যেন আরও একটি অবসর-উত্তর রায়!

এ বি এম খায়রুল হক
এ বি এম খায়রুল হক

আমরা এখন বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে বাস করছি, কথাটি বলেছেন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক ষোড়শ সংশোধনীকে বেআইনি ঘোষণা করে বাতিল করায় অপ্রত্যাশিতভাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এসব কথা বলেছেন। তাঁর পাশে ছিলেন আরেকজন সাবেক বিচারপতি। তাঁদের এই অতিমাত্রায় রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় ধারণা হতে পারে যে তাঁরাই বরং অবসরজীবন থেকে রাজনীতির জগতে পা রাখার চেষ্টাকে জোরদার করছেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সর্বসম্মত রায়ের সমালোচনার কাজটি আইন কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কি না, সেই প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে। আইন কমিশন আইন, ১৯৯৬-এর ৬ নম্বর ধারায় কমিশনের কার্যাবলির যে তালিকা দেওয়া আছে, তাতে কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সমালোচনা অন্তর্ভুক্ত নেই।

ষোড়শ সংশোধনীর রায় সম্পর্কে নাগরিক হিসেবে মতপ্রকাশের অধিকারের কথা অবশ্য তিনি বলতেই পারেন। কিন্তু তিনি বর্তমানে প্রজাতন্ত্রের একটি লাভজনক পদে আসীন এবং সেই দপ্তরের স্থাপনা এবং সুবিধা ব্যবহার করে তাঁর ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করতে পারেন না। তাঁর নিজের ঘোষিত রায়েই অবশ্য বলা আছে যে অবসর গ্রহণের পর বিচারপতি প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদ গ্রহণ করতে পারেন না। সংবাদ সম্মেলনে তিনি কমিশনের আরেকজন সদস্য সাবেক বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির এবং কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা ফউজুল আজিমকেও পাশে রেখেছিলেন। বিচারপতিদেরও সংসদের কাছে দায়বদ্ধ রাখার যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ’প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক কর্মচারীর দায়বদ্ধতা আছে, কারও না কারও কাছে দায়বদ্ধতা আছে।’ আইন কমিশনের চাকরির কারণে সংসদের কাছে জবাবদিহি করায় তাঁর অভ্যস্ত হয়ে ওঠাটা প্রশংসনীয়। তবে বিচারপতিদেরও সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে, এমন দাবি করার আগে তিনি তাঁর নিজের লেখা রায়গুলো একবার পড়ে নিলে ভালো করতেন।
জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন ও সেই আমলে জারি করা সামরিক আইন, আদেশ ও বিধানগুলোকে বেআইনি ঘোষণা করে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন এ বি এম খায়রুল হক। কিন্তু পরে প্রধান বিচারপতি হিসেবে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণার কারণে বিতর্কিতও হয়েছেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে তিনি যে মামলায় পঞ্চম সংশোধনীকে বেআইনি ঘোষণা করেছিলেন, সেই সময়ও ওই বেঞ্চে তাঁর সহযোগী বিচারপতি ছিলেন এ টি এম ফজলে কবির। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে তিনি লিখেছিলেন, বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র, যা আইনগতভাবে গঠিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়, কোনো ব্যক্তি দ্বারা নয় (Bangladesh is a Sovereign Democratic Republic, governed by the Government of laws and not of men.)। পরের বাক্যেই তিনি লিখেছিলেন যে বাংলাদেশের সংবিধান সার্বভৌমত্বকে ধারণ করে এবং এটিই দেশের সর্বোচ্চ আইন। অন্য সব আইন, কাজ এবং কার্যধারাকে সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। তিনি আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগকে রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ উল্লেখ করে বলেন যে এগুলো সংবিধানের সৃষ্টি এবং সংবিধানের বিধানগুলোই এগুলোর সম্পর্কের বন্ধন। আইনসভা আইন করে, নির্বাহী বিভাগ তা প্রয়োগ করে এবং বিচার বিভাগ সেগুলোর সংবিধানসম্মত হওয়া নিশ্চিত করে।
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বর্তমান আপিল বিভাগও বলেছেন সার্বভৌমত্বের ধারক হচ্ছে সংবিধান। সংসদ সার্বভৌম নয়, সংবিধানের কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষমতা সংসদের নেই। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে বিচারপতি খায়রুল হক ও বিচারপতি ফজলে কবির সামরিক শাসনের সময়ে সংশোধিত সংবিধানের অনেকগুলো অনুচ্ছেদের পরিবর্তনকে মার্জনা করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ৯৫ অনুচ্ছেদ, যাতে বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ওপর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া অন্যায় হবে না যে তখন তাঁর আশা ছিল যে একদিন প্রধান বিচারপতি হওয়ার সুযোগ তাঁর আসবে এবং তখন বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি একেবারে দর্শকের সারিতে নেমে যেতে বাধ্য হতে চাননি।
সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজন, জাতীয়তা ও নাগরিকত্বের মতো বিষয়গুলোতেও সামরিক শাসনামলে জারি করা সংশোধনীগুলো তিনি মার্জনা করে বৈধতা দিয়েছিলেন। অথচ এখন তিনি ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘এই হলো প্রথম মামলা, যেখানে আদি সংবিধানের বিধানকে বাদ দিয়ে “মার্শাল ল প্রভিশনস”কে গ্রহণ করা হয়েছে।’ শত্রু সম্পত্তি হিসেবে মুন সিনেমা হলের মালিকানা অধিগ্রহণ এবং তার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ১৯৭২ সাল থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন সরকারি আদেশের বিষয়ে দায়ের হওয়া মামলার রায়ে সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণার জন্য তিনি তখন প্রশংসিত হলেও সামরিক শাসনের যেসব অংশকে তিনি বৈধতা দিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলোর পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল কি না, এখন সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। এই প্রশ্ন উঠছে এ কারণে যে তাঁর আগের অবস্থানের সঙ্গে ষোড়শ সংশোধনীর প্রতিক্রিয়ার অমিলই বেশি। কিন্তু তার রাজনৈতিক প্রভাব অনেক বিস্তৃত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধানসংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা রয়েছে। বিশেষত অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৫ মাস পর তিনি ওই রায়টি লিখেছিলেন। অথচ তাঁর বিশদ রায় প্রকাশের আগেই সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে, যাতে তাঁর রায়ের অন্তত একটি নির্দেশনা উপেক্ষিত থেকে গিয়েছিল। তিনি অবসরে যাওয়ার আগে তাঁর রায়টি দিয়ে গেলে ওই নির্দেশনা উপেক্ষা করা সম্ভব হতো না বলেই অনেকের বিশ্বাস। তাঁর রায়টিতে সাতজনের বেঞ্চের তিনজন ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। আর সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল ঘোষিত রায় এবং লিখিত রায়ের আদেশের মধ্যে ফারাক দেখা দেওয়ায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের বিষয়টিকেই অনেকের মতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল ও অস্থির করে তুলেছে।
এই পটভূমিতে ষোড়শ সংশোধনীর রায়-সম্পর্কিত বিতর্কে বিচারপতি খায়রুল হকের মন্তব্য রাজনীতির অঙ্গনে আরও কিছুটা উত্তাপ যোগ করেছে, সন্দেহ নেই। আদালতের রায় বিষয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতির এ যেন আরও একটি অবসর-উত্তর রায়। কিন্তু এতে যে দেশে গণতন্ত্র বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি অর্জিত হচ্ছে, সে কথা বলা যাচ্ছে না।