চলো, একহাত দেখিয়ে দিই

একহাত দেখিয়ে দিতে হাত লাগে না; তবু বলা হয়, ‘একহাত দেখিয়ে দেওয়া’। কমবেশি আমাদের সবারই পছন্দের কাজ এটা।

রোজ কতজনকে কতজন সুযোগ মেলামাত্রই একহাত দেখিয়ে দিচ্ছে। বহুকাল ধরে মানুষ এই স্বভাব সযত্নে লালন করে চলেছে। বহুকাল ধরে এই বিনোদন রসিয়ে উপভোগ করে সব পদের মানুষ।

এ এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অমুক তমুকের সঙ্গে হেসে কথা বলল না, একহাত দেখিয়ে দেওয়ার খায়েশ জেগে উঠবে মনে। দেখিয়ে দেওয়াদেওয়ি ছাড়া যেন মানবজনম সার্থক হয় না। ছোট থেকে মাঝারি বা অতি বড় আকারের দেখিয়ে দেওয়ার ঘটনা চারপাশে অগণিত। দেখিয়ে দেওয়ার বাসনা কতজনকে অবহেলা অসম্মান, কত মানুষের নানা ধরনের ক্ষতির ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। দেখিয়ে দিতে গিয়ে হামলা-মামলা সবই হয়, হচ্ছে। শুধু একহাত দেখিয়ে দেওয়ার বাসনায় ভাই ভাইকে জেলের ভাত খাওয়ায়। এমন নজির কম নেই। এমন কাণ্ডে যথেষ্ট পরিমাণ পকেটের পয়সাও গচ্চা যায়, কিন্তু তাতে অস্বস্তি, অসন্তুষ্টি বা দুঃখ থাকে না। একহাত দেখিয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়, সেটাই মহা আনন্দের।

গ্রামে এক বাসায় ঘটা করে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। সেই বাড়ির শুভ আয়োজনকে দেখিয়ে দিতে দুই বাড়ির পরের বাড়ির উঠানে শামিয়ানা টানিয়ে মাইক বাজিয়ে বন্ধুবান্ধব খাওয়ানো হয়। বাজারে চায়ের দোকানে একজনের সঙ্গে তর্কাতর্কি হয়েছে, সেই জের গড়ায় পুকুর, মাছ পর্যন্ত। বিষক্রিয়ায় পুকুরের সব মাছ মরে পানিতে ভাসে। এমন হিংস্রতাও একহাত দেখিয়ে দেওয়া।
গ্রাম্য ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। শহরেও তার অস্তিত্ব প্রবল। অফিসে হঠাৎ বদলির আদেশ, কারও নামে ব্যাংক লোন অনুমোদন পেতে পেতে পায়নি, কারও কারও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আচমকা টানাপোড়েন—এসবের কারণ খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে অন্য পক্ষের একহাত দেখিয়ে দেওয়া।  

উপকারের জন্য কাছের মানুষকে টাকা ধার দেওয়া হয়েছিল, ফেরত পাওয়ার নামগন্ধ নেই। নিজের জরুরি দরকারে উপায়হীন হয়ে সেই ধার শোধের কথা মনে করিয়ে দিলে সে কাছের জন একহাত দেখিয়ে দিয়ে দূরের হয়ে যায়। চোখে অন্ধকার দেখার কথা। রাস্তায় নেমে চোখে পড়ে রিকশাওয়ালা পায়ের ওপর পা তুলে ধূমপান করছে; মনে হবে, সেও একহাত দেখিয়ে দিচ্ছে। ধমকাতে ইচ্ছা হবে। যাতনা কমাতে একহাত দেখিয়ে দেওয়া হয়ে যায় তাকেও।রিকশাওয়ালা, বাস, ট্রাক, ট্যাক্সিচালক—কেউই সুযোগ পেলে ছাড়ে না। পথের মানুষ পথের মানুষকে দেখিয়ে দেয়। দেখায় ফেরিওয়ালা, দোকানি। ক্রেতাও দেখিয়ে দেবে বলে সদা প্রস্তুত থাকে। রাস্তাঘাটে ভিড়ভাট্টায় পকেটমার, ছিনতাইকারী দেখিয়ে দিচ্ছে নিত্য। রাগ করে, ক্ষোভ জমিয়ে থানায় গেলে সেখানেও তা অদৃশ্য নয়। যিনি বাড়িওয়ালা, তিনি ভাড়াটেকে একহাত দেখিয়ে দিচ্ছেন প্রায়ই। ভাড়াটে যিনি, সুযোগ মিললে তিনিও দেখিয়ে দিয়ে সুখ লাভ করেন। যাঁর যাঁর যোগ্যতা প্রমাণের জন্য একহাত দেখিয়ে দেওয়া চলছে দিকে দিকে। চলবে সগৌরবে, মহাসমারোহে।

কোনো মানুষই এই প্রবণতামুক্ত নয় বলে মনে হয়। অস্বাভাবিক হলেও সবাই তা কমবেশি অনুশীলন করেন। নিত্য চর্চার বিষয় বলে সবারই তা গা-সওয়া হয়ে গেছে। ভেবে দেখা হয় না, এই প্রবণতায় আত্মতৃপ্তি মেলে, কিন্তু তা অসম্মানজনক। নিজ সামর্থ্যের অপব্যবহার, অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করা, এতটা ভেবে সময় নষ্ট করে না কেউ। এই প্রবণতা ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু যেভাবে দিনে দিনে জোয়ারের জলের মতো বেড়ে চলেছে, তা শঙ্কার কারণ। মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, এই চর্চা, অনুশীলন হতাশা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা। ভুল চেষ্টা। মানুষের সক্ষমতা যতটা না আনন্দ দান করে, তার চেয়ে বেশি পীড়িত করে অক্ষমতা। সে অক্ষমতাকে অস্বীকারের একটা উপায় অন্যের ওপর চড়াও হওয়া। মানুষ যত বেশি আশাহত হবে, যত অধিকারবঞ্চিত হবে, পাল্লা দিয়ে মনে মনে জমতে থাকে ক্ষোভ। সেই ক্ষোভের ঠেলা স্বস্তি দেয় না, শান্তি দেয় না। অস্তিত্বের সংকটে পড়ে নিজেকে জাহির করতে চায় মানুষ। জাহিরে মেলে সান্ত্বনা, স্বস্তি।

 ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ বিখ্যাত একটা গানের প্রথম লাইন। কোনো গান বিখ্যাত হয়, কথা ও সুরে মন যখন সাড়া দেয়। মানুষ পছন্দ করে সেটাই, যা আত্মার কাছাকাছি বলে মনে হয়। শুধু গান নয়; কবিতা, গল্প, উপন্যাস, আলোচনা যা কিছু নিজের মনমতো হয়, তা-ই আলাদা করে মানুষের প্রিয় হয়ে ওঠে। তার মানে সহজ সরল কথা দাঁড়াল, যা ভালো সেই ভালোয় মানুষ মুগ্ধ হয়। সত্য এটা হলেও জীবন কৌতুকময়। মানুষ যা যা শুনতে ভালোবাসে, দেখতে, বলতে, জানতে ভালোবাসে, তার সবই জীবনে অনুশীলন করা প্রয়োজন মনে করে, তেমন নয়। তেমন হলে এমন গান লেখা হতো না। গানের মধ্যে বলার দরকার পড়ত না ‘একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?’ কৌতুক হচ্ছে, যাঁরা সহানুভূতিহীন তাঁদের মনেও এই গান আবেদন জাগায়। ‘মানুষ মানুষের জন্য’—এ কথা উচিত মনে হলেও নিজকর্মে মানুষ আগে দেখে নিজস্বার্থ। তাতে মানবচরিত্রের আর মানুষের জন্য হয়ে ওঠা হয় না।

একহাত দেখিয়ে দিতে চায় না—এমন মানুষ সত্যিই দুর্লভ। নিজ নিজ অভিজ্ঞতার খাতা খুললে সবাই নিশ্চিত হবে, কথা মনগড়া নয়। যে প্রতিষ্ঠানে মানুষের সেবা-সহযোগিতা পাওয়ার কথা, সেই প্রতিষ্ঠান কি কর্তব্য পালনের বদলে একহাত দেখিয়ে দেয় না? ছোট্ট আসন থেকে সবচেয়ে বড় আসনে বসা মানুষটি পর্যন্ত—রেহাই মেলে না কারও হাত থেকে কারোরই। রোজ কখনো না কখনো, কেউ না কেউ একে অন্যকে একহাত দেখিয়ে দিচ্ছে। ক্ষমতাবানেরা সাধারণদের, টাকাওয়ালারা টাকাওয়ালা এবং অভাবীদের কায়দা বদল করে দেখিয়ে দেয়। ভদ্র, শিক্ষিত মানুষেরা ভদ্র ও শিক্ষিত কায়দায় একহাত দেখিয়ে দিতে পছন্দ করে। দায়িত্ববান পরিচয়ের যারা, তারা দায়িত্বের সঙ্গেই নিত্যনতুনভাবে একহাত দেখিয়ে দিচ্ছে। ড্রাইভার, গৃহকর্মী, দারোয়ান, মালি—এসব পরিচয়ের মানুষকে যে মাপের, যেভাবেই দেখা হোক, সবাই একহাত দেখিয়ে দেওয়ার যোগ্যতায় যথেষ্ট বড়।

প্রায় সবাই বয়ে বেড়াচ্ছে শত্রুভাবাপন্ন মন। শিক্ষক ছাত্রকে, ছাত্র শিক্ষককে, নারী-পুরুষ, বড়-ছোট উভয় উভয়কে একহাত দেখিয়ে দেওয়ার মহাযজ্ঞে সর্বদা শামিল। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী সব সম্পর্কে রুটির সঙ্গে মাখনের মতো এই প্রবণতা লেপ্টে আছে। বাজারে গেলে এক ক্রেতা অন্য ক্রেতাকে একহাত দেখিয়ে দেয়। অহরহ দেখিয়ে দিয়ে থাকে মাছওয়ালা, সবজিওয়ালা, এমনকি বাজারের কুলিও। মুদি দোকান দেখিয়ে দেয়, শাড়ি গয়না, ওষুধের দোকান, দোকানি, বিক্রয়কর্মী কারও হাত থাকে রেহাই নেই। রাস্তায় যে সবজি বেচে, যে হেঁকে হেঁকে মোরগ– মুরগি ফেরি করে, পুরোনো শিশি-বোতল-কাগজ কিনে বেড়ানো মানুষেরাও একহাত দেখিয়ে দেওয়ার সাধ্য রাখে। প্রকৌশলী, সাংবাদিক, আইনবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, শিল্পী, সাহিত্যিক সব পরিচয়ের মানুষদের মধ্যে সেই সক্ষমতা বিপুলভাবে বহাল। একহাত দেখিয়ে দেওয়ার অনুশীলন প্রকাশ্যে ও অলক্ষ্যে চলছেই। তা দোষের, নিন্দনীয়, লজ্জার বিবেচনা করে না কেউ। তা অসুস্থতা, অসভ্যতা, হীনম্মন্যতা, অতটা বিশেষ করে ভাবা হয় না।

সময়ের ফেরে পড়ে একহাত দেখিয়ে দেওয়ার স্বভাব বৃষ্টিও আয়ত্ত করেছে। বৃষ্টি নেমে এবং না নেমে আমাদের একহাত দেখিয়ে দেয়। কয়েক দিন আগ পর্যন্ত না নেমে দেখিয়েছে, এখন নেমে, ডুবিয়ে দেখাচ্ছে। শুধু বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে নাকাল হয়ে রেহাই মেলে না। ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’র মতো দায়িত্বশীলেরাও এর-তার ওপর দোষ চাপিয়ে বেচারা জনগণকে একহাত দেখিয়ে দিচ্ছে। বৃষ্টির আগে দুষ্টু মশকেরা চিকুনগুনিয়া দিয়ে মানুষকে একহাত দেখিয়েছে। আক্রান্ত মানুষেরা বোনাস হিসেবে সহানুভূতির বদলে কথার কামড় খেয়েছে। যারা নিজেদের সমালোচনার ঊর্ধ্বে বিবেচনা করেন, তাঁরা মনের মাধুরী মিশিয়ে যখন ইচ্ছা তখন, যেমনভাবে ইচ্ছা তেমনভাবেই একহাত দেখিয়ে দিতে পারেন। অসীম আনন্দদায়ক বলে অক্লান্তভাবে অহরহ সেই দেখানো চলে, চলছেই। হজমশক্তি বাড়াতে হয়েছে মানুষদের, বহু একহাত দেখিয়ে দেওয়া গায়ে মাখে না মানুষ। মাখলে ক্ষতির ওপর বাড়তি ক্ষতি বলে হতাশ হয় না, দীর্ঘশ্বাসও ফেলে না।

‘মানুষ মানুষের জন্য’—এই গান আমরা সুরে ও বেসুরে গাইব। তা মিথ্যা আনন্দ দান করে থাকে। মিথ্যা আনন্দ। সত্য আনন্দ প্রাপ্তির জন্য সত্য, সুন্দরের চর্চা দরকার। তা জানে সবাই, মানতে নারাজ। একহাত দেখিয়ে দেওয়ার খায়েশ মনে মনে পুষে সভ্য চেহারা ঠিক রাখা সম্ভব। সেই সংস্কৃতিতে সবাই দোষহীন, সুন্দর। মনে এক আর বাইরে অন্য—এ চরিত্র, এমন দর্শন ঠাট্টার মতো। গাছের গোড়া কেটে পানি ঢালা যেমন। কৌতুককর, আবার তা কৌতুকও নয়। অজ্ঞানতার নির্মমতা, বেদনাদায়কও।

আমিত্বের বড়াই জনে জনে আছে। নিজের মধ্যে যে অমিত শক্তি রয়েছে, তাকে জাগিয়ে তুলতে পারলে আমিত্ব দোষহীন হয়। অন্যের দিক থেকে মন ঘুরিয়ে নিজেকে নিজেও একহাত দেখিয়ে দেওয়া যায়। দেখিয়ে দেওয়া যায় ‘কয়লা ধুলে ময়লা যায় না’ সত্যি, কিন্তু মানুষ চাইলে নিজেকে বদলাতে পারে। তেমন চেষ্টায় বাহাদুরি আছে এবং তা জন্ম দিতে পারে নানান অসাধারণত্বের। সেই বিশ্বাস, ইচ্ছা আর চেষ্টাতেই মানুষের কল্যাণ, মানুষ নামের সার্থকতা। সেই মহৎ চেষ্টায় অকল্যাণ, লোকসান বন্ধ হতো, আমরা আরও আরও লাভের মুখ দেখতে পারতাম। তেমন অসাধারণত্বের আগ্রহ যদি মনে মনে থাকে, পুরোনো মন্দ অভ্যাস নর্দমায় ফেলে দিয়ে পণ করা যায়—চলো, একহাত দেখিয়ে দিই নিজেকে, নিজেদের। মানুষের পক্ষে অসম্ভব কিছু নেই।

আফজাল হোসেন: অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, লেখক, নির্দেশক।