আপন আলোয় আলোকিত এক রাজা

অভিনেতা হিসেবে নায়করাজ রাজ্জাক কেমন ছিলেন, এ গুণাগুণ বিচারের যোগ্যতা আমার নেই। দর্শক হিসেবে শৈশব থেকে বড় হওয়া অবধি তাঁর অনেক ছবি দেখেছি। এসব ছবি দেখে তাঁর সম্পর্কে যা বুঝেছি, জেনেছি, কীর্তিমান রাজ্জাককে যেভাবে আবিষ্কার করেছি, সেটা বলার চেষ্টা করতে পারি। এর প্রয়োজন আছে। একজন অভিনেতা কালজয় করে পৃথিবী থেকে চিরদিনের মতো চলে যাবেন, আর তাঁর গুণমুগ্ধ হিসেবে দু-চার কথা লিখব না, তা কি হয়?

রাজ্জাকের প্রথম ছবি কবে দেখেছি, তা পরিষ্কার মনে নেই। তবে খুদে দর্শক হিসেবে যখন তাঁকে আবিষ্কার করি, তখন দেখেছি, রাজ্জাক সব বয়সী, সব মানুষের প্রিয় নায়ক। বিশেষ করে সামাজিক ঘরোয়া জীবনে রাজ্জাকের আবেদন ছিল অতুলনীয়। রাজ্জাক চলচ্চিত্রে এসেই সবার মন জয় করে নেন। তাঁর সুন্দর চেহারা আর মাঝারি উচ্চতার একহারা গড়ন গড়পড়তা দর্শকের মনে ভালো লাগার একটা আমেজ তৈরি করে। তাঁর ভাবমূর্তি হয়ে ওঠে এমন, আরে, ও তো আমার পরিচিত সেই ছেলেটি, যাকে আমি প্রতিদিনই দেখি।

ছোটবেলায় দেখেছি, বয়সে বড় কিশোর-যুবারা রাজ্জাকের ভাবভঙ্গি ধরার চেষ্টা করত। তবে রাজ্জাক সাজার বেলায় একটি বড় বাধা ছিল চুল। মাথার সামনের দিকে চূড়ার মতো উঁচু ছিল নায়করাজের কোঁকড়ানো চুল। এই ভঙ্গিমায় চুল আঁচড়ানোর বেলায় বড় বাধা ছিল কোঁকড়ানো চুল। সবার তো আর এমন চুল থাকে না। কাজেই রাজ্জাকের ভঙ্গিতে চুল সাজাতে গিয়ে একেকজনের চুলের ঢং যা হতো, তা আর কহতব্য নয়।

নাটকীয়তায় ভরা সামাজিক সেন্টিমেন্টের ছবিগুলোতে নায়ক হিসেবে রাজ্জাক ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর চরিত্রগুলো ছিল বৈচিত্র্যে ভরপুর। ‘ক খ গ ঘ ঙ’ ছবিতে মন্টু চরিত্রে পরিবার-অন্তঃপ্রাণ গ্রামের যে দামাল যুবককে দেখেছি, ‘দুই ভাই’ ছবির জীবন চরিত্রে পাওয়া যায় শহুরে এক উড়নচণ্ডী যুবককে। চরিত্রের ধাঁচটা একই, কিন্তু প্রেক্ষাপট ভিন্ন—শহর আর গ্রাম। দুটো জায়গায়ই দুর্দান্ত রাজ্জাক। তিনি কত ছবি করেছেন, কত ছবি বক্স অফিসে হিট, সে পরিসংখ্যান এই স্বল্প পরিসরে কুলাবে না। এরপরও ‘জীবন থেকে নেয়া,’ ‘এতটুকু আশা’, ‘নাচের পুতুল’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘আবির্ভাব’, ‘তালাক’, ‘আসামি’, ‘সাধু শয়তান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘উপহার’. ‘দীপ নেভে নাই’, ‘স্বরলিপি’, ছদ্মবেশী’, ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’, ‘প্রতিনিধি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘যে আগুনে পুড়ি’—এমন আরও অনেক ছবি রয়েছে, যা হলে গিয়ে সপরিবারে বসে প্রাণভরে উপভোগ করেছেন দর্শক।

তবে এমন কিছু কাহিনিনির্ভর ছবির কথা বলা যায়, যেখানে রাজ্জাক পিভোটাল বা কাহিনিতে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক এনে দেওয়ার মতো কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। যেমন ‘অতিথি’ ছবির ট্যাক্সিচালক। এখানে নায়ক-নায়িকা আলমগীর ও শাবানা। কিন্তু কাহিনি আবর্তনে মূল ভূমিকা ছিল রাজ্জাকের ব্যতিক্রমী চরিত্রটির। আরেকটি ছবি শরৎচন্দ্রের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ‘সৎভাই’। ‘বদনাম’, ‘অগ্নিশিখা’, ‘ভাঙাগড়া’, ‘অনুরাগ’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘অশিক্ষিত’, ‘অনুরোধ’—এ ধরনের ছবি।

রাজ্জাক সব শ্রেণির, সব পেশার মানুষের প্রিয় অভিনেতা হয়ে ওঠার বড় একটি কারণ হচ্ছে সব ধরনের চরিত্রে স্বচ্ছন্দে মিশে যাওয়ার সহজাত গুণ। ‘রজনীগন্ধা’ বা ‘কালো গোলাপ’ ছবিতে আমরা আভিজাত্যের দাপটে ঝলকানো গুরুগম্ভীর ধনকুবেরকে দেখেছি, সেই রাজ্জাকে ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’ ছবিতে দেখা গেছে শ্রমিকনেতা রওনকের ভূমিকায়, যার বন্দিত্বে আন্দোলনে নামে শ্রমিকেরা। এ জন্য রাজ্জাক যেমন অভিজাত পরিবারেও ছিলেন, তেমনি ছিলেন পথের মানুষের হয়ে। ‘পিচ ঢালা পথ’ ছবিতেও পাওয়া যায় চালচুলোহীন আলাভোলা এমন এক রাজ্জাককে, যাঁকে শহরের রাস্তাঘাটে খবু সহজেই আবিষ্কার করা যায়।

অভিনয়জীবনের শুরুর দিকে রাজ্জাক প্রচুর রোমান্টিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। এসব ছবি মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হলের টিকিট কাউন্টারে হুড়োহুড়ি-গুঁতোগুঁতি লেগে যেত। এমনকি হাতাহাতিও হয়েছে। এ প্রসঙ্গ ‘প্রিয়তমা’ ছবির কথা বলা যায়। ববিতা ছিলেন নায়িকা। এ ছবিতে রাজ্জাকের মুখে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী খুরশীদ আলমের একটি গান রাতারাতি হইচই ফেলে দেয়। গানটি হচ্ছে ‘আমার এই কলজেটায় চাক্কু মেরে ঘায়েল করে ফালি ফালি করে দিয়ে কোথায় যেতে চাও বলো না...’। অন্যান্য রোমান্টিক ছবির মধ্যে ‘কত যে মিনতি’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, আবির্ভাব’, ‘সোহাগ’, ‘স্বরলিপি’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘ময়নামতি’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’, ‘আকাঙ্ক্ষা’, ‘কী যে করি’, ‘অনেক প্রেম অনেক জ্বালা’, ‘অমর প্রেম’, ‘বাজিমাত, ‘অভিমান’—এসব ছবির নাম উল্লেখযোগ্য।

রাজ্জাক তাঁর সময়ের শীর্ষ নায়িকা যাঁর সঙ্গেই জুটি বেঁধেছেন, দর্শকেরা সাদরে গ্রহণ করেছেন। সুচন্দা, শবনম, কবরী, শাবানা, ববিতা, সুজাতা—এঁদের সঙ্গে অভিনীত রাজ্জাকের ছবিগুলো দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। রাজ্জাকের ঠোঁট মেলানো বেশ কয়েকজন গুণী প্লেব্যাক কণ্ঠশিল্পীর গান দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁরা হচ্ছেন আব্দুল জব্বার, বশীর আহমেদ, মাহমুদুন নবী, সৈয়দ আব্দুল হাদী, মোহাম্দ আলী সিদ্দিকী, খুরশীদ আলম। এসব গানের আবেদন এখনো ফুরায়নি। এমনকি রাজ্জাক তাঁর ‘বদনাম’ ছবিতে নায়ক জাফর ইকবালকে দিয়ে গান করিয়ে সফল হয়েছেন। জাফর ইকবালের গাওয়া ‘হয় যদি বদনাম...’ গানটি এখনো পুরোনো দিনের অনেক দর্শক আনমনে গেয়ে ওঠেন। রাজ্জাক নিজেও দুটি ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। একটি ‘অগ্নিশিখা’, অন্যটি ‘জিনের বাদশা’।

রাজ্জাক বেশ কিছু ট্র্যাজেডি ছবিতেও অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে দর্শকদের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা ছিল কাজী জহিরের দর্শক-মাতানো ছবি ‘অবুঝ মন’। ছবির ‘চলার পথে ক্ষণিক দেখা...’ গানটি কী যে হিট! ছবি শেষ হওয়ার পর অনেক দর্শক নাকের জল-চোখের জল এক করে বের হয়েছেন। বুকচাপা কষ্ট নিয়ে আবার হলে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। এরপর ‘আলো তুমি আলেয়া’, ‘বাঁদী থেকে বেগম’, ‘অনুরাগ’, ‘অনুরোধ’, ‘মাটির ঘর’, ‘অনন্ত প্রেম’ ‘বেঈমান’, ‘সমাধি’, ‘সেতু’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘জিঞ্জির’—এমন বেশ কিছু ছবিতে তিনি বেদনার নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

ফ্যান্টাসি, পৌরাণিক কাহিনি বা মিথনির্ভর ছবিতেও নায়করাজ অনন্য। ‘বেহুলা’ ছবিতে লখিন্দরের চরিত্র যেমন তিনি দৃষ্টি কাড়েন, ‘সুয়ো রানী দুয়ো রানী’ ছবিতে রাখালের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো শাহজাদার চরিত্রেও দারুণ অভিনয় করেছেন। ‘মতিমহল’ আর ‘পাগলা রাজা’ ছবিতে পাওয়া যায় ভিন্ন এক রাজ্জাককে।

এক ‘রংবাজ’ দিয়েই অ্যান্টিহিরো চরিত্রে তিনি বাজিমাত করেন। একটি ছবিতে পুরোপুরি খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাক। এটি হলো ‘রাজাসাহেব’। আর মারদাঙ্গা ছবিতে রাজ্জাক তো ট্রেন্ড সেটার। এই ছবির মাধ্যমে রাজ্জাক ঢিসুম-ঢুসুম মারপিট এনে তাঁর ছবির ধারায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। গড়ে তোলেন ভিন্ন এক ভাবমূর্তি। ‘গুণ্ডা’ ছবিতে একজন মন্দ মানুষের ভালো মানুষে রূপান্তরের অভিনয়ে অসাধারণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি। এমন ধাঁচের আরও বেশ কিছু ছবি করেছেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম জাঁকাল ছবি ‘গুণ্ডা’। সাসেপন্স আর অ্যাকশনে ভরপুর ছবিটি বক্স অফিসে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। তিন বন্ধুর অভিযান নিয়ে ‘অভিযান’ ছবিটিও ছিল আরেকটি ধুমধাড়াক্কা ছবি।

ছবি প্রযোজনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রেও বাঙালি জীবন ও মেজাজের সঙ্গে পুরোমাত্রায় মিশে গিয়ে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন রাজ্জাক। ‘রংবাজ’, ‘আকাঙ্ক্ষা’, ‘মৌচোর’, ‘বদনাম’সহ আরও কিছু ছবি এর উজ্জ্বল প্রমাণ। জলাতঙ্ক নিয়ে সচেতনতামূলক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ডানপিটে ছেলে’-তে রাজ্জাকের মধ্যে একজন সাদাসিধে আদর্শ শিক্ষককে খুঁজে পাই আমরা। এভাবে রাজ্জাক জীবনভর নায়করাজের রাজকীয় সিংহাসনে বসে মিশে ছিলেন এ দেশের অগণিত মানুষের আটপৌরে জীবনে। এই জীবন থেকে কোনো দিনও মুছে যাবেন না তিনি।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]