ওরা কি হালের বলদ?

স্কুলের শ্রেণিকক্ষের সামনে একজন ছাত্রী ও চার-পাঁচজন ছাত্রকে বেধড়ক পেটাচ্ছেন এক শিক্ষক—এ রকম একটি ভিডিও সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষক উন্মত্তের মতো শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাত করছেন আর অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে তাদের চোখ-মুখসহ সমস্ত শরীর, এই দৃশ্য মানুষকে কতটা বিস্মিত ও ব্যথিত করেছে, তা পোস্টটির শেয়ারের সংখ্যা ও অজস্র ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখে অনুমান করা যায়। স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু পরে জানা গেল ঘটনাটি আমাদের দেশে নয়, ঘটেছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের কোনো একটি স্কুলে। শিশুদের ওপর এ রকম পাশবিক নির্যাতন, তা সে যে দেশেই হোক, সচেতন মানুষের জন্য বেদনাদায়ক, সন্দেহ নেই। আপাতত এই ভেবে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেল, ঘটনাটি আমাদের দেশের কোনো স্কুলে ঘটেনি। কিন্তু এই আপাত স্বস্তির পর এ প্রশ্ন মনে আসে, আমাদের দেশেও কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ রকম ঘটনা ঘটছে না? তাহলে চট্টগ্রামের বেপজা পাবলিক স্কুলের ছাত্র মাশরাফুল আলম (১৪) কেন একটি চোখের আলো হারাতে বসেছে? কেন পেকুয়ার মডেল জিএমসি স্কুলের ছাত্র পক্ষাঘাতগ্রস্ত শিশু তামিম (১৩) নির্যাতন সইতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল শ্রেণিকক্ষেই?

ছাত্রছাত্রীদের ওপর শিক্ষকদের নির্দয়ভাবে চড়াও হওয়ার ঘটনা প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সব ঘটনার সংবাদ অবশ্য প্রকাশ পায় না। ‘কঠোর’ ও ‘নীতিপরায়ণ’ শিক্ষকদের এ রকম অত্যাচার-নির্যাতন আমাদের অধিকাংশ স্কুলে-কলেজের শিক্ষার্থীরা নীরবে সহ্য করছে। এমনকি তারা অভিভাবকদেরও জানায় না উল্টো আরেক দফা শাসনের মুখে পড়ার ভয়ে।

সাম্প্রতিক ঘটনা দুটি সম্পর্কে পাঠকদের একটু বিশদ অবহিত করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। মাশরাফুল জেএসসি পরীক্ষার্থী। স্কুলের কোচিং ক্লাসে গিয়ে জ্যামিতির অঙ্কনে ভুল করলে শিক্ষক আরিফ বিল্লাহ তাকে এলোপাতাড়ি পেটাতে শুরু করেন। একপর্যায়ে মাশরাফুলের বাঁ চোখে আঘাত লাগে। সে ফোলা চোখ নিয়ে বাড়ি ফিরলে দেখা যায় তার চোখের মণি থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তাকে সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে চট্টগ্রামেরই একটি বিশেষায়িত চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা বলেন, মাশরাফুলের চোখের অবস্থা খুবই খারাপ, শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হবে। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য মাশরাফুলকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে। এ বছর জেএসসি পরীক্ষায় যে তার আর বসা হচ্ছে না, এ তো নিশ্চিত, এখন মাশরাফুল বাঁ চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে কি না, এই দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তার মা-বাবা।

পেকুয়া মডেল জিএমসি স্কুলের ছাত্র তামিমের ঘটনাটি আরও হৃদয়বিদারক। মাত্র মাস তিনেক আগে স্ট্রোক করেছিল সপ্তম শ্রেণির এই ছাত্র। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে অভিভাবকেরা নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে। সেখানে দুই মাস থাকতে হয়েছিল তাকে। তারপরও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি, খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিয়েছিলেন ছেলেকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে। কিন্তু ছেলের আবদারে তাকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন অভিভাবকেরা। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান নিজে শিক্ষকদের কাছে গিয়ে ছেলের অসুস্থতা ও চিকিৎসকের পরামর্শের কথা জানিয়ে অনুরোধ করে আসেন পড়ালেখার ব্যাপারে তাকে চাপ না দিতে। কিন্তু তাতেও করুণার উদ্রেক হয়নি শিক্ষক কফিলউদ্দিনের। শ্রেণিকক্ষে অন্য ছাত্রের সঙ্গে কথা বলার অপরাধে তাকে এমনভাবে বেত্রাঘাত করেন যে ছেলেটি সেখানেই জ্ঞান হারায়।

প্রিয় পাঠক, ভারতীয় চলচ্চিত্র তারকা আমির খান প্রযোজিত ও অভিনীত তারে জমিন পর ছবিটি দেখেছেন? অন্য রকম মানসিক গড়নের কারণে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া একটি শিশুকে শিক্ষক যথাযথ পরিচর্যা করে কীভাবে সাফল্যের পথ দেখিয়েছিলেন, তারই মর্মস্পর্শী চিত্র ফুটে উঠেছে এতে। চলচ্চিত্রের সেই শিশু ও শিক্ষকের চরিত্র আমাদের মনে দাগ কেটেছে। কিন্তু বাস্তবে কি সেই শিক্ষকের দেখা মেলে? হয়তো মেলে, সংখ্যায় কম হলেও নিশ্চয় তাঁরা আছেন, শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে তাঁরাই তো বেঁচে থাকেন চিরকাল।

শিক্ষার্থীদের ক্লাসে নির্দয়ভাবে পেটানোর ঘটনা আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। আমরা শিক্ষকদের যুগ যুগ ধরে বেত হাতে নিয়ে ক্লাসে ঢুকতে দেখেছি। অভিভাবকেরাও এ নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন ছিলেন বলে মনে হয় না। বরং ‘উপযুক্ত’ শাসনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের বেড়ে ওঠা উচিত, এ বিষয়ে শিক্ষক-অভিভাবকের অলিখিত ‘মতৈক্য’ও দীর্ঘকালের। তাই আঘাত গুরুতর না হলে শিক্ষার্থী যেমন মুখ খোলে না, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের ওপর নির্যাতনের ব্যাপারেও উচ্চবাচ্য করেন না অভিভাবকেরা।

‘ছাত্রাবস্থায়’ শিক্ষকের পিটুনি খায়নি কে? পরবর্তী কালে তাঁরা কি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হননি? দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হননি?’—কেউ এ রকম যুক্তি দেখাতে চাইলে তার উত্তর দিতে আমরা অপারগ। কারণ, এর কোনো পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। তবে পাল্টা যুক্তি হিসেবে বলতে পারি, উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানে বহুকাল ধরে শিক্ষার্থীর ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, সেখানে সবাই বখে গেছেন বা জীবনে সাফল্যের মুখ দেখেননি, এমন তো নয়। বরং তাঁদের মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার কারণেই ওই সব দেশ সমৃদ্ধির এমন স্তরে উন্নীত হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১১ সালে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করা-সংক্রান্ত নীতিমালা’ প্রণয়ন করেছে। এই নীতিমালায় শিক্ষার্থীদের ওপর দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন কোন কোন বিধিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তা–ও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সারা দেশে কয়টা স্কুল এই নীতিমালা অনুসরণ করে, তা খুঁজে বের করা সত্যিই কঠিন।

বরং নীতিমালায় সুনির্দিষ্টভাবে যেসব প্রক্রিয়ায় শাস্তি দেওয়া যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন কোনো ছাত্রছাত্রীকে বেত্রাঘাত করা, চড়থাপ্পড় মারা, তাদের দিকে চক বা ডাস্টার ছুড়ে মারা, চুল ধরে টানা, চুল কেটে দেওয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল চাপা দিয়ে মোচড় দেওয়া, চেয়ার–টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো, রোদে দাঁড় করিয়ে রাখাসহ নানা পদ্ধতিরই প্রয়োগ অব্যাহত রয়েছে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

চট্টগ্রামের একটি স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিছুদিন আগে চুল লম্বা রাখার কারণে কয়েকজন ছাত্রকে শাস্তি দেওয়া হয় অদ্ভুতভাবে। স্কুলের মালিকে দিয়ে তাদের চুল কেটে দেওয়া হয় শ্রেণিকক্ষ-ভর্তি সহপাঠীদের সামনেই। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির তথাকথিত নিয়ম ও শৃঙ্খলা রক্ষা হলো হয়তো, কিন্তু সদ্য কৈশোর পেরোনো এই ছাত্রদের মনোজগতে এর প্রভাব কী হতে পারে, তা কি ভেবে দেখেছেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলী?

মনোচিকিত্সক আহমেদ হেলাল এ প্রসঙ্গে বললেন, গবেষণায় দেখা গেছে, মারধর বা এ ধরনের শাস্তি দেওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের আচরণ সংশোধন তো হয়ই না, বরং তাদের মনোজগতে একধরনের ‘ইগো-ডিফেন্স ম্যাকানিজম’ তৈরি হয়। তার ভবিষ্যৎ-জীবনে নানাভাবে এর প্রকাশ ঘটতে পারে। একদিকে আত্মমর্যাদাবোধের অভাব থেকে তার সামাজিক দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কমতে পারে। অন্যদিকে আগ্রাসী মনোভাবের সৃষ্টি হতে পারে। এটাকে ‘অ্যাগ্রেশন-ফ্রাস্ট্রেশন হাইপোথিসিস’ বলেও মনে করেন আহমেদ হেলাল।

সমাজে তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার যে ভয়াবহ প্রবণতা আমরা আজ লক্ষ করছি, তাতে শিক্ষাজীবনে তাদের প্রতি নির্দয় আচরণের কোনো প্রভাব আছে কি না, তা–ও ভেবে দেখার সময় কি হয়নি? শিক্ষার্থীরা হালের বলদ নয় যে পিঠে বেত পড়লেই সুড়সুড় করে পথ চিনে নেবে। সব শিক্ষার্থীই পরীক্ষায় ভালো ফল করবে—এমন আশা করাও সমীচীন নয়। কারও কারও মধ্যে পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে অন্য বিষয়ে আগ্রহ দেখা যায়। সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, খেলাধুলাসহ নানা দিকে তার প্রতিভার স্ফুরণ ঘটতে পারে। শিশু-কিশোরদের বিচিত্রগামী মন অনুধাবন করাই তো প্রকৃত শিক্ষকের কাজ।

শাসনের জন্য বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। ভালো কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করা, পুরস্কৃত করা, মন্দ কাজের জন্য তার মনে অনুতাপের সঞ্চার করা—এ বড় কাজ সহজ নয়। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষককে তো এ চ্যালেঞ্জ নিতেই হবে।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।