শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা আর কত?

শিশুটির অপরাধ ছিল সে ভালোভাবে ডিমটি পোচ করতে পারেনি। ডিমের কুসুম ছড়িয়ে গিয়েছিল। এ যে বিরাট অপরাধ! এত বড় অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে, কোনো শাস্তি হবে না! তাই কি হয়? তাই তো বুকে ও হাতে গরম খুন্তি দিয়ে ছ্যাঁকা দেন শিশুটির ‘ম্যাডাম’। শুধু এটা করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। মনের ঝাল মেটানোর জন্য রুটি বানানোর বেলুন দিয়ে শিশুটিকে আচ্ছামতো পেটান।

৪ জুলাই প্রথম আলোয় শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার এ খবরটি প্রকাশিত হয়। নির্যাতনের শিকার ১১ বছর বয়সী শিশুটির নাম সাবিনা। বাড়ি টাঙ্গাইল। ছয় মাস আগে রাজধানীর পল্লবীতে এক সেনা কর্মকর্তার বাসায় কাজে দেওয়া হয় তাঁকে। একটি ১১ বছর বয়সী শিশুর কাজ করতে গিয়ে ভুলচুক হবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার ‘ম্যাডাম’ অর্থাৎ গৃহকর্ত্রী আয়েশা লতিফ তা মানতে নারাজ। একটু ভুল হলেই সাবিনার ওপর নেমে আসত অকথ্য নির্যাতন। আয়েশা লতিফ এক কন্যাসন্তানের জননী। শিগগিরই আরেক সন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছেন। একজন মা হয়ে কী করে একটি শিশুর প্রতি এমন নিষ্ঠুর হতে পারেন? মাতৃত্ববোধ, মমত্ববোধ কি তাঁর মধ্যে নেই? অন্যের সন্তানের প্রতি তিনি মমতা নেই বোধ করতে পারেন। মনুষ্যত্ববোধও কি নেই তাঁর মধ্যে? কারও মধ্যে ন্যূনতম মনুষ্যত্ববোধ থাকলে তার এ রকম নিষ্ঠুর আচরণ করার কথা নয়। অবশ্য গৃহকর্মী অর্থাৎ কাজের মেয়ে বা কাজের ছেলেকে নির্যাতন করা অপরাধের মধ্যে পড়ে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। অনেকে এটাকে অপরাধ বলে গণ্যই করে না। দেশে গৃহকর্মী নির্যাতনের অনেক মামলা হয়। কিন্তু এ জন্য কারও কোনো শাস্তি হয়েছে, এমনটা শোনা যায়নি। আয়েশা লতিফের বিরুদ্ধেও পল্লবী থানায় মামলা হয়েছে। কিন্তু ন্যায়বিচার পাবে কি সাবিনা?

যেদিন সাবিনার বুকে ও হাতে খুন্তির ছ্যাঁকা দেওয়া হয়, সেদিন সে ওই বাসা থেকে পালিয়ে যায়। আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করে। কিন্তু দুদিন না যেতেই তাকে উন্নত চিকিৎসার কথা বলে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কেন তাকে রাতারাতি ওসিসি থেকে সিএমএইচে নেওয়া হলো। কোনো মহলের চাপে কি এটা করা হয়েছে? করলে কেন? আমরা যাতে সাবিনার খবর আর জানতে না পারি, সে জন্যই কি? প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়তো কখনোই পাওয়া যাবে না।

গরিব মানুষজন সংসারে একটু সচ্ছলতার আশায় নিজের শিশুসন্তানদের অন্যের বাসায় কাজ করতে পাঠান। ভাবেন, আর কিছু না হোক তিন বেলা পেট ভরে তো খেতে পারবে। কেউ কেউ হয়তো ভালো থাকে। কিন্তু বেশির ভাগের কপালে জোটে নানা ধরনের নির্যাতন। এরা ঠিকমতো মজুরি তো পায়ই না, উপরন্তু থাকতে হয় খাদ্যকষ্টে, সইতে হয় অপমান-নির্যাতন। কিল, চড়-থাপ্পড় আর গরম খুন্তির ছ্যাঁকা তো আছেই। চলে আরও নানা ধরনের নির্যাতন। ধারালো ছুরি-ব্লেড দিয়ে কাটা হয় তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ, গায়ে গরম তেল ছিটানো হয়, ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়। অল্প বয়সী মেয়েদের বেলায় বাড়তি যোগ হয় যৌন নিপীড়ন। এ ধরনের বর্বর আচরণ যাঁরা করেন, তাঁদের বেশির ভাগই ভদ্র-সভ্য মানুষ হিসেবে পরিচিত। এই ভদ্র চেহারার আড়ালে তাদের যে কদর্য মানসিকতা লুকিয়ে আছে, তা বোঝার কোনো উপায় নেই।

এমনকি বিদেশে গিয়েও তারা গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে পারেন না। অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গৃহকর্মীকে নির্যাতন ও ঠিকভাবে বেতন না দেওয়ার অভিযোগে বাংলাদেশের দুজন কূটনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা, তাঁদের গ্রেপ্তার, জামিনসহ পরবর্তী ঘটনাবলি দেশ ও সরকারের জন্য চরম অপমান বয়ে এনেছে। বিদেশে কর্মরত কূটনীতিকেরা যে শুধু চাকরি করেন তা নয়, তারা সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি। অথচ এই দুই কূটনীতিক এমন আচরণই করলেন, যাতে আমাদের সবার মাথা হেঁট হয়ে গেছে। এ ঘটনার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোয় নিযুক্ত বাংলাদেশি কূটনীতিকদের দেশ থেকে গৃহকর্মী নেওয়ার ওপর এ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ ছাড়া উপায়ই বা কী ছিল?

মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন স্বাচ্ছন্দ্য আনতে সাবিনাদের মতো মেয়েদের যে কত প্রয়োজন, তা মোটামুটি কমবেশি সবাই জানেন। তাদের ছাড়া আমাদের সংসার এক দিনও চলতে চায় না। অথচ তাদেরই কিনা আমরা নির্যাতন করছি। সামান্য কাপ-প্লেট ভাঙার জন্য যেভাবে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়, তা ভাবা যায় না? হতে পারে গৃহকর্মী হিসেবে আমার কাউকে পছন্দ হলো না। তাই বলে তাকে মারধর করব? তাকে কাজ থেকে বাদ দিলেই তো হয়ে যায়। সেটা না করে দিনের পর দিন নির্যাতনের অর্থ কী?

সরকার ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর গৃহকর্মকে ‘শ্রম’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’-এর খসড়া অনুমোদন করে। এই নীতিতে গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদের সুরক্ষা, কল্যাণ, অবকাশ, বিনোদন, ছুটিসহ তাঁদের সুষ্ঠু ও মর্যাদাসম্পন্ন কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কয়জন এই নীতির কথা জানেন? আর জানলেও কি মানবেন? সন্দেহ আছে। আমি নিশ্চিত, গৃহকর্মীদের কেউ এই নীতির কথা জানেই না। তাদেরকে জানাতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে ভূমিকা নিতে হবে। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। তাতে কাজ না হলে প্রয়োজনে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। গৃহকর্মী নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে সাবিনাদের মতো মেয়েদের ওপর নির্যাতন কেউ ঠেকাতে পারবে না।

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক