হেলমুট কোহলকে মানুষ মনে রাখবে

ক্রিস্টোফ বেরট্রাম
ক্রিস্টোফ বেরট্রাম

হেলমুট কোহলের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ‘ইউরোপের বহুকালের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিত্বের’ জীবনাবসান ঘটল, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তাঁকে এই অভিধায় ভূষিত করেছিলেন। একজন সফল রাজনীতিকের যেসব গুণ থাকা দরকার, হেলমুট কোহলের মধ্যে তার প্রায় বেশির ভাগই ছিল: উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নিষ্ঠুরতা, নাছোড়বান্দা স্বভাব, কৌশলগত দক্ষতা ও সাধারণ মানুষের প্রতি সমবেদনা। তাঁর দুই পূর্বসূরি, অর্থাৎ উইলি ব্র্যান্ট ও হেলমুট স্মিটের মতো তাঁর ক্যারিশমা ছিল না। অথবা তাঁদের মতো তাঁর বাগ্মিতা ছিল না। কিন্তু দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর পরিষ্কার লক্ষ্য ছিল। এ কারণেই তাঁর পক্ষে এমন এক জিনিস অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল, যেটা আগে অকল্পনীয় ছিল। মানে তিনি ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের মধ্যে জার্মানিকে পুনরায় একীভূত করতে পেরেছিলেন।

অনেকেই, বিশেষ করে যে জার্মান নাগরিকেরা সেই ১৯৮৯ সালের শেষাংশ ও ১৯৯০ সালের শুরুর দিকের অসাধারণ সময় স্মরণ করতে পারেন, তাঁরা একটা ব্যাপারে বিস্মিত না হয়ে পারেন না। ব্যাপারটা হলো, তাঁর মতো এমন একজন প্রাদেশিক ও বিরক্তিকর নেতা কীভাবে দেশকে একীভূত করার সুযোগ হাতের মুঠোয় নিলেন এবং কীভাবে বিরোধী পক্ষকে কৌশলে ঘায়েল করলেন। মনে হয়, এই মানুষেরা ভাবেন, কোহল সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় ছিলেন। তিনি ভাগ্যবান।

কিন্তু কূটনীতিতে সৌভাগ্যজনক ফলাফল কদাচিৎ দৈবক্রমে ঘটে থাকে। ১৯৮৯ সালের গ্রীষ্মে কোহল অন্য সবার মতোই ঘটনাপ্রবাহের গতি দেখে বিস্মিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সেই ১৯৮২ সালে চ্যান্সেলর হওয়ার পর তিনি সময় কাজে লাগাতে শুরু করেন।

অভ্যন্তরীণ নীতির ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবেই কোহলকে গুরুত্ব দিতে হতো, এতে তাঁর দক্ষতাও লাগত। এর যদি অন্যথা হতো, তাহলে অটো ফন বিসমার্কের পর দলে ও দেশে তাঁর পক্ষে প্রভাবশালী নেতা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকত। কিন্তু তিনি শান্তিপূর্ণ ইউরোপে জার্মানির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার স্বপ্ন দেখতেন। এটাই তাঁর মধ্য থেকে সেরা সম্ভাবনাটা বের করে এনেছে। তাঁর চিন্তার মূল বিষয়ও ছিল এটি। আমি তখন জার্মান সাপ্তাহিক ডি সাইট-এর সাংবাদিক হিসেবে বন কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে প্রায়ই দেখা করতাম। তিনি সাধারণত আমাকে বলতেন, ‘পররাষ্ট্রনীতি অভ্যন্তরীণ নীতি থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ ক্ষেত্রে ভুল খুব মারাত্মক হতে পারে।’

ভুল এড়ানোর জন্য কোহলের মূলত ছোট ও বড় সব শক্তি, যাদের সঙ্গে জার্মানির ভালো থাকার সম্পর্ক জড়িয়ে আছে, তাদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এ ছাড়া পুনরায় একীভূত হওয়ার যেকোনো মাত্রার সুযোগ এলে তা কাজে লাগাতে বাইরের শক্তির সমর্থন লাগবে। স্মিটের কাছে প্রধান কৌশলগত অস্ত্র ছিল হিসাব-নিকাশের নিশ্চয়তা, সেখানে কোহলের কাছে ব্যাপারটা ছিল আস্থা তৈরি। আর তিনি সেটা সংহত ও নির্মাণ করতে ব্রতী হয়েছিলেন।

কোহল নিজের জমানার শুরু থেকেই জার্মানির প্রধান মিত্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। ১৯৮২ সালে মার্কিন মাঝারি সারির ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হলে কোহল শক্ত অবস্থান নেন। তিনি বুঝতে পারেন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের শ্রদ্ধা ও আস্থা উভয়ের প্রতি বড় ধাক্কা। অন্যদিকে মস্কোতে তাঁর যে বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল, সেটিও ক্ষুণ্ন হবে। সে কারণে তিনি এই শক্ত অবস্থান নেন।

অনেক বছর পর ইউরোপের দেয়ালে যখন ফাটল ধরতে শুরু করল, কোহল ওয়াশিংটনের সঙ্গে আস্থার এক অনন্য সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এইচ ডব্লিউ বুশকে সঙ্গে পেলেন, যিনি জার্মানির পুনরায় একীভূতের কট্টর সমর্থক ছিলেন। তিনি এটা নিশ্চিত করেন যে এই প্রক্রিয়া থেকে যে জার্মানির উদয় হলো, তার নাড়ি যেন পশ্চিমের মাটিতে শক্ত করে পোঁতা থাকে।

মিখাইল গর্বাচেভ ক্ষমতায় আসার পর ইউরোপে অস্ত্র কমানোর সাহসী প্রস্তাব দেন। কোহল প্রথমে তা নাকচ করলেও যখন দেখেন যে গর্বাচেভ এ ব্যাপারে সত্যিই আন্তরিক, তখন তিনি তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এরপর সুযোগ এলে চুক্তিও হয়ে যায়। আর এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ কোহল পুরস্কারের ওপর চোখটা রাখতে পেরেছিলেন।

একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, কোহল জার্মানির আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। এসব দেশের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি ভালোভাবে অবগত ছিলেন, আর তারা কীভাবে জার্মানির ব্যাপারে মনোভাব বদলায়, সেটা বোঝার মানসিকতাও তাঁর ছিল। তাঁর প্রত্যয় ছিল, ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হিসেবে জার্মানিকে সবচেয়ে গঠনমূলক হতে হবে, যদি সবচেয়ে উদার না-ও হয়।

কোহল একবার আমাকে চমকে দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাঁর বিশাল বপুর কারণে (তাঁর উচ্চতা ছিল ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি) কি লোকে মনে করবে, জার্মানি কর্তৃত্বপরায়ণ হবে। তবে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে আশঙ্কামুক্ত করতে আমার বেগ পেতে হয়নি। এরপর ১৯৮৯ সালে জার্মানির পুনরায় একীভূতের সময় ঘনিয়ে এলে তিনি এত বছর ধরে যে আস্থা নির্মাণ করেছিলেন, তার প্রতিদান পেতে শুরু করেন। ইউরোপ তাঁকে সমর্থন দেয়।

আজও জার্মানির আনুষ্ঠানিক ভাষ্যে আস্থা নির্মাণের ব্যাপারটা প্রতিধ্বনিত হয়, যদিও বাস্তবে তার ধারাবাহিকতা নেই। যখন রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতা এড়ানো যেত, তেমন সময়ে দেশটির বিচ্ছিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কী করতেন, সেটা ভাবা এখন নিষ্ফলা। হয়তো গ্রিসের ঋণ সংকটের সময় তিনি তাদের প্রতি আরও সংহতি জানাতেন। আজ তিনি চ্যান্সেলর থাকলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণের জবাবে কী করতেন, তিনি কি প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতেন?

একটা ব্যাপার পরিষ্কারই মনে হয়। কোহল স্বল্পমেয়াদি অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয় সমাধান খুঁজতেন না। বরং ইউরোপীয় ব্যবস্থায় এসব চ্যালেঞ্জের কী প্রভাব পড়ত, তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এসব বোঝার চেষ্টা করতেন, যেখান থেকে জার্মানির বেশি লাভ হবে।

শুধু জার্মানির পুনরায় একীভূত নয়, রাষ্ট্রনায়কের এই আবশ্যকীয় গুণাবলির জন্যই তিনি স্মরিত হবেন। মানুষ তাঁর জন্য শোক করবে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ক্রিস্টোফ বেরট্রাম: জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের সাবেক পরিচালক।