হাজার কোটি অলস টাকা ও ব্রডব্যান্ডের কান্না

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

ঈদ উপলক্ষে প্রায় ৬৫ লাখ লোক ঢাকা ছেড়ে তাঁদের গ্রামে গেছেন। এ ছাড়া অন্য শহরগুলো থেকেও আরও প্রায় ৫০ লাখ লোক নিজেদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। তাঁদের বিপুল অংশই স্মার্টফোনটি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন। এই ছুটির সময়জুড়ে তাঁদের এই ফোন কেবল কথা বলা বা বার্তা আদান-প্রদানের কাজে ব্যবহার হবে তা নয়; বরং এর বহুমুখী ব্যবহারই হবে, বিশেষ করে ইন্টারনেটের ব্যবহার। তাঁদের কেউ কেউ ছোটবেলার বন্ধুদের খুঁজে পাবেন, তাঁদের সঙ্গে সারা দিন কাটাবেন। স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ছবি তুলবেন এবং তারপর সেই ছবি ছড়িয়ে দিতে চাইবেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে, যাতে অন্যরাও শরিক হতে পারে আনন্দের। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর সঙ্গে থেকে যাওয়ার জন্য বাড়ির বড় ছেলে এবার গ্রামের বাড়িতে আসতে পারেনি। মা ছোট ছেলেকে বলবে গরুর ছবি তুলে সেটি বড় ভাইকে পাঠাতে। চৌকস ছোট ছেলে তখন বলবে, ‘দাঁড়াও মা, তোমাকে দেখাই ভাই-ভাবি এখন কী করছে।’ এই বলে সে তার ভাইবার বা হোয়াটসঅ্যাপের ভিডিও কল চালু করবে। এবং তারপর থেকেই শুরু হবে তার যন্ত্রণা। পর্দাজুড়ে কেবল ঘোরা আর ঘোরা, ভাই-ভাবির ছবি আর সেখানে আসবে না! 


বাংলাদেশকে বলা যায় একটি ব্রডব্যান্ড গ্রাম। রাজধানী ঢাকার একটি অংশ এবং কয়েকটি বড় শহর ছাড়া দেশের কোথাও দ্রুতগতির ইন্টারনেট নেই। নেই যে নেই, এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথাও নেই। দেশের কোথাও সুস্থির মতো শান্তভাবে দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ নেই। কয়েক বছর আগে খুব ঘটা করে তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু কররেও সেটা কিন্তু সারা দেশে সেভাবে পৌঁছায়ওনি। আর সত্যিকারের ব্রডব্যান্ড? নৈব নৈব চ! বেশির ভাগ সময় কোনো ভিডিও আপলোড করা যায় না, কোনো কোনো সময় একটা পোস্ট দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে হয় এবং কখনো বড় রাস্তার পাশে গিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করার চেষ্টা করতে হয়। অথচ শুধু পার্শ্ববর্তী দেশ নয়, বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এখন চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা চালু করার পাশাপাশি সবার জন্য ব্রডব্যান্ড চালুর ব্যাপারে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা এমনকি দুই বছর আগে তামাদি হয়ে যাওয়া জাতীয় ব্রডব্যান্ড নীতিমালাটিকেও হালনাগাদ করতে পারিনি।

এসবের মধ্যে জানা গেল, বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলে হাজার কোটি টাকার বেশি অলস পড়ে আছে। এই টাকা দিয়ে তারা কী করবে, তা নাকি এখনো ঠিক করতে পারেনি। অথচ অপারেটরদের কাছ থেকে এই টাকা আদায় করা হচ্ছে ২০১১ সাল থেকেই। এই হাজার কোটি টাকার একটি অংশ সুবিবেচনার সঙ্গে খরচ করতে পারলে এরই মধ্যে আমাদের ব্রডব্যান্ড অবকাঠামো ছড়িয়ে দিতে পারতাম সারা দেশেই।

ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এখন বিশ্বজুড়ে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি পাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ এর বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও দিনবদলের শক্তি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি হাজার নতুন সংযোগের ফলে আটটি নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হয়। ফলে কর্মসংস্থান বাড়ে এবং মানুষের জীবনমানও বাড়ে। আবার তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের প্রভাবে শিক্ষাক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুক্ত দর্শনের বিকাশ। ফলে বাংলাদেশের একজন শিক্ষার্থী ইচ্ছা করলেই (এবং ব্রডব্যান্ডে প্রবেশাধিকার থাকলে) বিশ্বের বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সে অংশ নিতে পারে। এমআইটি, স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষা কার্যক্রমকে ইন্টারনেটে উন্মুক্ত করছে।

অন্যদিকে, ইন্টারনেটের কারণে উন্নত বিশ্বের অনেক কাজ এখন আমাদের মতো দেশের তরুণ-তরুণীরা ঘরে বসেই করতে পারে। একটি বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান বিগত ৫০ থেকে ৬০ বছরে প্রায় ৫০ হাজার পরিবারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। অথচ ইন্টারনেটে স্বাধীন ব্যবসার মাধ্যমে মাত্র পাঁচ বছরেই প্রায় ৩০ হাজার ছেলেমেয়ে নিজেদের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পটি জ্ঞানভিত্তিক কার্যক্রম বলে এর প্রকৃত মূল্যায়ন করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর ২০ বিলিয়ন ডলারের একটা রিজার্ভ গড়ে তুলতে আমাদের প্রায় ৪২ বছর লেগেছে। অথচ ‘হোয়াটসঅ্যাপ’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন মাত্র ১৯ বিলিয়ন ডলারে বেচাকেনা হয়েছে। ‘অ্যাংরি বার্ড’ নামের একটি গেমস বিক্রি হয়েছে মাত্র ৮০ মিলিয়ন ডলারে! তার মানে হলো, তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ও উদ্ভাবনী ব্যবহার বাড়াতে পারলে জাতীয় আয় বৃদ্ধির যে স্বপ্ন আমরা দেখি, তার পথে এগোনোর একটা সুরাহা হয়।

আর এ কারণেই দরকার সারা দেশে ব্রডব্যান্ড ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা আগে জানতাম, ব্যান্ডউইথের উচ্চমূল্যের কারণে এটি সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এ সরকারের চেষ্টায় ২০০৬ সালে যে ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ৮৪ হাজার টাকা, সেটি এখন নেমে এসেছে মাত্র ৫০০ টাকায়! অথচ তারপরও রাজধানীর বাইরে বলতে গেলে ব্রডব্যান্ড সেবার কোনো প্রসার নেই। সম্বল বলতে মোবাইল অপারেটরদের উচ্চমূল্যের দুর্বল সেবা। সত্যিকারের ব্রডব্যান্ড বিকাশের জন্য দরকার ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি। আর ব্যবহারকারীর কাছে সংযোগ পৌঁছানোর সমাধান।

যেসব সংস্থা ব্রডব্যান্ডকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করছে, তাদের বক্তব্য হলো, অবকাঠামোগত সুবিধা তৈরি করে একটি জেলা বা উপজেলা শহরে ব্রডব্যান্ড সেবা চালু করে সেটি বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করার মতো পর্যাপ্ত গ্রাহক সেখানে নেই। গ্রাহক তৈরি হলেই কেবল এই সেবা সম্প্রসারণ করা সম্ভব। অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে দেখা যায়, দেশের আনাচকানাচে তরুণ-তরুণীরা ব্রডব্যান্ডের আশায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছে।

এ ক্ষেত্রে সরকারকেই একটি বড় উদ্যোগ নিতে হবে। দুই বছর মেয়াদি একটি উদ্যোগ হতে পারে, দেশের সব জেলা ও উপজেলা সদরে অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ বিনা তারের ও বিনা মূল্যের ব্রডব্যান্ড সেবা চালু করা। এই সেবাগুলো চালু করে সেখানে দুই বছরের জন্য ব্যান্ডউইথ ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ দেওয়া। তবে এই সেবাগুলো নামকাওয়াস্তে চালু করলে হবে না। কমপক্ষে সেকেন্ডে ১০ মেগাবাইট ব্যান্ডউইথের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই এই সেবা চালু রাখার জন্য তা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে তারাই এটি চালু রাখবে। অন্যদিকে, এই কার্যক্রমের ফলে প্রতিটি স্থানে ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। ফলে ইন্টারনেট সেবাদানকারী সংস্থাও বাণিজ্যিকভাবে সেবা দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হবে।

বিটিআরসিতে পড়ে থাকা অলস হাজার কোটি টাকার সামান্য অংশ দিয়েই এই কাজটা করে ফেলা সম্ভব। পাবলিক স্পটের পাশাপাশি সব বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় কলেজগুলোতেও বিনা মূল্যের এই ব্রডব্যান্ড সেবা সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।

তাহলে হয়তো আমাদের তরুণদের একটা বড় অংশ গ্রামের পুকুরপাড়ে বসে-শুয়ে নিজেদের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারত।

মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি