কান ধরার মুরদ ও দুর্গত পিঁপড়াদের গল্প

টেলিভিশনের লোক খুঁজে পেয়েছিল লকুসকে। হয়তো চমকে দেওয়া খবরের সুলুক সন্ধানে ছিল ক্যামেরা কাঁধে নেওয়া লোকেরা। ‘ত্রাণের জন্য হায় হায়’-জাতীয় খবরের সাক্ষীসাবুদসহ কে না দিতে চায় খবরে-প্রচারে; টিএফটি প্রতিযোগিতার ঘোড়ারোগে আমরা আক্রান্ত কি? লকুসের চেহারা কোনো রাখঢাক না করে প্রচারিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, তার বেদনার কথা, না পাওয়ার কথা তাদের চোখে পড়ে যাদের হাত ব্যথা হয়ে গেছে ত্রাণ দিতে দিতে। ‘এত বড় সাহস! ঘরে খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছি; নির্বাচনের হাওয়া বইবে বইবে, এ সময়ে এমন বদনাম?’ গরিব অসহায় পিঁপড়ের মতো ক্ষুদ্র লকুসকে ধরে এনে প্রকাশ্য সভায় তার কান মলে দিয়েছেন ক্ষমতাসীনদের লম্বা হাতের স্থানীয় প্রতিনিধি বকুল সাহেব।

আমরা সদা সত্য কথা বলি। আচরণে যুধি‌ষ্ঠির; বিচক্ষণে বাদশা সোলায়মান। লকুসরা মিথ্যা বলে। জালিয়াতি করে; ফাঁকি দেয়।

হাজার কোটি টাকা হাফিস করে দেওয়া অমানুষদের জীবনী আমাদের পাঠ্য হয়। ফেলে দেওয়া শুকনো রুটির সন্ধানে আসা শিশুকে পিটিয়ে লাশ বানাই। চুল কেটে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখি। ছবি তুলে ছাপিয়ে দিই সামাজিক মাধ্যমের অসামাজিক পাতায়।

ফেলে দেওয়া শুকনো রুটির সন্ধানে ক্ষুধার্ত শিশু কেন আসে? কেন স্বাধীন দেশের খোলা রাস্তার আলো-আঁধারিতে কিশোরী মেয়েটা রং মেখে দাঁড়িয়ে থাকে? অসামাজিক য‌ে এসব!

আমি যতই ত্রাণ দিয়ে আসি না কেন, পরের দিন লকুসদের কাছে আপনি গেলে তারা কেন বলে, ‘না, আমি কোনো ইলিপ পাই নাই?’

দুর্গতির মধ্যে থাকা মানুষটা তো জানে না পরের ত্রাণ কবে আসবে। কী থাকবে সেই ত্রাণের বাক্সে? কাদের, কীভাবে দেওয়া হবে সেসব? তালিকা কি আবার হবে? কে করবে সে তালিকা? ভিত্তি কী হবে সে তালিকা তৈরির?

তাকে তো টিকে থাকতে হবে আবার ফসল না ওঠা পর্যন্ত কিংবা একটা কাজ না পাওয়া তক তাকে প্রাণ তিষ্টাতে হবে। কোনো জাদু জানা নেই তার। ত্রাণই হয়তো তার একমাত্র ভরসা। তাই বুঝি তাকে বলতে হয় অন্য কথা, যদি আরেকটা টিকিট পাওয়া যায় ইলিপের। এ যেন পিঁপড়ের জীবন; অজানা শীতের জন্য যা পাওয়া যায় সঞ্চয় করে রাখা। কখনো নিজের ওজনের চেয়েও ভারী জিনিস বহন করে নিয়ে যায় পিঁপড়ে তার গর্তে। শীতের সঞ্চয় চাই খাদ্য খুঁজিতেছি তাই। দুর্গত এলাকার মানুষও চলে পিঁপড়ের দর্শনে, অনাগত কালের কথা মনে রেখে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামোয় জবাবদিহি, স্বচ্ছতা আর আক্রান্ত মানুষদের প্রকৃত অংশগ্রহণ না থাকলে মানুষ জানতে পারবে না ত্রাণের উৎস, ব্যাপ্তি, উপাদান আর কালচক্র। এগুলো না জানলে বা জানালে মানুষ যা পাবে, তা-ই হাত পেতে নিতে চাইবে। এটা তার জীবন রক্ষার কৌশল—কোপিং মেকানিজম—মিথ্যা বলা বা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কোনো কৌশল নয়। সাধারণ মানুষ কূট কৌশলের ধার ধারে না। একটা কৌশলের সন্ধানেই তার জীবন কেটে যায়—জীবন রক্ষার কৌশল। অনেকেই এটাকে ধান্দা বলেন। ধান্দা হোক আর জীবনযাপনের কৌশলই হোক, আমরা যারা চোর ধরার অভিনয় করি, তাদের বুঝতে হবে কে আসল চোর? হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে ফকির লালন সাঁই যাকে ধরতে চেয়েছিলেন, সে কি চিরকালই হাওয়ায় মিলিয়ে থাকবে। আর নিরীহ মানুষদের আমরা কান মলেই যাব?

একটা অপ্রাসঙ্গিক কৌতুক!
একদিন নাকি এক লোককে পাওয়া যাচ্ছে না। সপ্তাহ খানেক পরে বাড়ি এসে বউকে বলল, প্রায় শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম।
প্রায় শ্বশুরবাড়ি মানে?
মানে আমার মামাশ্বশুরের বাড়ি গিয়েছিলাম।
তো কী খেতে দিল?
প্রায় গরম ভাত দিল!
মানে?
অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল তো, তাই সকালের রান্না করা ভাত গরম করে দিল।
সঙ্গে কী?
সঙ্গে প্রায় আস্ত একটা মুরগি।
প্রায় মুরগি মানে?
একটা আস্ত ডিম ভেজে দিয়েছিল। মুরগিটা প্রায় ডিমের ভেতরই ছিল।

গল্পটা, বলা বাহুল্য, এভাবে অনেক বড় করা যায়। কথার পিঠে কথা যোগ করে অনেক কথাই বলা যায়। যিনি যা অনুমান করেন, বলেন, মনে করেন, প্রায় সত্য কথাটাই তিনি বলেছেন।
মনে করেন, আমাদের দেশ প্রায় মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।
সবকিছুতেই শান্তি প্রায় এসে গেছে। বন্যা, জলাবদ্ধতার সমস্যা প্রায় নিরসনের দ্বারপ্রান্তে।
ক্ষমতাবানদের গাড়ি মোটেও রং সাইড দিয়ে চলে না।
প্রায় সঠিক রাস্তা দিয়েই চলাচল করে।
আমরা কি এখন সেই ‘প্রায়’-এর যুগ অতিক্রম করছি?

গওহার নঈম ওয়ারা: বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক