রায় শোধরানোর তরিকা আছে

বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরী
বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরী

সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরী ২০০১ সালের ১ মার্চ থেকে ২০০২ সালের ১৭ জুন পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি ছিলেন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায়কে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিতর্কের পটভূমিতে গতকাল প্রথম আলোর সঙ্গে এর বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম  আলো: সামগ্রিকভাবে রায়-পরবর্তী বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া পাল্টা-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

মাহমুদূল আমীন চৌধুরী: আমি রায় এখনো পড়িনি। তবে একটি বিষয় মনে হচ্ছে, এটা নিয়ে সবাই খামাখা তোলপাড় করছেন। রায় শুদ্ধ হতে পারে, না-ও পারে। রায় সম্পর্কে আমার দ্বিমত থাকতে পারে। শোধরানোর প্রতিষ্ঠিত তরিকা আছে। আইন আছে। এটা নিয়ে রাজনীতি করা মোটেই উচিত হয়নি বা হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজনীতি করছে। মন্ত্রীদেরও কেউ কেউ করছেন। অথচ তাঁরা অবহিত আছেন যে সংবিধানই সুপ্রিম কোর্টকে সংসদের পাস করা কোনো বিল অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা করার এখতিয়ার দিয়েছে। তাঁরা সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতাবলেই ষোড়শ সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করেছেন।

প্রথম আলো: কিন্তু সরকারি দল ওই সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণার চেয়েও বড় করে দেখছে কিছু পর্যবেক্ষণ।

মাহমুদূল আমীন চৌধুরী: সে রকম যদি কিছু আদৌ থাকে, তাহলে তার প্রতিকারের আইনসম্মত পথ খোলা আছে। কোনো বিষয়ে ক্ষোভের কারণ থাকলে তার প্রতিকার চাওয়া যেতে পারে। এ জন্য দুটি পথ খোলা। তাঁরা রিভিউ করতে পারেন। অথবা এক্সপাঞ্জ চাইতে পারেন।

প্রথম  আলো: এক্সপাঞ্জ করার কথা আইনমন্ত্রীও বলেছেন। এটা কি রিভিউর বাইরে আলাদা চাইতে হবে?

মাহমুদূল আমীন চৌধুরী: আমার তো মনে হয় আলাদা চাইতে হবে। এটা হবে রিভিউর বাইরে।

প্রথম  আলো: আপিল বিভাগের বিধিতে কিছু আছে?

মাহমুদূল আমীন চৌধুরী: সেটা এখন মনে নেই। তবে পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্জ করার সুযোগ আছে। এমনকি আদালত নিজেরা সুয়োমোটো করতে পারেন। আবার দরখাস্ত দিয়ে বলা যায়, যেহেতু এটা বিচার্য ছিল না, তাই আপনারা এটা এক্সপাঞ্জ করে দেন।

প্রথম  আলো: কিন্তু আইনমন্ত্রী লিখিতভাবে সরকারের অবস্থান ব্যক্ত করার পরও মন্ত্রীদের কেউ কেউ কড়া ভাষায় মন্তব্য করছেন।

মাহমুদূল আমীন চৌধুরী: এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কী মন্তব্য করব তা বুঝতে পারছি না। যাঁর মুখ আছে তিনি বলেন, যাঁর কলম আছে তিনি লেখেন। আসলে আমাদের কথার ওপরে ভ্যাট বসানো উচিত কি না, সেটা চিন্তা করার সময় এসেছে। তাহলে অহেতুক কথা বলা নিয়ন্ত্রিত হবে।

প্রথম  আলো: দেশে কোনো সাংবিধানিক শূন্যতা চলছে কি না? সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কি কার্যকর? আইনমন্ত্রী বলেছেন, অষ্টম সংশোধনী মামলায় ১০০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর আগের বিধান আপনাআপনি কার্যকর হয়েছে। কিন্তু তা সম্পূর্ণ আইনসিদ্ধ কি না, তা ন‌িয়ে প্রশ্ন আছে। আপনি কী মনে করেন?

মাহমুদূল আমীন চৌধুরী: আমার ব্যক্তিগত মত হলো, ওটা আপনাআপনি পুনরুজ্জীবিত হয় না। কারণ, আদালত কোনো আইন সৃষ্টি করতে পারেন না।

প্রথম  আলো: ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম মনে করেন, এখানে দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ, যাতে এটি আদালত দ্বারা ঘোষিত আইনের মর্যাদা পায়। অন্যটি হলো এর প্রকাশনা। সংবিধানে এটি কীভাবে প্রতিস্থাপিত হবে? এ জন্য সংসদে বিল আনতে হবে কি না?

মাহমুদূল আমীন চৌধুরী: প্রকাশনার জন্য সংসদে বিল আনতে হবে। তবে একই সঙ্গে এটাও বলব যদি দৃষ্টান্ত (প্রিসিডেন্স) থাকে, তাহলে কিন্তু দৃষ্টান্তমতোই চলবে।

প্রথম  আলো: আদালতের নির্দেশে ১০০ অনুচ্ছেদ দিয়ে আমরা ২৩ বছর চলেছি। এটা তো দৃষ্টান্ত।

মাহমুদূল আমীন চৌধুরী: দৃষ্টান্ত থাকলে চলবে। তবে বিল আনাই সমীচীন। কিন্তু বাস্তবে আমার মনে হচ্ছে, এ নিয়ে একটা যুদ্ধ বেধে গেছে। এ রকম ঘটনা আমাদের ইতিহাসে তো এবারই প্রথম ঘটেনি। এরশাদের আমলে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ সৃষ্টি করা হয়েছিল। তখন আদালতের প্রতি মার্শাল ল অথরিটি তো এত শোরগোল তোলেনি। এখন কেন আমাদের এসব দেখতে হবে? সব থেকে দুর্ভাগ্য হলো খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্য। তিনি প্রধান বিচারপতির অপসারণ চেয়েছেন। এর আগে এক মামলায় তাঁর তো আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তি হয়েছিল। তিনি কীভাবে গলাবাজি করেন, তা বিস্ময়কর। তাঁর মন্ত্রিত্ব কী করে টিকে থাকে? পাকিস্তান আমলে একজন আইনসচিব ছিলেন আইসিএস অফিসার, স্নেলসেন। ব্রিটিশ। তিনি আদালত অবমাননায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি আইনসচিবের পদ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি আদালত অবমাননায় দণ্ডিত। তাই আমার আর এ পদে থাকা চলে না। আমি বলব, দেশে তো মন্ত্রী হওয়ার লোকের আকাল পড়েনি। কীভাবে দুজন দণ্ডিত ব্যক্তি মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন?

এমন সব ভাষা কেউ কেউ ব্যবহার করছেন, যা অভাবনীয়। অনেকের কথাবার্তায় মনে হয়, পারলে বলে বসেন যে আমাদের প্রধান বিচারপতি একজন রাজাকার ছিলেন! যেসব ভাষার ব্যবহার কানে আসছে, তা বিচার বিভাগের মর্যাদার জন্য হানিকর। এ রকম পরিবেশ ন্যায়বিচার ও বিচার বিভাগীয় পরিবেশের জন্য অস্বস্তিকর।

প্রথম  আলো: বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন, মতপ্রকাশে তাঁর স্বাধীনতা রয়েছে। এটা তো ঠিক? তিনি একটি আধা বিচার বিভাগীয় পদে রয়েছেন।

মাহমুদূল আমীন চৌধুরী: না, ঠিক নয়। শ্রদ্ধার সঙ্গে আমি তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করি। কারণ, তিনি সরকারি চাকুরে হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। আমার মতো তিনি যদি শুধু পেনশন পেতেন, তাহলে না হয় একটি কথা ছিল। সরকারের কাছ থেকে তিনি বেতন পাচ্ছেন। তাঁর পদ আধা বিচার বিভাগীয় হতে পারে। তিনি কেন সংবাদ সম্মেলন করবেন? আমি মনে করি, এটা তাঁর পক্ষে সমীচীন হয়নি।

প্রথম আলো: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি অধস্তন আদালতের শৃঙ্খলাসংক্রান্ত ১১৬ অনুচ্ছেদকে (যাতে বলা আছে প্রধানমন্ত্রীই কার্যত বিচারকদের চাকরি নিয়ন্ত্রণ করবেন) সংবিধান পরিপন্থী বলেছেন। অন্য চারজন বিচারক একে এই রায়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক মনে করেননি।

মাহমুদূল আমীন চৌধুরী: আমি প্রধান বিচারপতির অবস্থানকে সঠিক মনে করি।

প্রথম আলো: সরকার মনে করে যে যুক্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। আপনার যুক্তি কী?

মাহমুদূল আমীন চৌধুরী: আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতেই সর্বময় ক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট শুধুই কবর জিয়ারত করতে পারেন। দ্বাদশ সংশোধনীর পরে তিনি এ কথা বলেছিলেন। এরপর ১৬ বছর কেটেছে। এই সময়ে আমরা চারবার সংবিধান সংশোধন বিল পাস হতে দেখলাম। অথচ তাঁর সেই বক্তব্যের কোনো বদল হয়নি। কারণ, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতি আর সব ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে চলেন। তাই এ অবস্থায় বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে গেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমার তো মনে হয়, তখন সুপ্রিম কোর্টসহ সব আদালতই নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। তাই সর্বসম্মতভাবে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় খুবই সঠিক হয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে গেলে মাসদার হোসেন মামলায় আমরা বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের মাধ্যমে যা অর্জন করেছিলাম, তার বিসর্জন ঘটবে।