কন্যা ও নারীদের কথা ভাবুন

বানভাসি মানুষের দুর্দশার অন্ত নেই। বানের জলে আবালবৃদ্ধবনিতা সবার সমান দুর্ভোগ। কিন্তু তুলনামূলকভাবে নারীর দুর্ভোগ বেশি। আর সে নারী যদি হয় শিশু-কিশোরী-তরুণী-মা। যখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জেন্ডার ধারণার অনুপ্রবেশ ঘটেনি, তখন দুর্যোগে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া হতো, সেখানে নারীর সুবিধা-অসুবিধার বিষয়টি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকত। শুরুর দিকে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে কোনো শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হতো না, যেন ধরেই নেওয়া হতো গরিবের আর ঘোড়ারোগ ধরিয়ে লাভ কী। তাঁরা তো মাঠেঘাটেই ও কর্মটি করে থাকেন। পরে এ কারণে যখন দূষিত পানিবাহিত রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, তখন সেবা সংস্থাগুলোর টনক নড়ল। একসময় শৌচাগারের ব্যবস্থা হলো। কিন্তু দেখা গেল, সেগুলো নির্মাণ করা হয়েছে পুরুষের ব্যবহারের উপযোগী করে। অর্থাৎ একদিক খোলা রেখে। নারীরা তাঁদের শাড়ি-ছায়া ঝুলিয়ে কোনো রকমে তা ব্যবহার করতেন। তারপর উন্নয়ন নীতিমালায় জেন্ডার সমতার অন্তর্ভুক্তি, অর্থাৎ নারী ও পুরুষের মধ্যে সমান সুযোগের অধিকার নিশ্চিত করার দাবি সোচ্চার হলো। এর মাধ্যমে জেন্ডার ভূমিকা ও চাহিদা স্পষ্ট হলে নারীর পৃথক শারীরিক কাঠামো ও পরিবর্তনকে আমলে নেওয়া হয়। কিন্তু গরিব দেশের আশ্রয়কেন্দ্র ও ত্রাণসামগ্রী এখনো নারীবান্ধব নয়।

বন্যায় বাড়ি-ঘর-উঠোন-পায়খানা-পুকুর-ডোবা সব একাকার। কিন্তু জীবনচক্র থেমে নেই। প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা সরেজমিনে দেখেছেন, পানি থইথই করা ঘরের মধ্যে চৌকির ওপর আনোয়ারার প্রথম সন্তান জন্ম নেয়। সে সময় বাড়িতে কোনো পুরুষ না থাকায় কোনোমতে রাত কাটিয়ে মা ও ভাবির সহায়তায় আনোয়ারা নবজাতককে নিয়ে নৌকা করে সড়কে গিয়ে ওঠেন। সেখানে পলিথিনের ছাপরা বানিয়ে শুরু হয় তাঁদের ভোগান্তির জীবন। সে ভোগান্তি বর্ণনা করার মতো নয়।

সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ৫১ উপজেলায় ৩০ লক্ষাধিক মানুষ বন্যাকবলিত। নারী-পুরুষ আধাআধি হলে ১৫ লাখ নারীর মধ্যে নিশ্চয় অর্ধেকই শিশু-কিশোরী-তরুণী। এদের মধ্যে অনেকেই আনোয়ারার মতো সন্তান প্রসব করছেন, করেছেন, কেউ কেউ আসন্ন প্রসবা, বাকিরা রজঃস্বলা। সন্তান প্রসবের পর দীর্ঘদিন ধরে নারীর ঋতুকাল চলে। ঋতুকালীন সব নারীর শরীর বাড়তি যত্নের দাবি রাখে। আমাদের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র নারীদের এখনো স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের সামর্থ্য নেই, অনেকে তো বিলাসিতা ভাবেন বা এর ব্যবহারই জানেন না। তাঁরা ঋতুকালীন সুরক্ষার জন্য দেশীয় পদ্ধতিতে পুরোনো কাপড় বারবার ধুয়ে-শুকিয়ে ব্যবহার করেন। দুর্যোগ ব্যতিরেকে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে শিশুর কাঁথা-কাপড়, নারীর রজঃ সুরক্ষার কাপড় বা পরিধেয় বস্ত্র হয়তো সহজেই শুকিয়ে যায় কিন্তু একটানা বৃষ্টি-বন্যা-দুর্যোগের ঘনঘটায়? আপন গৃহকোণে তবুও নিজের মতো করে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। তাই বলে আড়ালহীন খোলা বাঁধ বা সড়কের ওপর পলিথিনের বাড়িতে একান্ত ব্যক্তিগত জায়গার প্রত্যাশা হাস্যকরই বটে।

চিকিৎসকেরা বলেন, নারীর মেয়েলি রোগ অনেকটাই রজঃকালীন অপরিচ্ছন্নতা ও অসাবধানতার কারণে হয়ে থাকে। বন্যাকবলিত কন্যাদের নিয়ে তাই আমাদের আশঙ্কা থেকেই যায়। অন্তত দুর্যোগের কাল না কেটে যাওয়া পর্যন্ত চাল, চিড়া, মুড়ি, গুড়, স্যালাইন, শাড়ি, লুঙ্গির সঙ্গে যদি ত্রাণ হিসেবে স্যানিটারি প্যাড বিতরণ করা যেত, তাহলে আমাদের কন্যাদের ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় হয়তো কিছুটা স্বস্তি মিলত। আবার এর ব্যবহারে দৈনন্দিন জীবনকে স্বচ্ছন্দময় করে তোলার সুবিধা পেয়ে গেলে চাই কি নারীরা একটু খরচ হলেও পরবর্তী সময়ে নিজেরা এতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন। জানি, সরকারি ত্রাণের পাশাপাশি সুপ্রতিষ্ঠিত সংস্থা ছাড়াও ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত উদ্যোগেও অনেকে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য মানবিক হাত বাড়িয়েছেন। ফেসবুকের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অতুলনীয়। লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সহমর্মী মানুষেরা ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক মাধ্যমকে কেবল ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় সীমাবদ্ধ রাখেননি, এ মাধ্যম যে মানবকল্যাণেও সমান পারদর্শী, তারও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছেন।

নিশ্চয় এ প্রত্যাশা কারও একার নয় যে দুর্গত এলাকায় আমাদের মেয়েরা তাদের ব্যক্তিগত শারীরিক অসুবিধার দিনগুলোকে খানিকটা মসৃণ ও আরামদায়ক হিসেবে পাবে। আশা করি, ইতিমধ্যেই অনেক সংগঠন বিষয়টার গুরুত্ব অনুধাবন করে পদক্ষেপ নিয়েছে। নারীর ব্যথা নারী বেশি বোঝেন বলে নারী সংগঠনগুলোর উদ্যোগও বেশি জরুরি। আহা! এ মহাদুর্যোগকালে আনোয়ারার নবজাতক সন্তানসহ আরও নবজাতকেরা যদি ত্রাণ হিসেবে ডায়াপার পেত, তাহলে নিউমোনিয়া বা পানিবাহিত রোগ থেকে হয়তো তাদের রক্ষা করা যেত।

 উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।