ইতিহাসচর্চায় অনাগ্রহ

কয়েক দিন আগে এই পত্রিকায় ‘ইতিহাস জানা, না-জানা’ নামে একটি উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছিলাম। লেখাটির বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক প্রীতিভাজন নূরুল কবিরের। বস্তুত অর্থে তাঁর জিজ্ঞাসার আলোকেই আজকের এই লেখা।
আসলেই লেখাটিতে বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস বিষয়ে কোনো প্রসঙ্গ ছিল না। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ অবধি বাংলাদেশের ইতিহাস যেভাবে জানা যায়; প্রাচীন ইতিহাস সেভাবে জানা যায় না। তথ্য-উপাত্ত ঘাটতির কারণেই তা হয় অসম্পূর্ণ। প্রাচীন ইতিহাস লেখার দায়িত্ব যাঁরা বিশ্বস্ততার সঙ্গে শুরু করেছিলেন—সেই ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, যদুনাথ সরকার, দীনেশচন্দ্র সরকার, নীহাররঞ্জন রায়, সরসীকুমার সরস্বতী, প্রমোদলাল পাল ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর ভারতে চলে যান। তাঁদের চলে যাওয়ার পর আজ ২০১৪ সাল চলছে, কিন্তু তাঁদের দেখানো পথ ধরে ওই ইতিহাসের কাজ আর এগোয়নি। অথচ গত ৬৬ বছরে বাংলাদেশের নানা জায়গা থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও উৎখননের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ পুরাকীর্তি উদ্ধার করা হয়েছে, যা বিভিন্ন জাদুঘরে সংগ্রহে রয়েছে। প্রস্তর-ধাতব-মৃন্ময় ভাস্কর্য, লেখমালা শিলালিপি-তাম্রশাসন, মুদ্রা, মৃৎভান্ড, শিল প্রভৃতি যে পরিমাণে পাওয়া গেছে, তাতে করে আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের পরিকাঠামোর অপূর্ণতা পূরণ করা সম্ভব। এসব কাজ করার দায়িত্ব দেশের খ্যাতিমান ইতিহাসবেত্তাদের। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনেক ঐতিহাসিকই রয়েছেন দেশে। তাঁরা বোধ করি আদৌ ইতিহাসের আদি পর্ব নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। ঔদাসীন্য সরকারের দিক থেকেও অনেক। প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নিজেরাও জানে না দেশে কতগুলো প্রত্নস্থল আছে! তাদের কাছে এসবের বিবরণসংবলিত যে তালিকা আছে, তা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়; তার বাইরেও স্থান রয়ে গেছে। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জরিপ রিপোর্টগুলো দেখলেই এর সত্যতা সম্পর্কে জানা যায়। এর চেয়েও দুঃখজনক যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত (?) প্রত্নপীঠগুলোর অনেকগুলোর করুণ দশা। কোথাও তা কৃষিজমি হয়ে গেছে, কোথাও হয়েছে বাড়িঘর, কোথাও বা শবাগার হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। সেগুলো যে সরকারের সংরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা, তা বোঝানোর কোনো উপায় নেই।
এসব প্রত্নপীঠ যে কত গুরুত্ববহ, তা প্রমাণিত হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে। নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর, মুন্সিগঞ্জের ব্রজযোগিনী, দিনাজপুরের সীতাকোঠ বিহার, পঞ্চগড়ের ভিতরগড় প্রভৃতি স্থানে বিজ্ঞানভিত্তিক খননের ফলে যেসব স্থাপনা ও নিদর্শন পাওয়া গেছে, তা আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের কাঠামো পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বৈকি!
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ অব্দের প্রাচীন নগর, বগুড়ার পুণ্ড্রবর্ধন নগরকে আদি-ঐতিহাসিক কালের সর্বপ্রাচীন স্থাপনা হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু উয়ারী-বটেশ্বরের স্থাপনা ও উদ্ধার করা নিদর্শনগুলো পর্যবেক্ষণ করে অনুমান করা হচ্ছে, এ স্থানটি পুণ্ড্রবর্ধন অপেক্ষা আরও অন্তত ২০০ বছরের পুরোনো। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অনেকে মনে করেন, দেশের সব প্রত্নপীঠই পর্যায়ক্রমে খনন করা অত্যন্ত জরুরি। অন্তত দেশের প্রাচীন ইতিহাস রচনার স্বার্থেই এ কাজগুলো সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
এখনো আমরা জানি না, পাল কিংবা সেন রাজাদের রাজধানী কোথায় ছিল! কোথায় ছিল রামাবতী, বিজয়নগর কিংবা ‘তবকাৎ-ই-নাসিরি’তে উল্লিখিত লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী নওদা বা নওদিয়া? তথ্যের অপ্রতুলতার কারণেই রমেশচন্দ্র মজুমদার কিংবা রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বরেণ্য ঐতিহাসিকেরা সে সময় এসব বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়ে যেতে পারেননি। এখন বোধ করি আমাদের ইতিহাসবেত্তারা প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণার মাধ্যমে সে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন—এমন আশাবাদ অনেকেরই।
কয়েক বছর আগে, সেনরাজ লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি ‘গীত গোবিন্দ’ খ্যাত জয়দেবের বসতবাটির সন্ধান পাওয়া গেছে জয়পুরহাটের আমদই ইউনিয়নের কেন্দুলি গ্রামে। জয়দেবের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ও দিঘি এখনো রয়েছে। এত দিন মনে করা হতো, পশ্চিমবঙ্গের অজয় নদের তীরের কেন্দুবিল্বই ছিল তাঁর জন্মস্থান। তথ্যটি সঠিক নয়। আসলে জয়দেবের স্মরণে তাঁর নিজ গ্রামের নামে সেখানে কেন্দুবিল্ব (কেন্দুলির সমার্থক) নামকরণ
করা হয়েছে।
প্রাচীন ইতিহাসের বিষয়ে আদতেই আমাদের কৌতূহলের অভাব রয়েছে। প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, কদাচিৎ এ বিষয়ে বইপত্র প্রকাশিত হয়। ইতিহাসের এক প্রবীণ অধ্যাপক আমাকে বলেছিলেন, গত দুই দশকে একুশের বইমেলায় ঘুরে ঘুরে কুড়িটিও ইতিহাস বই পাননি তিনি। মেলায় প্রতিবছর হাজার হাজার নতুন বই আসে, অথচ ইতিহাসের বইয়ের কী দুর্দশা!
শুধু প্রাচীন নয়, সব ইতিহাসের প্রতিই আগ্রহ বাড়াতে হবে। কারণ, ইতিহাসের শিক্ষাই তো জাতিকে সামনে যাওয়ার পথের সন্ধান দেয়।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]