলেন। দেশের সঙ্গে সব ধরনের ব্যবসা বন্ধসহ সুইজারল্যান্ডের দূতাবাসে তালা দেওয়ার হুমকিও দিলেন। তাতেও কাজ হলো না। গোপনীয়তা রক্ষার নীতিতে অটল তিনি। এবার শেষ অস্ত্র ব্যবহার করলেন ইগনেশিয়াস। পকেট থেকে ছোট পিস্তলটা বের করে চেয়ারম্যানের কপালে চেপে ধরলেন। ভীষণ ভয় পেলেও সিদ্ধান্তে অনড় ব্যাংক চেয়ারম্যান।

গল্পের শেষটা এ রকম—‘দুর্দান্ত!’ চেয়ারম্যানের কপাল থেকে পিস্তল সরিয়ে নিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসতে বসতে বলেন ইগনেশিয়াস। জীর্ণ ব্রিফকেসটা তুলে নিলেন। ব্রিফকেসে এক শ ডলারের নোট থরে থরে সাজানো। পাঁচ মিলিয়ন ডলারের কম হবে না।

‘আমি ভাবছি,’ ইগনেশিয়াস বলেন, ‘আপনাদের ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্ট খুললে কেমন হয়।’

শওকত হোসেন: সাংবাদিক