আদালতকে চ্যালেঞ্জ মানে সংবিধানকেই চ্যালেঞ্জ করা

>সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া রায় নিয়ে নানা মহলে আলোচনা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রথম আলো গতকাল আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। আজ প্রকাশ করা হলো আওয়ামী লীগ সরকারের আরেক সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ও ষোড়শ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষের অন্যতম আইনজীবী মনজিল মোরসেদের সাক্ষাৎকার।
মনজিল মোরসেদ
মনজিল মোরসেদ

প্রথম আলো : সামগ্রিকভাবে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে কীভাবে দেখছেন?

মনজিল মোরসেদ : সংসদই জনগণ নয়। সংসদ হলো জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান। এখানে আইন প্রণয়ন ও পরিবর্তন করা হয়। অন্যদিকে বিচার বিভাগ হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে ১৬ কোটি মানুষ ন্যায়বিচারপ্রত্যাশী। ১৯৭২ সালে যে গণপরিষদে সংবিধান রচিত হয়েছিল, তার কাজ ছিল শুধু সংবিধান প্রণয়ন করা। কিন্তু এখনকার সাংসদেরা আইন প্রণয়নের বাইরে প্রশাসনিক অনেক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। সেসব কাজে কেউ নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত মনে করলে আদালতের দ্বারস্থ হন। এ অবস্থায় সংসদের কাছে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দিলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হবে। এ কারণেই রায়টিকে সময়ের দাবি বলে মনে করি।
প্রথম আলো : কিন্তু অনেকের মতে, এই রায়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে রাজনীতির বিষয়টি টেনে আনা হয়েছে?
মনজিল মোরসেদ : রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, ষোড়শ সংশোধনী বিচার বিভাগের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এই মামলার রায়ে অনেক রাজনৈতিক বিষয় এসেছে, যাতে আমাদের রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজনীতির চেতনার প্রতিফলন রয়েছে। আর তা–ও এসেছে অ্যাটর্নি জেনারেলের উত্থাপিত যুক্তির জবাবে। তিনি রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে স্বাধীনতার চেতনা, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ইত্যাদি প্রসঙ্গ এনেছিলেন। আমরাও আমাদের কথা বলেছি। অ্যামিকাস কিউরিরা তঁাদের যুক্তি উত্থাপন করেছেন। আদালতকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে হলে তো তাঁকে পাল্টা যুক্তি তুলে ধরতে হয়। এখানে আপিল বিভাগ সেটাই করেছেন। তবে আদালত কেবল রাজনীতিকদেরই সমালোচনা করেননি, হাইকোর্টের রায়ে যে সাংসদদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, রায়ে তারও সমালোচনা করা হয়েছে। আমার মতে, বিভাজন নয়, বিচার বিভাগ ও আইনসভার মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠাই এ রায়ের উদ্দেশ্য।
প্রথম আলো : আপনারা রিট আবেদনের সময় কি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের কথা মাথায় রেখেছেন?
মনজিল মোরসেদ : বর্তমানে কোন ধরনের সংসদ আছে, সেটি মোটেই বিবেচ্য ছিল না। আমাদের বিবেচনা ছিল বিচার বিভাগের স্বাধীন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। এই সংশোধনী দশম না হয়ে নবম বা অষ্টম সংসদে হলেও একইভাবে আমরা চ্যালেঞ্জ করতাম।
প্রথম আলো : সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করার রায়কে আওয়ামী লীগ স্বাগত জানিয়েছিল। আর এখন ষোড়শ সংশোধনী বাতিলকে বিএনপি অভিনন্দিত করছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
মনজিল মোরসেদ : এটাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। যখন যে রায় যাঁদের পক্ষে যায়, তাঁরা উল্লাস প্রকাশ করেন আর বিপক্ষে গেলে ক্ষুব্ধ হন। আমরা দেখেছি, পঞ্চম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের সময় বিএনপি আদালতের কঠোর সমালোচনা করেছে। তারা প্রধান বিচারপতিকে আক্রমণ করে কথা বলেছে। এবারও ক্ষমতাসীন দল সংসদে অনেক কঠোর কথা বলেছে। আদালতের দায়িত্ব আইনের বিচার-বিশ্লেষণ করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া। এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক সমীচীন নয়। মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র এখনো আমাদের দেশে সুসংহত হয়নি। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুদৃঢ় হয়নি, এটাই আদালতের রায়ে এসেছে। আদালত সামরিক শাসনকে কালো অধ্যায় হিসেবে অভিহিত করেছেন। আমাদের ইতিহাসে অনেক কালো অধ্যায় আছে। তার মধ্যে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা জঘন্যতম কালো অধ্যায়।
আরেকটি কথা, এই মামলার রায়েই যে শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য এসেছে, তা কিন্তু ঠিক নয়। মুন সিনেমা হলের মামলায় তো গোটা সামরিক শাসনকেই অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই রায়ের প্রধান যুক্তি ছিল, যে আইনবলে প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করেছে, সেটি সংবিধানবহির্ভূত। এর আগে বিচার বিভাগ থেকে সামরিক শাসনকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে যেসব রায় দেওয়া হয়েছিল, তারও সমালোচনা রয়েছে এই রায়ে। কেউ অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখল করলে তাঁর শাস্তিরও বিধান রয়েছে সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদে।
প্রথম আলো : আদালত বলছেন, বিচার বিভাগই অপেক্ষাকৃত স্বাধীন। কিন্তু তারাও ডুবতে বসেছে।
মনজিল মোরসেদ : বিচার বিভাগ স্বাধীন, এ কথা যেমন সত্য, তেমনি বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের টানাপোড়েন রয়েছে, তা–ও অসত্য নয়। নিম্ন আদালতের শৃঙ্খলাবিধি কার্যকর করা হয়নি। বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ বা আইনসভার মধ্যে যে অবিশ্বাস, সেটি দূর করা প্রয়োজন। সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগ নিজ নিজ গণ্ডির মধ্যে থেকে কাজ করবে। প্রত্যেকের কাজের জবাবদিহি থাকবে। পঞ্চম সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধি প্রণয়নের কথা বলা হলেও তা কখনো কার্যকর হয়নি।
প্রথম আলো : নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার ওপর বিচার বিভাগ নজরদারি করছে। কিন্তু বিচার বিভাগের ওপর কি নজরদারির প্রয়োজন নেই?
মনজিল মোরসেদ : অবশ্যই আছে। কেউ জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নন। মাননীয় আদালত রায়ে যে ৩৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন, তাতে বিচার বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। বিচারকেরা কী করতে পারবেন, কী পারবেন না, তারও স্পষ্ট নির্দেশনা আছে। তবে আমি মনে করি, এটিও পরিপূর্ণ নয়। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ বা আইনসভা—প্রত্যেকের জবাবদিহি থাকা প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি বা সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টি কিন্তু আদালতের নির্দেশনায় এসেছিল।
প্রথম আলো : অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, আদালত আইন বা সংবিধানের সংশোধনী বাতিল করতে পারেন, কিন্তু প্রতিস্থাপন করতে পারেন না।
মনজিল মোরসেদ : অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য বিভ্রান্তিমূলক। কোনো সংশোধনী বা আইন বাতিল হলে সংবিধানে তার আগে যে ব্যবস্থা ছিল, সেটিই প্রতিষ্ঠিত বলে ধরে নিতে হবে। অষ্টম সংশোধনী মামলায়ও আইন বাতিলের পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া হয়েছে। আরেকটি উদাহরণ দিই, ধরুন আপনার একটি কলম অন্য কেউ নিয়ে গেল। আপনি আদালতে প্রতিকার চাইলেন। আদালতে ওই কলম নেওয়াকে অবৈধ ঘোষণা করার অর্থ কলমের মালিকানা আপনাকে ফিরিয়ে দেওয়া।
প্রথম আলো : সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এর ফলে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের বিরোধ বাড়বে না কমবে?
মনজিল মোরসেদ : যেকোনো রায়কে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুভাবেই দেখা যায়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজ যদি এই রায় নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি করতে চায়, সেটি তারা করতে পারে। কিন্তু সেটি কারও জন্য মঙ্গলজনক হবে না। আর যদি তারা রায়ের ভালো দিক, যেমন সুশাসন, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের পক্ষে যে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে, সেগুলো সামনে নিয়ে আসে, সেটি সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে। বিচার বিভাগ ও আইনসভা বা নির্বাহী বিভাগ নিজ নিজ গণ্ডিতে থেকে কাজ করবে, কেউ কারও প্রতি আক্রমণাত্মক হবে না, এটাই প্রত্যাশিত। আদালতের রায়ে যেসব নির্দেশনা আছে, সেটি সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমলে নিতে হবে।
প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে বলব, সরকারের ভেতরেও তো নানা গ্রুপ থাকে। দলের কেউ কেউ উসকানি দিতে পারেন। বিশেষ করে, যাঁরা পদ–পদবি পাননি বলে মনে করেন। মহাজোটের শরিকদেরও অনেকে নিজের গুরুত্ব বাড়াতে আক্রমণাত্মক কথা বলতে পারেন। তবে আমরা আশা করি, বিচার বিভাগের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে এমন কোনো সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নেবেন না। বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেন আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল। তাঁদের কাছেও ইতিবাচক পদক্ষেপ প্রত্যাশিত। আমাদের মনে রাখতে হবে, সর্বোচ্চ আদালত হচ্ছে সংবিধানের অভিভাবক। আদালতকে চ্যালেঞ্জ মানে সংবিধানকেই চ্যালেঞ্জ করা।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
মনজিল মোরসেদ : ধন্যবাদ।