চাই কম্পিউটারের পূর্ণ ব্যবহার

নানা দেশ ভ্রমণ করে আমার এই ধারণা জন্মেছে যে বিশেষ করে, আমাদের মতো সীমিত সম্পদের দেশে অনেক কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে কম্পিউটার সরঞ্জামাদি কিংবা সফটওয়্যার কেনায় আমাদের অনেক আগ্রহ থাকলেও তার পরিপূর্ণ ব্যবহারে আমরা আন্তরিক নই। প্রতিবছর হাজার হাজার কম্পিউটার কেনা হয় এবং তার অধিকাংশেরই যথাযথভাবে ব্যবহার হয় না। দেশের মূল্যবান সম্পদ অবহেলায় নষ্ট করার সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য আমি শঙ্কিত হই।

আমরা জানি, একটি কম্পিউটারের যোগ্য ব্যবহার হাজার মানুষের শ্রমকে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলতে পারে। একে তো দেশে বেকার মানুষ প্রচুর, তার ওপর তাদের কাজ কম্পিউটার দিয়ে করালে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে, তা-ই তো স্বাভাবিক। তবে শুধু মানুষের কাজগুলো করার জন্য কম্পিউটার ব্যবহারে কোনো বাহাদুরিও নেই। বরং যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমাদের সিস্টেমের উন্নয়ন ঘটাবে এবং যে কাজগুলো সম্ভবত কম্পিউটার ছাড়া শুধু মানুষ দিয়ে করা অসম্ভব, সেগুলো কম্পিউটারের মাধ্যমে করে সীমিত সম্পদের জুতসই ব্যবহারে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়াই হবে কম্পিউটারের যোগ্য ব্যবহার।

আমরা ব্যাংকে কম্পিউটার ব্যবহার করব শুধু টাকা জমা এবং ওঠানোর পর অ্যাকাউন্টে কত টাকা রইল তা বের করার জন্য নয়, বরং আমানতকারীদের ব্যয়ের ধরন বের করে ব্যাংকের গচ্ছিত মূলধনের সর্বোত্তম বিনিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য এবং আকর্ষণীয় নীতিমালা প্রণয়ন করে আমানতকারীদের সঞ্চয়ী হতে উৎসাহিত করার জন্য। বর্তমানে দেশে বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংক খেলাপি ঋণে জর্জরিত। ব্যাংকের এই দুরবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সরকারও বেশ উদ্বিগ্ন। কোন প্রকল্পে অর্থায়ন করা যাবে, কাকে ঋণ দেওয়া যাবে, তা সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ব্যাংকগুলো যদি সম্ভাব্য ঋণখেলাপি সৃষ্টি নিরুৎসাহিত করতে পারত, তাহলে কম্পিউটারাইজেশনের সুফল পাওয়া যেত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি। আমরা প্রতিবছর নিয়মিতভাবে মধ্যপ্রাচ্যের সুবিধাবঞ্চিত চাকরিজীবীদের রেমিট্যান্স ও পোশাকশিল্পের বঞ্চিত শিল্পীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে দামি কম্পিউটার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, বিদেশি সফটওয়্যার কিনছি এবং নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক মানের বেতন ও পরামর্শ ফি দিয়ে বিদেশিদের নিয়োগ করছি কিন্তু সেই বিশ্বমানের সফটওয়্যার আর পরামর্শক আমাদের কোনো সুফল দিতে পারছে না।

রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা শিক্ষার্থীদের মায়ের মোবাইল অ্যাকাউন্টে যাতে সরাসরি চলে যায়, এর জন্য প্রগতি সিস্টেম লিমিটেডের কারিগরি সহায়তায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের একটি কম্পিউটার সিস্টেম তৈরি হয়েছে। এই উপবৃত্তির কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ৬০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৮০ হাজার গ্রাম, ১ কোটি মা এবং ১ কোটি ৩০ লাখ শিশু। প্রতিবছর ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পৌঁছে যাবে মায়েদের হাতে তাঁদের জন্য বিনা পয়সায় তৈরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। এরই মধ্যে শুধু ডিজিটাল ডেটাবেইস তৈরির ফলে মায়েদের নামে অন্যায়ভাবে সুবিধা নেওয়ার সংখ্যা ১৫ শতাংশ কমে গেছে। এই টাকা দিয়ে সুবিধাবঞ্চিত, অর্থনৈতিকভাবে কম অগ্রসর অধিকসংখ্যক পরিবারকে উপবৃত্তির আওতায় আনা যাবে।

আমরা জানি, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে আমাদের দেশের নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতায়নসহ উদ্যোক্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হচ্ছেন। দেশের উন্নয়নে এখন অর্ধেক মানুষ আর নীরব অসহায় দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকছে না। ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পসমূহ, পোশাক খাত যেমন নারীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে, মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্টে উপবৃত্তির অর্থ নারীর ক্ষমতায়নের এমনই আরেকটি কার্যকর উদাহরণ। প্রগতির তৈরি করা সিস্টেমের মাধ্যমে সারা দেশের কোটি মায়ের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করা সম্ভব, তাঁদের নানা তথ্য মুহূর্তের মধ্যেই জানা সম্ভব। মায়েরা এই অ্যাকাউন্ট থেকে শুধু টাকা তুলবেনই না, বরং টাকা সঞ্চয়ও করবেন, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবেন। মায়েদের যে ডেটাবেইস তৈরি হয়েছে, তাতে ডেটা মাইনিং করে কত রকম তথ্যও যে বের হয়ে আসবে, তা কেবল সময়ই বলে দিতে পারবে। এর ফলে সরকারের বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের মহাকর্মযজ্ঞ আরও কার্যকর হবে। বছরে আমাদের ৩৫ কোটি পাঠ্যপুস্তক লাগবে, না ৩০ কোটি, এখন আমরা এমনকি এই উপবৃত্তির তথ্যভান্ডার থেকে বলে দিতে পারব। প্রতিটি পুস্তক তৈরিতে যদি ৩০ টাকা খরচ হয় এবং ৫ কোটি পুস্তক কম তৈরি করতে হয়, সেখানেও কিন্তু ১৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এই সিস্টেমের ব্যবহারে এবং উন্নয়নের ফলে আগামী দিনগুলোতে কত রকম তথ্য, উপাত্ত ও পরিসংখ্যান বের হয়ে আসবে এবং তা আমাদের পরিকল্পনা করতে কাজে আসবে, তা এখনো আমরা কল্পনা করতে পারি না।

আমরা ইতিমধ্যে বিদেশি সফটওয়্যার ও বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতেই বড় মাপের সাইবার হামলার শিকার হয়েছি। সাইবার নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই বিষয়ে নিজস্ব প্রযুক্তি, সক্ষমতা ও লোকবল তৈরি করা। এই কর্মকাণ্ডে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে

এক কোটি মায়ের অ্যাকাউন্ট খোলা বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। রূপালী ব্যাংকের জন্যও এটি একটি বড় পদক্ষেপ। কারণ, আগে এই ব্যাংকের গ্রাহকসংখ্যা ছিল প্রায় ৩৩ লাখ। আর এখন সংযোজিত হলো আরও ১ কোটি। অর্থাৎ গ্রাহকসংখ্যা ৩০০ শতাংশ বেড়ে গেল। মায়েদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকলে নিশ্চয়ই শুধু উপবৃত্তির টাকা জমা নয়, অন্য কাজেও তা ব্যবহার করতে পারবেন। নারীর ক্ষমতায়নে এই অ্যাকাউন্ট বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এই প্রকল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই ডেটাবেইস তৈরি করার জন্য এবং মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনার জন্য যে সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণভাবে এ দেশের ছেলেমেয়েরা তৈরি করেছে। এ জন্য আমাদের বিদেশ থেকে লাখ লাখ ডলার খরচ করে সফটওয়্যার আমদানি করতে হয়নি, আর তা পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক হারে পরামর্শক ফি গুনতে হয়নি। এভাবে দেশি সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে আমাদের শুধু বৈদেশিক মুদ্রাই সাশ্রয় হবে না, আমাদের তরুণ কম্পিউটার বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতা বাড়বে, তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

সারা দেশে মায়েদের যে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে, সেখানে প্রত্যেক গ্রাহকের একটা করে ফরম তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ফরমে মায়েদের যাবতীয় তথ্যের সঙ্গে তাঁর সন্তানদের বিবরণ আছে এবং শিক্ষকদের স্বাক্ষর আছে। এই ফরম ব্যবহার করে রূপালী ব্যাংক এখন এই গ্রাহকদের বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সেবা দিতে পারে। যেমন ১ কোটি মায়ের মধ্য থেকে যদি আমরা ১০ লাখ মায়ের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে ঋণ দিই, তাহলে ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া সম্ভব। লক্ষ করার বিষয় এই যে এই ফরমে সন্তানদের নাম এবং শিক্ষকদের স্বাক্ষর আছে, সেই অ্যাকাউন্ট থেকে ঋণ নিলে ঋণখেলাপি হওয়ার আশঙ্কা কম হবে। প্রতিটি ঋণের বিপরীতে যদি একজন করে মানুষের কাজ তৈরির সুযোগ তৈরি হয়, তাহলে এই ১০ লাখ ঋণের মাধ্যমে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব, যা দেশের উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে।

দেশে ৫০টি ব্যাংক রয়েছে, তাদের ৮-১০ হাজার শাখা। এর জন্য আমাদের একটি ব্যাংকিং সফটওয়্যার নিজেদেরই তৈরি করা উচিত। আমাদের দেশি সফটওয়্যারে যে কাজ হয়, তার প্রমাণ বিভিন্ন ব্যাংকে এসব সফটওয়্যার চলছে। দেশজ ব্যাংকিং সফটওয়্যার আমাদের সব ব্যাংকেই চলতে পারে। তাতে যেমন আমাদের কম্পিউটার পেশাজীবীদের অভিজ্ঞতা হবে, আত্মবিশ্বাস বাড়বে, ঠিক তেমনি দেশের সফটওয়্যার–সামগ্রী ব্যবহারে সাধারণ নাগরিকদের গর্ববোধও বাড়বে।

ইদানীং একটি বহুল আলোচিত বিষয় হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তা। এ বিষয়ে আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরেও অনেক কথা হচ্ছে। এই অবস্থাকে পুঁজি করে প্রচুর টাকার হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার আমদানি করা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবত আন্তর্জাতিক দামে বিদেশি পরামর্শকও। আমরা ইতিমধ্যে বিদেশি সফটওয়্যার ও বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতেই বড় মাপের সাইবার হামলার শিকার হয়েছি। সাইবার নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই বিষয়ে নিজস্ব প্রযুক্তি, সক্ষমতা ও লোকবল তৈরি করা। এই কর্মকাণ্ডে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যদি সবাই মিলে একে অপরকে সহায়তা করি, প্রযুক্তি সক্ষমতা বাড়াই এবং প্রযুক্তির জ্ঞানচর্চা ভাগাভাগি করি, তবেই শুধু সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।