ফেলানী থেকে লাইলী: অবহেলিত উত্তরের আরেক শহীদ

লাইলীর মৃত্যু সংবাদে বিক্ষুব্ধ লোকজন গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। ছবি: প্রথম আলো
লাইলীর মৃত্যু সংবাদে বিক্ষুব্ধ লোকজন গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। ছবি: প্রথম আলো

১.

ফেলানী ও লাইলী—দুজনের বাড়িই পাশাপাশি গ্রামে, কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলায়। একজন গুলিতে মরে কাঁটাতারে ঝুলে থাকেন, আরেকজনের মৃত্যু হয় দেশের রাজধানীর বনশ্রীর এক বাড়িতে। লাইলী মারা গেছেন উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে ঢাকায় এসে গৃহকর্মীর কাজে থাকা অবস্থায়। ঘরে অপেক্ষারত চার ও ছয় বছর বয়সী দুটি মাসুম সন্তান। স্বামী নজরুল ইসলাম ভারতের জেলে বন্দী। লাইলী ছিলেন ভারতীয় ছিটমহল দাশিয়ারছড়ার বাসিন্দা। ২০১৩ সালেও সেখানেই ছিলেন স্বামী নজরুল ইসলামসহ। কিন্তু ছিটমহল বিনিময়ের পর দোটানায় পড়ে যান নজরুল ইসলাম। সন্তানসহ লাইলীকে পাঠিয়ে দেন বাংলাদেশ অংশে; নিজে থেকে যান ভারতীয় অংশে। ভারতের নাগরিক হিসেবে ভারতীয় ভূখণ্ডেই থেকে যাবেন, নাকি সদ্য স্বাধীন দাশিয়ারছড়ায় আসবেন—এ সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়ে যায় তাঁর। কর্মসংস্থান আর রাষ্ট্র পছন্দ করে উঠতে উঠতে যখন সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন দাশিয়ারছড়া হয়ে গেছে বাংলাদেশ। সেখানে ফিরতে গিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ভারতের জেলে আছেন লাইলীর স্বামী নজরুল ইসলাম। জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম জেল খেটেছেন পরাধীনতা থেকে মুক্তির লড়াইয়ে। আর লাইলীর স্বামী নজরুল ইসলাম জেল খাটছেন দেশভাগের জেরে। নজরুল ইসলাম যদি জেলে না থাকতেন, তাহলে হয়তো লাইলীকে গৃহকর্মীর কাজের খোঁজে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে ঢাকায় আসতে হতো না।

তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের জেলখানার চিঠির মতো তাই স্বামী লিখে পাঠাননি, ‘ভুলে যেয়ো না/ স্বামী যার জেলখানায়/ তার মনে যেন সব সময় ফুর্তি থাকে’। বরং তাঁর মাথা ঠিকই ব্যথায় টনটন করেছে, দিশেহারা হয়েছে হৃদয়—যে খবর জানতেন বস্তির প্রতিবেশী এবং তাঁর গ্রাম অধুনালুপ্ত ছিটমহলের মা-খালারা। তাই বোঁটা থেকে ফুলের মতো যখন ঝরে গেলেন, তখন তাঁর দুঃখের কথা যাঁরা জানতেন, সেই হিন্দু বস্তির লোকজন দিনরাত রাস্তায় থেকেছেন, পুলিশকে বাধ্য করেছেন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে। গতকাল শনিবার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লাইলীর গলা ও মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

২.
স্পেকট্রাম, তাজরীন ও রানা প্লাজা হয়ে বাসা-বাড়ি পর্যন্ত শ্রমিকের জীবন যখন ঝুঁকিপূর্ণ ও সস্তা হয়ে উঠেছে, তখন কোথাকার কোন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর এক অসহায় নারীর জন্য বস্তিবাসীর যে দিনভর রাস্তার লড়াই, তা আগামী দিনের সামাজিক সংঘাতের নতুন ক্ষেত্রের ইশারা দেয়। শহর মানেই মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা নয়। যেমন শনিবার লাইলী হত্যার প্রতিবাদে ফুলবাড়ীতে মানববন্ধন হয়েছে এবং স্কুল-কলেজে কালো পতাকা মিছিল ঘোষিত হয়েছে; এটা স্বাভাবিক।

লাইলীর গ্রামের তরুণ বেলাল হোসেন জানিয়েছেন, লাইলীকে সাত মাস ধরে মজুরি দেওয়া হয়নি, মজুরি চাইতে গেলেই নির্যাতন করা হতো। এই লাইলী ও ফেলানীরা চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে না পেরে গলিত স্থবির ব্যাঙের মতো আরেকটি প্রভাতের ইশারায় মুখ বুজে কাজ করে যান। প্রশ্ন হলো, যাঁরা গুলিতে-আগুনে-ভবনধসে মরেন, মরেন অবিচারে, তার বড় অংশটাই কেন উত্তরবঙ্গের মানুষ? শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান কেন উত্তরবঙ্গের মানুষের তরে নয়? ভাতের দেশের মানুষেরাই কেন ভাত-ভাত করে মরেন—এই প্রশ্নগুলোর জবাব দরকার।

২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি ‘বন্দর নগরী কুড়িগ্রাম জেলায় মঙ্গা কেন?’ শিরোনামে একটি ক্যালেন্ডারে দেখিয়েছে: অন্যান্য জেলার অনুপাতে কুড়িগ্রাম জেলায় মাথাপিছু আয় ১১৯০ ডলার বনাম ৮২৮ ডলার; দারিদ্র্যের হার অন্য জায়গায় যেখানে ৩০.৭ সেখানে কুড়িগ্রামে ৬৩.৭%। কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণের হার সারা দেশে ১৭.৫%, কুড়িগ্রামে ৩৮.৭%। মাছ গ্রহণের মাথাপিছু হার ১২ কেজি বনাম ৭.৫ কেজি। সাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশ বনাম ৩৬.৯৯। প্রবাসী শ্রমিক (২০০৪-২০১৪) অন্যান্য জেলার গড় ৭৮,৭১১ জন আর কুড়িগ্রামে ৯২৪৩ জন। বৈষম্যের কারণ হিসেবে দেখা গেছে, অন্যান্য জেলা ও কুড়িগ্রামের বড় ও মাঝারি শিল্পের (২০০০-২০০১ সাল পর্যন্ত) অনুপাত ৩৮৭টি: ১০টি। গার্মেন্টস কারখানা (২০১৫ সালের হিসাবে) ৮৬টি: ১টি; পাটকল ২.১টি: ১টি আর মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মিলে অন্যান্য জেলায় যেখানে গড়ে ২.১টি, সেখানে কুড়িগ্রামে একটিও নেই। সেই জেলা থেকে মানুষ কাজের সন্ধানে, মৃত্যুকে মুঠোয় নিয়ে দিগ্‌বিদিক ছুটবে—এটাই স্বাভাবিক। ফেলানী ও লাইলীদের জন্ম ও পরিণতি এক না হয়ে উপায় কী?

লাইলী হত্যার প্রতিবাদ আসলে এই বৈষম্যমূলক উন্নয়ননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আশা রাখি, কবি নাজিম হিকমতের মতো আমরাও বলতে পারব, ‘দুঃসময় থেকে সুসময়ে/ মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে/ আমাদের ছেলেটা নিরাময় হয়ে উঠবে/ তার বাপ খালাস পাবে জেল থেকে’।

লাইলী হত্যার বিচার হোক, তাঁর রেখে যাওয়া দুই শিশুর বাবা স্বামী নজরুল ইসলামও জেল থেকে মুক্তি পাক!

নাহিদ হাসান: প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।