ভ্যাট হার হোক ১২ শতাংশ

প্রস্তাবিত বাজেটে হঠাৎ করে ব্যাংকের আবগারি শুল্ক বাড়িয়ে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়ানো হলো। এ উপদেশ বা পরামর্শ যারাই দিয়ে থাকুক না কেন, অর্থমন্ত্রীর ভালো করে খেয়াল রাখা উচিত ছিল। আবগারি শুল্ক অর্থ হলো, কাঙ্ক্ষিত নয় এমন পণ্যের ওপর শুল্ক। নিরুৎসাহিত করা যায় এমন পণ্য। বলা যায়, আবগারি শুল্কের কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই, তার মানে এর কোনো আইনি ভিত্তিও নেই। ব্যাংকের আমানতকে আমরা উৎসাহিত করি, এ শুল্ক আমানত নিরুৎসাহিত করে। একটা উন্নয়নশীল দেশে এমন শুল্ক একেবারেই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। এটা সম্পূর্ণভাবে রহিত করা উচিত। এতে রাজস্ব আয়ের পরিমাণও সামান্য।

বর্তমানে ব্যাংকের সুদের হার মূল্যস্ফীতির চেয়েও কম। ফলে প্রকৃত সুদের হার নেতিবাচক হয়ে গেছে। আবগারি শুল্ক এখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা পুরোপুরি তুলে দিলে জনমনে স্বস্তি হবে, সরকারের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আছে। যে স্তরে যে পরিমাণ মূল্য সংযোজন হয়, তার ওপরই মূলত ভ্যাট যুক্ত হয়। কিন্তু ভ্যাট নিয়ে আমাদের দেশে ভুল-বোঝাবুঝি আছে। ২০০৯ সাল থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। আর ২০১২ সালে তা আইনই হয়ে গেল। এরপর আরও পাঁচ বছর গেল। এত দিনেও কেন আলাপ-আলোচনা করে বিষয়টি পরিষ্কার করা হলো না, এটা বিস্ময়কর ও বেদনাদায়ক। এত দিন মনে হয়েছিল অনলাইন ভ্যাট সর্বজনীন হয়েছে। সংসদের আলোচনা দেখে মনে হচ্ছে, কোনোটাই ঠিক নয়। ভ্যাট আইনটাই এখনো স্বীকৃতি পায়নি, হার তো পরে। আবার রাজস্ব আদায় করতে না পারলে উন্নয়ন কীভাবে হবে, খরচ কীভাবে চলবে। এতে ঘাটতি তো অনেক বেড়ে যাবে।

আমার প্রস্তাব, এবার ১২ শতাংশ হার ঠিক করে ভ্যাট হার বাস্তবায়ন শুরু করা হোক। পাশাপাশি এবার করজাল বিস্তৃত করার উদ্যোগও নেওয়া যেতে পারে। তবে রাজস্ব কর্মকর্তাদের দ্বারা কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। জনগণের কষ্ট হলে পরের বছর এ হার কমিয়ে ফেলতে হবে। ভবিষ্যতে রাজস্ব আয় ভালো হলে হার কমানো যেতে পারে, আবার কম হলে বাড়াতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এ নিয়ে সরকার ও জনগণ যেন মুখোমুখি অবস্থানে না দাঁড়ায়।

সঞ্চয়পত্রের সুদ দিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠী দিন যাপন করছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা কারও কাছে হাত পেতে কিছু নিতে পারে না। এর বড় অংশই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী। তাই এর সুদের হার কোনোভাবেই কমানো ঠিক হবে না।

ব্যাংকের যারা ইটিআইএন (ইলেকট্রনিক কর শনাক্তকরণ নম্বর) দিয়ে হিসাব খুলছে, তাদের সুদ থেকে ১০ শতাংশ কাটা হচ্ছে। যারা ইটিআইএন দিচ্ছে না, তাদের সুদের ওপর কাটা হচ্ছে মাত্র ১৫ শতাংশ। অর্থসম্পদ লুকানোর উদ্দেশ্যে যারা ইটিআইএন দিচ্ছে না, তাদের সুদ আয়ের ওপর শতকরা ২৫ ভাগ আয়কর কেটে রাখার প্রস্তাব করছি। কারণ, গোপন করা টাকার অনেকটাই বিদেশে পাচার হয় বলে আমরা জেনেছি। আয়করের হার বাড়ালে অনেকে ইটিআইএন সংগ্রহ করবে, রাজস্ব অনেক বাড়বে। এতে আবগারি শুল্ক ও সঞ্চয়পত্রের সুদে যে টাকা খরচ হয়, তার শতগুণ উঠে আসবে। আমার আরও প্রস্তাব হচ্ছে, আয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে ৪ লাখ টাকা হলে ১০ শতাংশের স্থলে ৫ শতাংশ হারে আয়কর আরোপ করা যেতে পারে। আর আয়করের সর্বোচ্চ হার হতে পারে ২৫ শতাংশ।

আমরা জানি, অপ্রদর্শিত আয়ের পেছনে সরকারের নীতি-কৌশল অনেকাংশেই দায়ী। এরপরও শতকরা ৩৫ ভাগ আয়কর দিয়ে এটা শুদ্ধ করার ঘোষণা দেওয়া যেতে পারে। তবে এ সুযোগ থাকবে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। যারা এ সুবিধা নেবে, তাদের কেউ হয়রানি বা প্রশ্ন করতে পারবে না। সংসদে এ ঘোষণা দিতে হবে, তাহলে মানুষ আশ্বস্ত হবে। এরপরও কারও কাছে অপ্রদর্শিত টাকা পাওয়া গেলে পুরো টাকা বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা থাকতে হবে।

রাজস্ব আয়, ব্যয় ও বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনাই হলো বাজেট। বাজেটে বিভিন্ন নীতি থাকে, রাজস্ব আয় কীভাবে বাড়বে, উন্নয়নে কী কৌশল নেওয়া হবে। সে পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বাজেট মোটামুটি ধরনের, আহামরি কিছু না, গতানুগতিক ধরনের। তবে বাজেটের আকার ও পরিধি বাড়ানোর জন্য অর্থমন্ত্রীকে বড় ধরনের ধন্যবাদ দিতেই হয়। এরপরও বাংলাদেশের বাজেট এখনো আমাদের মোট দেশজ আয়ের মাত্র ১৮ ভাগ। এটা আফগানিস্তানে ২৯ ভাগ, ভারতে ২৮ ভাগ ও নেপালে ২২ ভাগ। তাই বাজেটকে আরও বড় করতে হবে। এ জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি-কৌশল থাকা দরকার, এটার অভাব আছে।

অনেক সমালোচনার পরও বলব, আমদানি প্রতিযোগী দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা আমাদের দিতেই হবে। প্রকৌশল ও প্রযুক্তি শিল্পকে এবার তা দেওয়া হয়েছে। তবে আরও কিছু খাতকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, যাতে করে কর্মসংস্থান ও আয় দুটোই হয়। বিশেষ করে দুগ্ধশিল্পের কথা আমি বলতে চাই। কাঁচা দুধ থেকে গুঁড়ো দুধ করতে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগবে। এতে করে গুঁড়ো দুধ আর আমদানি করতে হতো না। এ জন্য মূলধন জোগান ও মেশিনারিতে শুল্ক ছাড় দিতে হবে। বিশেষ শিল্পাঞ্চলে তাদের জায়গা দিতে হবে। এতে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন হতো। গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে স্বস্তির বাতাস বইত।

গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরার সম্ভাবনা আছে। এটাকে কাজে লাগাতে হবে। বিশেষ করে তিমি ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে বিলিয়ন ডলার মৎস্য রপ্তানি সম্ভব। আলু রপ্তানি করেও ভালো কিছু করা সম্ভব।

এখন আমাদের তুলনামূলক সুবিধার দিকে নজর দিতে হবে। চিনি উৎপাদনে যে মূলধন ব্যয় হয়, তা বন্ধ করে অন্য শিল্পে কাজে লাগাতে হবে। মোটরসাইকেল উৎপাদনে জোর দেওয়া যেতে পারে। হালকা প্রকৌশল শিল্পকে জোর দেওয়া যেতে পারে। কারণ, ‘জিঞ্জিরা জিন্দাবাদ’। এ ছাড়া সবজিকে শুধু এশিয়ার খাদ্য না করে, অন্য দেশের খাদ্যে পরিণত করা যেতে পারে। এসবই কিন্তু দেশের প্রাণ।

আমাদের দেশে প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, তদারকি ও মূল্যায়নে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের অভাব আছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা প্রকল্প পরিচালক ও কারিগরি উপদেষ্টার বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের অভাব। প্রত্যেক ক্ষেত্রে সুষ্ঠু প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে।

স্বপ্নের পদ্মা সেতুর তদারকি সরকারপ্রধান নিজেই করছেন। এ জন্য সময়ের আগেই কাজ হয়ে যাচ্ছে। তবে সব প্রকল্প তো আর তাঁর পক্ষে দেখভাল করা সম্ভব নয়। এ জন্য বড় ২৫ প্রকল্প চিহ্নিত করে আমেরিকার আদলে ‘কাউন্সিল অব ইকোনমিক অ্যাডভাইজরস’ করা যেতে পারে। এসব প্রকল্প ভালোভাবে বাস্তবায়িত হলে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি আরও ত্বরান্বিত হবে, যার প্রভাবে বৃদ্ধি পাবে কর্মসংস্থান।

সরকারি বিনিয়োগ কর্মসূচি বা পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম বাংলাদেশে চালু করতে হবে। প্রকল্প নির্দিষ্ট অঙ্কের ওপরে হলে অবশ্যই প্রাক্‌-সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হলে ২০২৫ সালের মধ্যে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কে ছোঁবে। এ ছাড়া জিডিপির অংশ হিসেবে বিনিয়োগের হার ৪০ শতাংশ এবং স্থানীয় সঞ্চয় ২০ ভাগ ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। আর মূল অগ্রাধিকার থাকবে শিল্পায়নভিত্তিক উন্নয়ন কৌশলের ওপরে।

বর্তমানে জরুরি হয়ে পড়েছে আর্থিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও বেশি গণতন্ত্রায়ণ। বেসরকারি ব্যাংকে এক পরিবার থেকে ৪ জন ও ৯ বছর মেয়াদ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, এক স্বতন্ত্র পরিচালক ছাড়া বাকি সদস্যদের অনধিক ২৫ ভাগ এক পরিবার থেকে করা যেতে পারে। তাদের মেয়াদ ৩ বছর হবে, আরও একবার বাড়ানো যেতে পারে। তবে ৬ বছর পর অবশ্যই বিরতি দিতে হবে। এ ছাড়া সরকারি খাতের সোনালী ব্যাংককে রেখে বাকিগুলোকে মূলধন বাজারের মাধ্যমে ছেড়ে দিতে হবে।

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক