নেপোয় দই মারলে...

বিজেপির কান্ডারি নরেন্দ্র মোদি
বিজেপির কান্ডারি নরেন্দ্র মোদি

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, নেপোয় মারে দই। এই নেপোটি যে কে, কেনই-বা সে দই মারল, মানে খেল, কিংবা কার দইটা সে মেরে দিল, তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নিশ্চয় কোথাও না কোথাও আছে, তবে আমার জানা নেই। এটুকু জানা যে, কেউ যদি কারও জন্য প্রায় নির্দিষ্ট কোনো কিছু হাতিয়ে নেয়, তাহলে সে হলো নেপো, আর যেটা হাতাল, সেটা হলো দই। কেউ একজন হয়তো বাটি সাজিয়ে দই রেখেছিল, কোনো এক বুদ্ধিমান বা তস্কর তা সাবাড় করে দেয়। সেই থেকে নেপোয় মারে দই। এই প্রবাদেরই কাছাকাছি আরও দু-একটি রয়েছে। যেমন, বাড়া ভাতে ছাই কিংবা পাকা ধানে মই দেওয়া।
দিল্লির বিধানসভার নির্বাচন এবং সেই পটভূমিতে আগামী দিনে ভারতীয় লোকসভার নির্বাচনকে ঘিরে ইদানীং এ দেশে যা কিছু বলাবলি ও লেখালেখি চলছে, হঠাৎ এই নেপো প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ সেটাই। দিল্লিতে বিজেপির মুখের গ্রাস যেভাবে আম আদমি পার্টি (এএপি) ছিনিয়ে নিল, তাতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল আপাতত অবিসংবাদিত নেপো। এই নেপো আগামী দিনগুলোতে আর কী কী কেরামতি দেখাবে, কার কার দই মারবে, দেশজুড়ে আপাতত তা নিয়েই হরেক কিসিমের গবেষণা চলছে।
যেমন, এই লেখাটা লেখার ঠিক আগে সর্বভারতীয় এক প্রথম শ্রেণীর ইংরেজি দৈনিকের উদ্যোগে একটা সর্বভারতীয় সমীক্ষা বা জরিপ হাতে এল। দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, পুনে ও আহমেদাবাদ—এই আট জনবহুল শহরে চালানো জরিপের যা নির্যাস, তাতে কংগ্রেস তো বটেই, বিজেপিরও রাতের ঘুম উবে যেতে পারে। কেননা, জরিপ অনুযায়ী এই শহরগুলোর ৫৮ শতাংশ মানুষ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এখনো নরেন্দ্র মোদিকে পছন্দ করলেও ২৫ শতাংশ পছন্দ করছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে। রাহুল গান্ধী মাত্র ১৪ শতাংশের ভোট পেয়ে অ-নে-ক পেছনে। ৮১ শতাংশ মনে করছে, এএপির উচিত জাতীয় স্তরে নির্বাচন লড়া, ৪৪ শতাংশ জানিয়েছে তাদের কেন্দ্রে এএপি প্রার্থী দিলে তারা তাদেরই ভোট দেবে। বিজেপি ও কংগ্রেসের দুশ্চিন্তা বাড়ানোর মতো আরও একটি তথ্য হলো, এই আট শহরের ২৫ শতাংশ মানুষ মনে করে, আগামী লোকসভার ভোটে এএপি ২৫টির মতো আসন জিতবে। ২৬ শতাংশ মানুষের ধারণা, এএপি ২৬ থেকে ৫০টির মতো আসন জিতবে এবং ৩৩ শতাংশ বিশ্বাস করে, ৫১ থেকে ১০০টি আসন জেতার ক্ষমতা এএপির রয়েছে।
জরিপ সর্বদা ষোলোআনা সত্য না হলেও মানুষের মনোভাবের প্রতিফলন তাতে ঘটে। কেজরিওয়ালদের মাস দুয়েক আগেও যাঁরা হ্যাক থু করেছেন, দিল্লি নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর তাঁদের গলাতেই এখন আচমকা উল্টো সুর শোনা যাচ্ছে। হোমরাচোমরা যাঁরা টোকা মেরে পোকা সরানোর ঢঙে এএপিকে তাচ্ছিল্য করেছিলেন, তাঁরাই এখন এই জরিপের নির্যাসে বাকহীন।
আম আদমি পার্টির আকস্মিক এই উত্থানে শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে, তা এ দেশের জনতা জনার্দনই ঠিক করবে। এ কথা বলেও এটুকু কবুল করা যেতেই পারে যে, দিল্লির ভোটের ফল বেরোনোর আগে পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদিকে নিয়েই প্রচারমাধ্যম মুখর ছিল। অবধারিতভাবে তিনিই ছিলেন আলোচনার মধ্যমণি। তা সে ‘শাহজাদা’ রাহুল গান্ধীকে কটাক্ষ বা ভুলভাল ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাই হোক, মোদিময়ই ছিল সংবাদমাধ্যম। দিল্লির ভোটের ফল বেরোনোর দিন থেকেই মোদিকে সরিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল হয়ে গেলেন আলোচনার মূল বিষয়। ফল প্রকাশের পর মাস কেটে গেছে, এখনো প্রচারমাধ্যমে মোদিকে পিছিয়ে অব্যাহত রয়েছে এএপি-চর্চা। সেই চর্চায় এই প্রশ্ন উঠেছে, শেষ পর্যন্ত মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বপ্নে কেজরিওয়াল কাঁটা হয়ে দাঁড়াবেন কি না।
সংশয়টা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না একাধিক কারণে। প্রথম কারণ, দেশের শহরাঞ্চলে আম আদমির সদস্য সংগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। ভোটের পর পাঁচ লাখ নতুন সদস্য নিজের গরজে এগিয়ে এসে ১০ রুপি দিয়ে নামই শুধু লেখায়নি, নিঃস্বার্থে দলের যেকোনো ধরনের কাজে আসার অঙ্গীকার করেছে। সর্বভারতীয় সদস্যসংখ্যা ২০ লাখ ছাড়িয়েছে। ২৬ জানুয়ারির মধ্যে সারা দেশে এক কোটি সদস্য করার ব্রত নিয়েছে। সদস্য ফি তুলে দেওয়া হয়েছে। সারা দেশের ৩০৯টি জেলায় ইতিমধ্যেই ৩২২টি অফিস খোলা হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে দলের বিদেশনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক বিষয়গুলো নিয়ে দলীয় অবস্থান চূড়ান্ত করে ফেলা হবে। অর্থাৎ, দলের গঠনতন্ত্র ও নির্বাচনী ইশতেহার চূড়ান্ত হয়ে যাচ্ছে। লোকসভা ভোটে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও কোন কোন রাজ্যের কোন কোন আসনে প্রার্থী দেওয়া হবে, মোটামুটিভাবে তা ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখের মধ্যে ঠিক করে ফেলা হবে। দলের একাংশের মতে, লোকসভার ৫৪৩ আসনের মধ্যে অন্তত ৩০০ আসনে লড়াই করা উচিত। অন্য অংশ মনে করে, এটা একটু হঠকারিতা হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং একটু ধীরে চলে কমবেশি ১০০ আসনে জোর দিয়ে ৫০টি জিতলে ষোড়শ লোকসভায় তারাই হয়ে দাঁড়াবে নির্ণায়ক শক্তি। এই অংশের মতে, ষোড়শ লোকসভা ক্ষীণজীবী হবে। বছর দুয়েকের মধ্যেই ফের নির্বাচন অবধারিত এবং তখন একা অথবা সমভাবাপন্নদের নিয়ে তারাই গড়তে পারবে ‘স্বচ্ছ, সৎ ও স্থিতিশীল’ সরকার।
নানা কারণে বীতশ্রদ্ধ ও হতাশ ভারতের জনগণ এএপির অনভিজ্ঞ নেতাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে চাইছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ এতে যোগ দিচ্ছে প্রধানত দুটি কারণে। ১. দুর্নীতি ও পেশিবলমুক্ত রাজনীতির আবহ সৃষ্টি এবং ২. জাত-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-পরিবারভিত্তিক রাজনীতির অবসানের আশায়। উত্তর ভারতের কংগ্রেসবিরোধী রাজনৈতিক পরিসর এই দল অতি দ্রুত দখল করে চলেছে এবং ক্রমে বিপজ্জনকভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে বিজেপিকে। মাত্র এক মাস আগে পর্যন্ত যে দেশের মানুষ এএপিকে সেভাবে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি, সেই মানুষই এক মাস পরে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে প্রধানমন্ত্রিত্বের গুরুত্বপূর্ণ দাবিদার হিসেবে তুলে ধরতে পছন্দ করছে। এতটাই যে, রাহুল গান্ধী পিছিয়ে পড়ছেন এবং নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কেজরিওয়ালের ফারাকও দ্রুত কমে যাচ্ছে।
বিজেপির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে ঠিক এই কারণেই। মোদির উত্থানের মধ্য দিয়ে যে বিজেপি ২০১৪ সালে একাই ২০০+ আসনের খোয়াব দেখছিল, তারাই আচমকা এএপির উত্থানে থমকে গেছে। লোকসভার মোট ৫৪৫ আসনের মধ্যে কমবেশি ১০০ আসন পুরোপুরি শহুরে। আধা-শহর আধা-গ্রাম নির্বাচনী কেন্দ্রের সংখ্যা আরও শ খানেক। শেষ পর্যন্ত কত আসনে এএপি লড়বে তা এখনো নিশ্চিত না হলেও উত্তর ভারতের দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরাখন্ড, হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটককে তারা টার্গেট করছে। এই রাজ্যগুলোতে বিজেপি বা তাদের জোটসঙ্গীর সঙ্গে লড়াইটা প্রধানত কংগ্রেস ও তার জোটসঙ্গীর। এর বাইরে দুটি রাজ্য উত্তর প্রদেশ ও বিহারকে মোদি বিরাটভাবে তাঁর হিসাবে রেখেছেন, যেখান থেকে ১২০টির মধ্যে অন্তত ৬০টি আসন জিততে তিনি মরিয়া। এই রাজ্যগুলোর কংগ্রেসবিরোধী যে ভোট বিজেপির দিকে আসা প্রায় নিশ্চিত ছিল, এএপির উত্থান তাতে নিশ্চিত থাবা বসাবে। কংগ্রেসের অজনপ্রিয়তায় ভর দিয়ে এবং মোদির ভাবমূর্তিতে নির্ভর করে ভোটভিত্তিক রাজনীতির যতটা বিজেপি ঝুলিতে পোরার আশা করছিল, তা বানচাল হয়ে যেতেই পারে। এএপি লক্ষ্য অনুযায়ী লোকসভায় অন্তত ৩০-৪০টি আসনে জিতলে বিজেপির ২০০+ লক্ষ্যমাত্রা কমে ১৫০-১৬০-এ দাঁড়াতে পারে। এই মুহূর্তে এএপির পালে যে হাওয়া তাতে তাদের ৩০-৪০টি আসন জেতা অসম্ভব নয়। তা যদি হয়, তাহলে তারাই হয়ে দাঁড়াতে পারে সরকার গঠনের নির্ণায়ক শক্তি। এর নিট ফল হবে মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বপ্ন ভেঙেচুরে খানখান হওয়া।
কংগ্রেসের অতি বড় সমর্থকও তৃতীয় ইউপিএ সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখছে না। তাদের পক্ষে মন্দের ভালো এএপি তাদের নাক কাটলেও তাতে যেন মোদির যাত্রাভঙ্গ হয়। বিজেপি এখনো মনে করছে, দিল্লি বিধানসভায় এএপি প্রাধান্য পেলেও লোকসভায় জনগণ শেষ পর্যন্ত মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপিকেই বেছে নেবে; অজ্ঞাতকুলশীল আম আদমি পার্টিকে ভোট দিয়ে জাতীয়তাবাদী শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান মানুষ সর্বনাশের ঝুঁকি নেবে না। কিন্তু এবারের ভোট যেখানে সার্কাসের ট্রাপিজের খেলার মতোই টানটান সাসপেন্সে মোড়া এবং এএপির হাওয়া যেভাবে ক্রমে ঝড় হয়ে ওঠার আভাস দিচ্ছে, সেখানে সামান্য কিছু আসনের এপাশ-ওপাশ হওয়া অনেক ওলট-পালট ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট। নরেন্দ্র মোদির ভয় ও আশঙ্কা সেটাই। কাপ ও ঠোঁটের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে অনেক কিছুই গলে যায়! নেপো সেজে অরবিন্দ কেজরিওয়াল শেষ পর্যন্ত দই মেরে দিলে নরেন্দ্র মোদির আফসোসের আর শেষ থাকবে না।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।