অকারণ মৃত্যু বিশ্বজিতের

বিশ্বজিতের বাবা সঠিক বিচার না পাওয়ার আশঙ্কার কথা আগেই বলেছিলেন
বিশ্বজিতের বাবা সঠিক বিচার না পাওয়ার আশঙ্কার কথা আগেই বলেছিলেন

বিশ্বজিৎ তার বাড়ির ভেতরে খুন হয়নি। তাহলে বলা যেত, খুনি কে পুলিশ তা বুঝতেই পারছে না। বিশ্বজিৎ গুম হলে বলা যেত সে পালিয়ে আছে ইচ্ছে করে। বিশ্বজিতের নামটি মুসলিম  হলেবলা যেত সে জামায়াত-শিবির বা জঙ্গি। বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডের ছবি বা ভিডিও না থাকলে বলা যেত তাকে বিএনপি-জামায়াতই হত্যা করেছে।

কিন্তু বিশ্বজিৎকে খুন করা হয়েছিল রাজপথে, দিবালোকে। সাংবাদিক, মানুষ আর ক্যামেরার সামনে। তাকে হত্যা করা হয়েছিল নৃশংসভাবে, রড, কিরিচ ও দা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে। বিশ্বজিৎ কোনো অপরাধী ছিল না, তার হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না, হামলা প্রতিরোধের চেষ্টা করার শক্তিও তার ছিল না। সেটি হলেও হয়তো বলা যেত বিশ্বজিৎকে কোপানো হয়েছে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে!

বিশ্বজিতের ক্ষেত্রে এসব কিছুই হয়নি। নির্বিরোধী একজন পোশাককর্মী ছিল সে। ২০১২ সালে বিএনপির কর্মসূচি চলাকালে ককটেল বিস্ফোরণ হলে ভয়ে সে পালিয়ে একটি ক্লিনিকের দোতলায় আশ্রয় নিয়েছিল। বিরোধী দলের কর্মী সন্দেহে ছাত্রলীগের কর্মীরা সেখানে গিয়ে তাকে কোপানো শুরু করে। প্রাণ বাঁচাতে রাস্তায় দৌড়ে গিয়েও তার রেহাই মেলেনি। সেখানেই চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাকে।

তার হত্যাকারী প্রত্যেক তরুণকে চিহ্নিত করা গিয়েছিল নাম-পরিচয়সহ। ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল এদের প্রত্যেকের পরিচয়। এই অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণের পর এদের গ্রেপ্তার আর উপযুক্ত বিচার এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বিশ্বজিতের বাবা তবু উপযুক্ত বিচার হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর সংশয়ই সত্য হয়েছে। নিম্ন আদালতে এই হত্যাকারীদের মধ্যে ৮ জনের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল, ১১ জনের যাবজ্জীবন। কিন্তু হাইকোর্টে আপিলের রায়ের পর অনেক কিছু বদলে গেছে। নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া চারজনকে উচ্চ আদালত সর্বোচ্চ শাস্তি থেকে রেহাই দিয়ে যাবজ্জীবন দিয়েছেন। নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বাকি দুজন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা খালাস পেয়েছেন। বাকি যে দুজনের ফাঁসির আদেশ বহাল আছে, তাদের মধ্যে একজন পলাতক। অর্থাৎ নিম্ন আদালতে ফাঁসির আদেশ পাওয়া আটজনের মধ্যে মাত্র একজনকে এই শাস্তি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে সরকারের।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া হত্যাকারীদের মধ্যে অধিকাংশই রয়েছে পলাতক। অন্যদিকে নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন পেয়ে যারা জেলে ছিল, তাদের দুজনকে দেওয়া হয়েছে পুরোপুরি খালাস। হাইকোর্টের রায়ে তাই মূলত পলাতকদের ছাড়া বাকি প্রায় সবার সাজা লঘুতর হয়েছে। এমনকি পলাতক রয়েছে এমন দুজন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ছাত্রলীগ কর্মীও  পেয়েছে খালাসের রায়। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে মূলত সাজা হয়েছে পলাতকদের। গত পাঁচ বছরে এদের ধরতে পারেনি পুলিশ। এদের আর কোনো দিন ধরা যাবে বা হবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।

২.

বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে তাই সমাজে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে এই বিচারের নানা দুর্বল দিক তুলে ধরা হয়েছে। দুর্বল বিচারের জন্য তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা, সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুতকারী এবং ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের গাফিলতির কথা বলা হয়েছে।

বিশ্বজিতের বাবা সাড়ে চার বছর আগেই সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের রিপোর্টে গাফিলতির কথা উল্লেখ করেছিলেন, সঠিক বিচার না পাওয়ার আশঙ্কার কথা বলেছিলেন। নিজ চোখে তিনি তাঁর ছেলের শরীরে যে আঘাতগুলোর চিহ্ন দেখেছিলেন, তা কেন পুলিশ বা চিকিৎসক খুঁজে পেলেন না, সে প্রশ্ন করেছিলেন। এসব প্রশ্ন অনেকটা অমীমাংসিত রেখেই নিম্ন আদালতে বিচার হয়েছে। এসব প্রশ্ন নিম্ন আদালতের সামনে তুলে ধরার সুযোগ সরকারি উকিলের ছিল, সুযোগ ছিল তদন্তকাজ সঠিকভাবে করার আরজি তোলার। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে  নিম্ন আদালতের বিচারকেরও সুযোগ ছিল এ বিষয়ে নিজে থেকেই উপযুক্ত আদেশ-নির্দেশ দেওয়ার।

যেকোনো বিচারকার্য তিনটি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার ওপর নির্ভর করে। একটি তদন্তকারী পুলিশ বিভাগ। দ্বিতীয়টি প্রসিকিউশন বা সরকারি উকিল বিভাগ। তৃতীয়টি আদালত বা বিচার বিভাগ। বিশ্বজিৎ হত্যার ঠিকমতো তদন্ত না হলে এটি আদালতের কাছে তুলে ধরার দায়িত্ব ছিল সরকারি উকিলের। দুটো প্রতিষ্ঠানই ঠিকমতো কাজ না করলে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে কিছু ভূমিকা পালন করতে পারতেন বিচার বিভাগ। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচারে এখানে কোথাও না কোথাও মারাত্মক ব্যত্যয় ঘটেছে, এটি উচ্চ আদালতের রায়ের পর নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

এমন একটি বিচারে নিম্ন আদালতের শাস্তি বহাল রাখার সুযোগ হয়তো উচ্চ আদালতের ছিল না। কিন্তু ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৩ ধারা অনুসারে তদন্ত ও বিচারে বিভিন্ন ত্রুটি পর্যবেক্ষণের পর এই মামলার পুনর্বিচার করার আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা আপিল আদালতের রয়েছে। আমার জানি না সেÿ ক্ষমতা প্রয়োগের কথা আপিল আদালত হিসেবে হাইকোর্ট বিবেচনা করেছিলেন কি না।

প্রশ্ন হচ্ছে, এখানে সরকারের ভূমিকা কী ছিল? পুলিশ ও সরকারি উকিলের নিয়ন্ত্রণ সরাসরি সরকারের হাতে। নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ মাসদার হোসেন রায়ের পরও কোনোভাবেই ছাড়তে রাজি হচ্ছে না সরকার। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের থাকে প্রায় একচ্ছত্র ভূমিকা। সে ক্ষেত্রে সুবিচার না হলে অভিযোগের আঙুল সরকারের দিকেই যাওয়া উচিত। বিশেষ করে আসামিদের ও পরে সাজাপ্রাপ্তদের গ্রেপ্তারে গাফিলতি, পলাতকদের খুঁজে পেতে ব্যর্থতা, নিম্নমানের তদন্ত এবং প্রসিকিউশনে দুর্বলতার দায়ভার এড়ানোর সুযোগ নেই সরকারের।

৩.

বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া তরুণদের তবু কারও কারও সাজা হয়েছে। একজন সর্বোচ্চ ফাঁসির দণ্ড পেয়েছে, আপিলেট ডিভিশনে এই রায় বহাল থাকলে তার ফাঁসি হওয়ার কথা। এই হীন অপরাধ করে যারা পালিয়ে গেছে, তাদের কোনো না কোনো আমলে শাস্তিদানের সুযোগ থাকবে। যারা ছাড়া পেয়েছে, তাদের জীবনের কিছুটা সময় অন্তত অনিশ্চয়তায় কাটাতে হয়েছে, মনুষ্যত্ব থাকলে কিছু অপরাধবোধও তাদের থাকবে।

কিন্তু এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অনুঘটকদের কোনো সাজা হলো কি? এই হত্যাকাণ্ডের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের একজন মন্ত্রী বিরোধী দলের কর্মীদের ঘরে ঘরে ঢুকে হত্যা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হত্যাকাণ্ডের আগের দিন বিরোধী দলের লোকজনকে শায়েস্তা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, এ কাজে স্বয়ং পুলিশ তাদের প্রোটেকশন দেবে। বিশ্বজিৎকে বিরোধী দলের কর্মী ভেবেই হত্যা বা শায়েস্তা করতে গিয়েছিল ছাত্রলীগের কর্মীরা। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের সময় অদূরে দাঁড়ানো পুলিশ হত্যাকারীদের নিবৃত্ত করেনি। হত্যাকাণ্ডের পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হত্যাকারীরা ছাত্রলীগের নয় বলে বক্তব্য দিয়েছিলেন, পরে সব পরিচয়
ফাঁস হওয়ার পর তাঁর মন্ত্রণালয়ের অধীন পুলিশ ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত করে বিচারের ভিত দুর্বল করে দিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের আগে হত্যা বা শায়েস্তা করার বক্তব্য দানকারীরা হুকুমের আসামি হিসেবে বিচারযোগ্য ছিলেন। কিন্তু এ জন্য তাদের বিচার হয়নি, কোনো দিন
হবেও না।

বিশ্বজিতের হত্যাকারী ছাত্রলীগের কমিটি ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্বাচিত কমিটি। রাজপথে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নবনির্বাচিতরা কোন যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে গিয়েছিল? এই ঘটনার আগে-পরে অনেক ক্ষেত্রে আমরা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি নৃশংসতার পুরস্কার পেতে দেখেছি ছাত্রলীগে নেতৃত্বে বসানোর মাধ্যমে। অতিসম্প্রতি তুফান সরকারের ঘটনার মধ্য দিয়েও আমরা নৃশংস ও অমানুষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার প্রবণতার প্রমাণ দেখতে পেয়েছি।

বিশ্বজিৎ এবং তার মতো আরও বহু খুন হওয়া মানুষের হত্যাকারীদের জন্ম, প্রশ্রয় ও প্রোটেকশন দেওয়ার একটা রাজনীতি আছে দেশে। সব সরকারের আমলেই এর নজির দেখা গেছে। এই রাজনীতির কুশীলব আছে, আছে কুশীলবদের সহচর। বিশ্বজিৎ ও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সুবিচার হলে এই কুশীলবদের মুখোশও উন্মোচিত হতো। তরুণ বিশ্বজিতের করুণ জীবনদানের কিছুটা মূল্যও হয়তো থাকত তখন।

এসব কিছুই প্রায় হয় না। বিশ্বজিতের ক্ষেত্রেও হয়নি। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড ও বিচার বরং অতীতের মতো এই বার্তাই দিয়ে গেল
যে অপরাধের অকাট্য প্রমাণ থাকলেওÿ ক্ষমতাসীনদের সহযোগীরা সব সময়ই ছাড় পায়। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকে।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।