সিদ্দিকুরের চোখ ও আক্রমণাত্মক পুলিশ

শাহবাগে গত ২১ জুলাই শিক্ষার্থীদের মিছিলে এভাবে পুলিশ খুব কাছ থেকে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করলে সিদ্দিকুরের চোখে আঘাত লাগে।
শাহবাগে গত ২১ জুলাই শিক্ষার্থীদের মিছিলে এভাবে পুলিশ খুব কাছ থেকে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করলে সিদ্দিকুরের চোখে আঘাত লাগে।

সিদ্দিকুর রহমানের কথা আপনাদের মনে আছে? যে সিদ্দিকুর গত ২১ জুলাই পরীক্ষার দাবিতে সতীর্থদের সঙ্গে শাহবাগে গিয়েছিলেন সমাবেশ করতে। সেই সমাবেশে বিনা উসকানিতে পুলিশ খুব কাছ থেকে টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করলে সঙ্গে সঙ্গে সিদ্দিকুর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁর চোখ দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। এরপর ঢাকায় তাঁর দুই চোখে অস্ত্রোপচার করা হলেও তাতে সুফল মেলেনি।

তখন সিদ্দিকুরকে নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় চলছিল। পুলিশের বড় কর্তারা তাঁকে দেখতে গেলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সান্ত্বনা দিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, সিদ্দিকুরকে চাকরি দেবেন। সরকারি খরচেই চিকিৎসার জন্য তাঁকে ভারতের চেন্নাইয়ে শংকর নেত্রালয়ে পাঠানো হলো।

সেখানে প্রথমে চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, সিদ্দিকুরের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ডান চোখে তিনি কখনো দেখতে পাবেন না। বাঁ চোখে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা ১ শতাংশ। তারপরও সেখানে তাঁর বাঁ চোখে দ্বিতীয় দফা অস্ত্রোপচার হলো। গত শুক্রবার সিদ্দিকুরের অস্ত্রোপচার শেষে গত শনিবার তাঁর চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হয়। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক জাহিদ আহসানের বরাত দিয়ে সিদ্দিকুরের বন্ধু ও সহপাঠী শেখ ফরিদ জানান, অস্ত্রোপচারের পর সিদ্দিকুর চোখের এক পাশ থেকে আলোর উপস্থিতি টের পাচ্ছেন। তিনি কতটুকু দেখবেন বা আদৌ দেখবেন কি না, তা জানতে আরও চার থেকে ছয় সপ্তাহ সময় লাগবে।

আমাদের কায়মনো প্রার্থনা, সিদ্দিকুরের দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসুক। তিনি আবার পৃথিবীর আলো দেখতে পাবেন। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবেন। দরিদ্র মা-ভাইয়ের কষ্ট লাঘব করবেন।

কিন্তু যে কারণে সিদ্দিকুর ও তাঁর সতীর্থরা রাজপথে নেমেছিলেন, সেই কারণ দূর হয়নি। সাত সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার তারিখ পাননি। এ নিয়ে জাতীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ বাগ্‌যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান না করে তারা বোবা ও কালার ভূমিকায় অভিনয় করছে।

‘সিদ্দিকুরের চোখে টিয়ার শেল : তদন্তে সাত পুলিশ অভিযুক্ত’ শিরোনামে সহকর্মী নজরুল ইসলাম প্রথম আলোয় যে রিপোর্ট করেছেন, তাতে সেদিনের ঘটনার প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে এসেছে। যদিও পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনার দায় ছাত্রদের ওপরই চাপানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, ছাত্রদের ছোড়া ফুলের টবের আঘাতে সিদ্দিকুরের চোখ জখম হয়েছে। দাবিটি যে হাস্যকর ছিল, তা বেরিয়ে এসেছে পুলিশের তদন্ত রিপোর্টেই।

প্রথম আলোর খবরে আরও বলা হয়, খুব কাছ থেকে ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল সিদ্দিকুর রহমানের চোখে লাগে বলে তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশের সাত সদস্যের সম্পৃক্ততা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান যুগ্ম কমিশনার (অভিযান) মীর রেজাউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে দায়িত্বরত থানার পুলিশ ও দাঙ্গা দমন বিভাগের পুলিশ সদস্যদের কর্তব্যে অবহেলা পাওয়া গেছে। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা হলেন শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু জাফর আলী বিশ্বাস ও পরিদর্শক (অভিযান) আবুল কালাম আজাদ। এ ছাড়া দাঙ্গা দমন বিভাগের (পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট—পিওএম) পাঁচ কনস্টেবলের নামও আছে।

কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, ‘কর্তব্যরত (পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট-পিওএম) দাঙ্গা দমন বিভাগের পাঁচ কনস্টেবল ছিলেন আক্রমণাত্মক। তাঁরা হঠাৎ করেই শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হন। তাঁদের একজন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি খুব কাছ থেকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়েন। এতে শেল তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমানের চোখে লাগলে তিনি রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। ঘটনাস্থলের কাছে শাহবাগ থানার পরিদর্শক মো. আবু জাফর আলী বিশ্বাস ও পরিদর্শক (অভিযান) আবুল কালাম আজাদ থাকলেও তাঁরা পুলিশ সদস্যদের নিবৃত্ত করেননি। এমনকি তাঁরা পুলিশ সদস্যদের সঠিক নির্দেশনাও দেননি। পুলিশ সদস্যরা অপেশাদারসুলভ আচরণ করেন।...কমিটি তদন্তে জানতে পারে, খুব কাছ থেকে সিদ্দিকুরের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া হয়েছিল। তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের পর পর্যালোচনা করে কমিটি দেখেছে যে এই কাঁদানে গ্যাসের উপকরণ চোখের জন্য ক্ষতিকারক ছিল।’

আইনশৃঙ্খলা তথা জনগণের জানমাল সুরক্ষা পুলিশের দায়িত্ব। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশের ভূমিকা হয়ে পড়ে বিপরীত।

তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। কিন্তু কী শাস্তি দেওয়া হবে? দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া? অন্য কোনোখানে বদলি? পদোন্নতি আটকে দেওয়া? কিংবা পুলিশ বাহিনীতে কাজ করার অযোগ্য বিবেচনা করে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া?

কিন্তু কোনো শাস্তিই সিদ্দিকুরের ক্ষতি পূরণ করতে পারবে না। তিনি এক চোখে দেখতে পাবেন না, চিকিৎসকেরা আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। আরেক চোখে দেখবেন কি না, সেটি জানতে আমাদের আরও কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।

কিন্তু রাষ্ট্র কি এই নিশ্চয়তা দিতে পারবেন যে পুলিশ আর কখনো আক্রমণাত্মক হবে না? আর কাউকে এভাবে চোখ হারাতে হবে না? তারা কি নিশ্চয়তা দিতে পারবে, মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সভাসমাবেশ করতে পারবে? তাদের মত প্রকাশ করতে পারবে?

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।

আরও পড়ুন...