আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা: মূলধারায়নের কৌশল

গত ২১ ডিসেম্বর ২০১৩, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা: মূলধারায়নের কৌশল’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সহযোগিতায় ছিল সেভ দ্য চিলড্রেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

 দ্রুততম সময়ের মধ্যে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা শুরু করতে হবে।
 আদিবাসী শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যন্ত অবশ্যই্রমাতৃভাষা থেকে বাংলার সঙ্গে ব্রিজিং পদ্ধতি থাকতে হবে।
 পর্যায়ক্রমে তিন বছরের মধ্যে সব আদিবাসী শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনতে হবে।
 বিভিন্ন আদিবাসী ভাষাকে লিখিত রূপ দিতে হবে।
 আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় লিখতে-পড়তে পারার যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
 ‘মাতৃভাষা শিক্ষা’ নয়, এটি হবে ‘মাতৃভাষায় শিক্ষা’। সংশোধনীর মাধ্যমে ‘য়’ বসিয়ে ‘মাতৃভাষায়’ করতে হবে।্র্র্র
 পাঠ্যপুস্তক, অভিধান ও বিশেষজ্ঞ তৈরি, শিক্ষক নিয়োগ ও্র প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দ্রুত নিরসন করতে হবে।
 বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক উন্নয়নকৃত আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার গল্পের বই, ছড়ার বই, বর্ণ শেখার বই যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্তকরণ।

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: সেভ দ্য চিলড্রেন ও জাবারাং কল্যাণ সমিতি ছয় বছর ধরে খাগড়াছড়ির কয়েকটি এলাকায় আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত করছে। ২০১৪ সাল থেকে সরকারও আদিবাসী ছয়টি ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটিসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ২০ থেকে ৩০ লাখ আদিবাসী রয়েছে। ৩০টির বেশি ভাষায় এরা কথা বলে। একটা ভাষার মধ্যে একটা জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি থাকে। আদিবাসী ভাষার চর্চা না থাকলে তাদের শত শত বছরের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। আদিবাসীদের এসব বিষয় যাতে না হারিয়ে যায়, সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে। আলোচনায় এসব বিষয় আসবে। এখন আলোচনা করবেন নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা।

নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা: ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে শান্তি চুক্তি হয়। এ আলোচনা শান্তি চুক্তির ফসল। তিনটি পার্বত্য জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। এ মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাগুলোর প্রশাসনিকসহ সার্বিক উন্নয়ন করা। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির মধ্যে ৭৮টি ধারা আছে। এর একটি ধারায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষার কথা বলা আছে। জাবারাং কল্যাণ সমিতি ও সেভ দ্য চিলড্রেন যেটা করছে, এটা ভলো উদ্যোগ। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ১১টি ভাষা রয়েছে সে ভাষার একজন শিক্ষার্থী তার ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি জানতে পারবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কতটুকু পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিখবে? এর একটা সীমারেখা নির্ধারণ করা জরুরি। প্রাথমিক শিক্ষা পর্যন্ত, নাকি তার পরও চলবে? কারণ, তাকে বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি অনেক বিষয় শিখতে হবে। প্রতিযোগিতায় টিকতে হবে। মাতৃভাষায় বেশি সময় ব্যয় করলে অন্যান্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। এটা তার পরবর্তী জীবনে প্রভাব পড়বে। তবে যেকোনো মানুষের জীবনের শিক্ষার শুরুটা মাতৃভাষার মাধ্যমে হওয়া উচিত। তাহলে সে তার সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে বুঝতে পারবে। এটা তার জীবন বিকাশে সহায়ক হবে।

কাজী আখতার হোসেন: সরকার শিশুদের শতভাগ ভর্তির বিষয়ে কাজ করছে। সরকার আদিবাসী শিশুদের শিক্ষার গুরুত্ব অনুভব করছে। বাংলাদেশে এখন প্রায় ৯৭ শতাংশ শিশু স্কুলে আসছে। উন্নত দেশেও শতভাগ ভর্তি নেই। আদিবাসীদের শিক্ষার প্রস্তুতিও বেশি দিনের নয়। আবার অগ্রগতিও আশাব্যঞ্জক নয়। আজকে আদিবাসীদের পাঁচটি ভাষা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। হয়তো অল্প সময়ের মধ্যেই এ ভাষায় পাঠদান শুরু হবে। আগে তো এসব আলোচনাই হয়নি। এখন সবাই প্রাথমিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। আমরা চাই না ভাষার ভিন্নতার জন্য কেউ পিছিয়ে পড়ুক।্র কিছু ক্ষেত্রে আমরা ভারত থেকে এগিয়ে আছি।
ছাত্রী ভর্তিতে অনেক এগিয়ে আছি। সরকার সবার সঙ্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করে। আপনাদের আমাদের ভাবনার মধ্যে ভিন্নতা নেই। সবার উদ্দেশ্য এক। আমাদের চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে। এই বৈচিত্র্যই আমাদের ঐশ্বর্য। অনাদর-অবহেলা বলে কিছু নেই। সরকার চায় সবাই শিক্ষিত হোক। আদিবাসীদের ভাষার কাজ শুরু হলে সুসমন্বিতভাবেই হওয়া উচিত। কাজটি করাও কঠিন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটি ৯০ লাখ। শিক্ষকের সংখ্যা তিন লাখ ৭৫ হাজার। ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদ দেখে। তারা ইচ্ছে করলে তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষককে নিয়োগ দিতে পারে। কিছু বিদ্যালয়ে আদিবাসী শিক্ষকদের নিয়োগের কথা বলেছেন। নিশ্চয়ই বিষয়টি ভেবে দেখব। আমার মন্ত্রণালয় থেকে যা কিছু করা দরকার সে সহযোগিতা দেব।

মো. শফিকুর রহমান: সরকার নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে মাতৃভাষায় শিক্ষা দিতে চায়। এ জন্য বিষয়টি সরকারি নীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এনজিওসহ অন্যদের অবদান আছে। সবাই যার যার অবস্থান থেকে কাজ করেছে। সবাই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। অনেক কিছু্রসহজভাবে আলোচনা হয়। সরকারি কাঠামোতে সেভাবে করা সম্ভব হয় না। সরকার কল্যাণের উদ্দেশ্য থেকে প্রতিটি কাজ করে।্র কিন্তু সমাজব্যবস্থায় একধরনের বৈষম্য থেকে যায়। যেমন সব সময় দেশের এক শ্রেণীর মানুষ তাঁদের সন্তানদের ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ান। এক শ্রেণী বাংলা মাধ্যমে পড়ে। এখানে একধরনের বৈষম্য হচ্ছে। সরকারের নীতি অনুযায়ী সব শ্রেণীর মানুষ যাতে প্রাথমিক শিক্ষায় আসে সরকার সে লক্ষ্যে কাজ করছে। পাঁচটি ভাষার মাধ্যমে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষার পাশাপাশি বাংলায় অ, আ-সহ কিছু অক্ষরের পরিচয় ঘটানোর কথাও চিন্তা করা যায়। এখান থেকেই ব্রিজিং ব্যবস্থাটি থাকলে ভালো হবে।্র আমরা যেভাবে এগোচ্ছি তাতে খুব বেশি সময় লাগবে না। ২০১৫ সাল থেকেই শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করতে পারব।

সঞ্জীব দ্রং: শিক্ষানীতিতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত আদিবাসীদের শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। মাতৃভাষায় শিক্ষা কত দূর পর্যন্ত যাবে, সেটি একটি প্রশ্ন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ৬(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সকল মানুষ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবে।’ কিন্তু আমার প্রশ্ন, চাকমা, গারো ত্রিপুরা ইত্যাদি অসংখ্য জাতিসত্তার মানুষের বাঙালি হওয়ার প্রয়োজন আছে কি? সংবিধান এত জাতিসত্তাকে বাঙালি বানাতে পারে না। এটা করে আমাদের প্রান্তিক জায়গায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তবে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার ক্ষেত্রে সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো অভাব দেখিনি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। শিক্ষানীতিতেও আদিবাসীদের শিক্ষার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে। আমরা কিছু অভিজ্ঞ লেখকের নাম দিয়েছি। তাঁরাসহ আরও ১০-১২ জন মিলে ঠিক করবেন কীভাবে প্রতিটি জাতিসত্তার পূর্ণ প্রতিফলন নিয়ে পাঠ্যপুস্তক রচিত হবে। এই পাঠ্যপুস্তক রচিত হতে কেন ২০১৫ সাল লাগবে বুঝতে পারছি না, কেন এটি ২০১৪ সলের মার্চ-এপ্রিলে হবে না? একবার শুরু না হলে আদৌ শুরু হবে কি না এটি নিয়ে একধরনের শঙ্কা থেকে যায়। কিন্তু যেকোনোভাবে শুরু হলে ভুলত্রুটি সংশোধন করার সুযোগ থাকবে।্র

মেহেরুন্নাহার স্বপ্না: বহুভাষিক শিক্ষা বা মাতৃভাষায় শিক্ষাপদ্ধতি হচ্ছে একটি শ্রেণীতে মাতৃভাষায় শিক্ষা দানের পাশাপাশি এক বা তার চেয়ে বেশি ভাষাকে ব্যবহার করা। এই পদ্ধতিতে ব্রিজিং একটি অন্যতম উপাদান, যেখানে শিশু প্রথম পর্যায়ে মাতৃভাষায় গান, কবিতা, গল্প, ছড়া শুনবে এবং খেলার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা লাভ করবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে সে মাতৃভাষায় বিভিন্ন বিষয় জানবে, পড়বে ও লিখবে এবং বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচিত হবে। তৃতীয় পর্যায়ে মাতৃভাষার পাশাপাশি বাংলায় পড়বে ও লিখবে এবং ইংরেজি ভাষায় পড়াশোনা শুরু করবে। এভাবেই শিশু প্রথমে মাতৃভাষায়, পরে জাতীয় ভাষায় তার আত্মবিশ্বাস তৈরি করবে। আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রিজিং সময়টা হওয়া উচিত কমপক্ষে সাত বছর, প্রি-প্রাইমারি দুই বছর থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। আরও দেখা গেছে, একজন শিশু সফলভাবে একসঙ্গে তিনটি ভাষা শিখতে পারে।
সেভ দ্য চিলড্রেন জাবারাং কল্যাণ সমিতি, বলীপাড়া নারী কল্যাণ সমিতি ও রাখাইন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজারে ত্রিপুরা, চাকমা, মারমা, ম্রো, রাখাইন—পাঁচটি ভাষাগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে কাজ করছে। এ পর্যন্ত ছয় হাজার ৭৭৭ জন আদিবাসী শিশু এসব প্রাক-প্রাথমিক থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। প্রতিটা ভাষার ক্ষেত্রে সে ভাষার বিশেষজ্ঞরা শিক্ষা উপকরণ তৈরি করেছেন। ফলে তাদের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং লোকজ নিয়ে গল্পের বই, ছড়ার বই, বর্ণ শেখার বই তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ভাষার জন্য শিক্ষক রয়েছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকেরা নিজের ভাষায় বিশেষ দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
২০১০ সালে সেভ দ্য চিলড্রেনের পক্ষ থেকে মাতৃভাষার মাধ্যমে ও বাংলা ভাষার মাধ্যমে পরিচালিত প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আদিবাসী শিশুদের ওপর তুলনামূলক গবেষণায় দেখা গেছে যে মাতৃভাষায় পরিচালিত প্রাক-প্রাথমিকের শিশুরা শ্রেণীতে ৮০ শতাংশ সময় শিক্ষকদের সঙ্গে পড়াশোনায় একাত্ম থেকেছে। কারণ, তারা শিক্ষকদের নির্দেশনা, গল্প, ছড়া—সবকিছু ভালো বুঝতে পারে এবং আনন্দ পায়। অন্যদিকে বাংলা ভাষার মাধ্যমে পরিচালিত প্রাক-প্রাথমিকে থেকেছে ৪০ শতাংশ সময়। কারণ, গল্প, ছড়া বাংলা শিশুদের কাছে অপরিচিত।
২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার কথা বলা আছে। সরকার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাদ্রি পাঁচটি জাতিগোষ্ঠীর ভাষা প্রি-প্রাইমারি থেকে শুরু করবে। আশা করছি, ২০১৪ সালের শেষ বা ২০১৫ সালের শুরুতে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা আরম্ভ হবে। বিভিন্ন সংস্থা আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কর্মসূচি পরিচালনা করছে এবং মাতৃভাষায় প্রচুর গল্পের বই, ছড়ার বই, বর্ণ শেখার বই তৈরি করেছে। এগুলো যাচাই ও বাছাইয়ের মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করলে সরকারের কাজ সহজ ও দ্রুততর হবে।

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা: আদিবাসীদের জন্য সম্ভাবনা-সমস্যা দুটোই আছে। নীতিনির্ধারণী মহল এ নিয়ে কাজ করেছে। সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ইতিমধ্যে পাঁচটি আদিবাসী ভাষা নিয়ে কাজ করেছে। হয়তো নিকটতম কোনো্রসময়ে পাঠদান শুরু করতে পারবে। নীতিনির্ধারণী মহলে আগে এ নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না। তাই এখন যতটুকু কাজ হচ্ছে একে অগ্রগতি হিসেবে দেখছি। মাতৃভাষায় শিক্ষার বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সভা করেছি। এখানে কিছু সমস্যা্ররয়েছে দেখতে পেয়েছি। যেমন আদিবাসীদের ভাষাসংশিষ্ট বিষয়ে জাতীয়ভাবে কোনো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান নেই। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজের ভাষায় লেখালেখি বা শিক্ষকতা করতে পারেন এমন মানুষের অভাব। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। ভাষাগুলোর পর্যাপ্ত লিখিত উপাদান নেই। ভাষাগুলোর লিখিত উপাদান কম। কালচারাল উপাদানে মৌখিকভাবে রয়েছে কিন্তু লিখিত রূপ নেই। এগুলোর লিখিত রূপ মাতৃভাষার প্রাথমিক শিক্ষাকে বিকাশ ও প্রসারের জন্য কাজ করতে পারে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে থাকার কথা। এখন কেবল প্রাথমিক শিক্ষা তাদের অধীনে আছে। পার্বত্য জেলা পরিষদ নিজেদের সেভাবে প্রস্তুত করতে পারেনি। পার্বত্য চুক্তি অনুসারে মাতৃভাষায় শিক্ষা তাদের পরিচালনা করার কথা ছিল। তিনটি পার্বত্য জেলায় পিটিআই পূর্ণাঙ্গ হলে মাতৃভাষায় শিক্ষাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।
কিছুদিন আগে আদিবাসীদের ভাষা শিক্ষার বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য শিক্ষা আইন উন্মুক্ত করা হয়েছিল। আমরা মতামত দিয়েছি। আশা করি, আইনে এর প্রতিফলন ঘটবে। প্রচুর সহায়ক উপকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেসব শিশু ভর্তি হয়েছে, অন্য সব শিশু থেকে তারা সব বিষয়ে অনেক বেশি এগিয়ে আছে। তাদের ফলাফল এক থেকে দশের মধ্যে থাকে। তার শিক্ষকের প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। অন্যদের জড়তা থাকে।

আন্না মিন্য: এখন পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হতে যাচ্ছে। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে কী হবে? কোথায় শেষ হবে? কিছুই জানি না। মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রয়োজন। আবার সব আদিবাসী শিশু শিক্ষা পাচ্ছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। প্রক্রিয়া শুরুর প্রয়োজনে কিছু শিশু শিক্ষা পেল। এভাবে হলে এ শুরু অর্থহীন হবে। আদিবাসী এলাকায় সরকারি স্কুলে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের ভাতা ও প্রশিক্ষণের্র ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাহলে শিক্ষাকে চালিয়ে নিতে পারবে। নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, বাঙালি, আদিবাসী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী—এসব বিভেদ দূর করতে হবে। বিভেদ থাকলে কোনো জাতি দাঁড়াতে পারে না। এখানে পাঁচ বা ছয়টি ভাষাকে নির্বাচন করা হয়েছে। এটি একাংশিক উন্নয়নের ভাবনা। আদিবাসীদের আর্থসামাজিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাদের ভূমি দখল হচ্ছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা—সবকিছুতে চরম সংকটে রয়েছে। এসবের উন্নয়ন না হলে সামগ্রিক উন্নয়ন হবে না। সামগ্রিক উন্নয়ন না হলে একটা জাতিগোষ্ঠী টিকে থাকতে পারে না। এসব বিষয় দ্রুত বিবেচনায় আনতে হবে।

প্রশান্ত কুমার ত্রিপুরা: শব্দের রাজনীতিতে আদিবাসীরা পিছিয়ে আছে। সংবিধানে আদিবাসী শব্দটির ঠাঁই হয়নি। সরকারিভাবে এ শব্দটি নিরুৎসাহিত। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে এসব জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ‘মাতৃভাষা শিক্ষা’, ‘মাতৃভাষায় শিক্ষা’ নয়। যারা এটি করেছেন, তাঁরা ভুল করেননি। পরিকল্পিতভাবে করেছেন। শিক্ষানীতিতে আদিবাসী শব্দটি ছিল। কিন্তু সংবিধানে যেহেতু নেই, তাই শব্দটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীতে পরিণত হলো। মৌলিক এ জায়গা ঠিক না করে আমরা যত কিছু করি তার যোগফল হবে শূন্য। এটাও পরিষ্কার হওয়া দরকার যে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা না মাতৃভাষা শিক্ষা? অবশ্যই্র শিক্ষা হবে মাতৃভাষায়। এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে প্রথম পর্যায়ে ছয়টি আদিবাসী ভাষায় শুরু করার কথা ২০১৪ সালে। কিন্তু মৌলিক বিষয় সমাধান না হলে এটি কখন শুরু হবে বলা মুশকিল। হয়তো ২০১৪ সালেও শুরু হবে না।