নিজভূমে পরবাসী হওয়াই নিয়তি?

সংখ্যালঘু শব্দটি অসহনীয় যন্ত্রণা হয়ে এক-একটি সম্প্রদায়ের মানুষের বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। দেশভাগের সময়ের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ক্ষত এখনো বুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন প্রবীণদের কেউ কেউ। মুক্তিযুদ্ধকালেও চড়া মূল্য দিতে হয়েছে এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। স্বপ্ন ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে এসব থাকবে না। কারণ, প্রেরণা হিসেবে যে চেতনা মুক্তিযুদ্ধে উদ্দীপনা জুগিয়েছিল, তাতে অসাম্প্রদায়িকতা ছিল শীর্ষস্থানে। অথচ এই বাংলাদেশে কয়েক বছর পর সাম্প্রদায়িকতার সেই বিষধর সাপ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর এসব ঘটনা নিয়ে বরাবরই রাজনীতি হয়। একেকটি পক্ষ পরস্পরের ওপর দোষ চাপাতে চায়। আমরা এসবের পুনরাবৃত্তি দেখি। গণমাধ্যমে সমালোচনা, রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল-সমাবেশ হয়। কিন্তু বাস্তবতা অপরিবর্তিতই থেকে যায়।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে এবার নিন্দা-প্রতিবাদ যথেষ্ট হচ্ছে। এ রকম প্রতিবাদ আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। এখন ফেসবুক-টুইটারসহ অনলাইনভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ ব্যাপারে খুবই সরব। সেখানে প্রতিবাদের ঝড় দেখে মনে হয়, সেই ভার্চুয়াল জগতের বাইরে বাস্তব জগতেও যদি সত্যিকারের সচেতনতার দেখা মিলত। কারণ, অতীতের কয়েকটি ঘটনায় দেখেছি, ভার্চুয়াল সচেতনতা কতটা ক্ষণস্থায়ী। নতুন ঘটনা এলেই ভার্চুয়াল-সচেতনেরা সেটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তখন আড়ালে পড়ে যায় সদ্য বহুল আলোচিত বিষয়গুলোও।
নির্বাচন এলেই সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা হবে—বিষয়টি যেন অবধারিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। ভোট দিতে গেলে তারা এক পক্ষের নির্যাতনের শিকার হয়, আর ভোট না দিলে অপর পক্ষ তাদের ওপর চড়াও হয়। তা ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এক-একটি রায়ের পর কী ঘটবে, তা নিয়েও সংখ্যালঘুদের আতঙ্কে থাকতে হয়। কারণ, মুক্তিযুদ্ধকালে সংখ্যালঘু নির্যাতনের দায়ে যে অপরাধীদের কঠোর সাজা হচ্ছে, তাঁদের সমর্থক-অনুসারীরা আবার সংখ্যালঘুদের প্রতি ক্ষিপ্ত হবে, এমন আশঙ্কা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক।
তবু আশাবাদী হতে ইচ্ছে করে। বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্মের প্রতি। তাদের সংহতির মধ্য দিয়েই অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটতে পারে। অনলাইন ব্যবহারকারীদের মধ্যে তরুণদের উপস্থিতি বেশি লক্ষণীয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মতামত জানানোর চেয়ে তাঁরাও অনেক সময় পরস্পরের ওপর দায় চাপানোর কাজেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কোনো দল, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী বা মাধ্যমকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে দায়ী করলে কোনো কোনো মহলের স্বার্থ হাসিল হয় বটে, কিন্তু সংখ্যালঘুদের সমস্যার সুরাহা হয় না; বরং তাদের যন্ত্রণা ও অপমানবোধ আরও বাড়ে, তীব্র হয়।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় প্রায় একই ধরনের নির্যাতনচিত্র। রাতের আঁধারে দলে দলে দুর্বৃত্তরা সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত অঞ্চলে হানা দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পুলিশ-প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছে কোথাও—এমন খবর আমরা খুব কমই পাই। বরং আমরা জানতে পারি, ঘটনার পর তদন্ত-তল্লাশি চালিয়ে অপরাধী কাউকেই সাধারণত খুঁজে পাওয়া যায় না। স্থানীয় অথচ ‘অচেনা’ দুর্বৃত্তরা কীভাবে যেন উধাও হয়ে যায়। আর সংখ্যালঘুরা সম্ভবত নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার আশঙ্কা থেকেই অপরাধীদের চিহ্নিত করা থেকে বিরত থাকে। কারণ, নিরাপত্তা বাহিনী চলে গেলেই যে আবার অধিকতর ভয়াবহ হামলা হবে না, সেই নিশ্চয়তা কোথায়? তা ছাড়া স্থানীয় দুর্বৃত্তদের প্রবল উপস্থিতি অস্বীকার করার উপায় কী? ঘটনার পরেও তো তাদের সঙ্গেই ওই এলাকায় থাকতে হবে সংখ্যালঘুদের।
তরুণ প্রজন্ম যদি রাজধানীর বাইরের বাস্তব পরিস্থিতি পরিপূর্ণভাবে অনুভব করে প্রতিবাদী ভূমিকা নেয় (এ ক্ষেত্রে গণজাগরণ মঞ্চের ভূমিকা প্রশংসনীয়), তাহলে সংখ্যালঘুরা আশাবাদী হবে। নির্বাচনী রাজনীতির ডামাডোলে ‘সংখ্যালঘু নিপীড়নের মৌসুম’ শেষ হলেই যেন বিষয়টি চাপা না পড়ে যায়। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রসঙ্গটি নির্দিষ্ট সময় পর পর গণমাধ্যম বা রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনার শীর্ষে আসে এবং কিছুদিন পরই আবার হারিয়ে যায়। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মনের মধ্যে ক্ষতটা রয়েই যায়।
পরিসংখ্যান বলে আর আমরাও নিজ চোখে দেখি—সংখ্যালঘুরা সংখ্যায়, শক্তিতে ক্রমেই আরও লঘু হচ্ছে। নিপীড়িতদের কতজন এ দেশ ছেড়ে গেছে, তার সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন। জীবিকার তাগিদে সংখ্যালঘু সম্প্র্রদায়ের যেসব মানুষ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে, তাদেরও অনেকের দেশত্যাগের কারণ খুঁজতে গেলে নিপীড়ন বা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। সামর্থ্যবানদের মধ্যে কেউ কেউ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করতে সন্তানদের বিদেশে পাঠানোর মতো বেদনাদায়ক ভাবনা শুরু করেছেন, এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। এ ধরনের প্রস্থান ঠেকাতে রাষ্ট্র যদি উদ্যোগী না হয়, তবে সেটা সত্যিই বড় হতাশার। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও তখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় এবং বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। আর দেশ-মাটি ছেড়ে চলে গিয়ে সেই মানুষেরা কতটুকু সুখী হতে পারে? নতুন অচেনা পরিবেশ-পরিস্থিতিতেও আসলে তো তারা সংখ্যালঘুই রয়ে যায়। বাড়তি পাওনা হিসেবে তাদের হূদয়ে যোগ হয় অনেক যন্ত্রণা আর ফেলে আসা স্মৃতির ভার।
হ্যাঁ, যেখানেই থাকি আমরা, বুকের মধ্যে জন্মভূমিটা ধারণ করি প্রতিনিয়ত। সংখ্যালঘুদের অনেকে দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়ে আবার নতুন করে দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হন। আর কেউ কেউ অর্জিত সুখ-স্বস্তির আবরণের বাইরে তীব্র এক মর্মবেদনাকে নিত্যসঙ্গী হিসেবে আবিষ্কার করেন। কিন্তু শত নিগ্রহ সহ্য করেও যাঁরা পূর্বপুরুষের ভিটামাটি আঁকড়ে পড়ে থাকেন, নিজভূমে পরবাসী হওয়াটা যেন তাঁদের নিয়তি। তাঁদের জন্য পরবাস খুব বেশি দূরে নয়, বরং বুকেরই ভেতরে লুকিয়ে থাকে।

আশিস আচার্য: সাংবাদিক।
[email protected]