বাংলাদেশের ভাবমূর্তি

বর্তমানে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি দাঁড়িয়েছে, তা স্বস্তিদায়ক নয়। বিশেষত, ব্যবসা-বাণিজ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ বিদেশি ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের জন্য পছন্দের দেশের তালিকা থেকে অনেক পেছনে। সবাই মিলে দ্রুতই এর ইতি টানতে হবে।
তাজরীন ফ্যাশনসের আগুনে পুড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের মুখ। রানা প্লাজার ভবনধসের তলায় চাপা পড়েছিল পোশাকশিল্পে বিনিয়োগকারী ও বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এল রাজনৈতিক কারণে সৃষ্টি হওয়া সার্বিক অচলাবস্থা। এ পরিস্থিতিতে নতুন বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময়ে ব্যবসায়ী নেতারা তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই উদ্বেগ ব্যবসায়ীদের নিজস্ব স্বার্থের বিচারে হলেও, এর মধ্যে দেশের স্বার্থের কথাও প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
গত মঙ্গলবার রাজধানীতে আয়োজিত এক সভায় ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বিদেশি ক্রেতাদের এ দেশ সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে কেবল পোশাকশিল্পের ক্রেতারাই বিদেশে চলে যাবেন না, অন্যান্য খাতেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও অন্যান্য কারণে এই প্রথমবারের মতো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও কমে গেছে। এই অশনিসংকেত পাঠ করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই সময়। মনে রাখতে হবে, বিশ্ব মুখ ফিরিয়ে নিলে সবারই ক্ষতি।
পোশাকশিল্পে অনাস্থা সৃষ্টির দায় প্রধানত উদ্যোক্তাদেরই। নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন, শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদায় কর্ম করিয়ে নেওয়া এবং জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যর্থতার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। অন্যদিকে রাজনৈতিক সংঘাত অর্থনীতিকে প্রায় অবশ করে ফেলার পর্যায়ে চলে যাওয়ার দায় রাজনীতিকদের। রাজনীতি শেষ বিচারে অর্থনীতিরও ব্যবস্থাপনা। সরকার ও বিরোধী দলের রেষারেষির জন্য সেই ব্যবস্থাপনায়ও বিপর্যয় নেমেছিল। এর ফল হলো প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে যাওয়া।
ব্যবসায়ীরা এই অবস্থা থেকে উত্তরণে দ্রুতই একটি টাস্কফোর্স গঠনের পরামর্শ দেন বাণিজ্যমন্ত্রীকে। এই টাস্কফোর্সের লক্ষ্য হবে দুটি: এক, প্রধান প্রধান অর্থকরী খাতের সমস্যা চিহ্নিত করে উত্তরণের পদক্ষেপ নেওয়া এবং দুই, ব্যবসা ও উৎপাদনসহায়ক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাধাগুলো চিহ্নিত করা। এই কাজটির দায়িত্ব প্রধানত সরকারের হলেও, বিনিয়োগকারীদের সহায়তাও প্রয়োজন। এই দুটি কাজ মোটামুটি করা গেলে ভাবমূর্তির ফাটল দ্রুতই বুজিয়ে ফেলা সম্ভব হবে।
ব্যবসায়ীরাও প্রতিযোগিতার মধ্যেই মুনাফা করেন। বাণিজ্যিক রেষারেষির মধ্যেও তাঁরা একধরনের স্থিতিশীল বন্দোবস্ত করে নিয়েছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রাজনীতির প্রতিযোগিতা বারবারই পরস্পরের বিনাশের দিকে চলে যায়। এর পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে, রাজনীতির সব পক্ষকে ‘খেলার নিয়ম’ নতুন করে ঠিক করতে হবে এবং সুস্থ প্রতিযোগিতার শর্তগুলো মানার বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে সমঝোতা প্রয়োজন। কেবল এর ভিত্তিতেই শ্রমের মজুরি, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, ঋণ ও অবকাঠামোর মতো বিষয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করা সম্ভব।
সময়ের প্রয়োজন মেটানোর দায় সরকারের ওপরই বর্তায়। তাদের দেখাতে হবে, দায়িত্ব নিতে তারা সক্ষম।