ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ ও ছাত্রলীগ

ঈদুল আজহা উপলক্ষে কয়েক দিনের জন্য কলেজ বন্ধ ঘোষণার পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে একজন অভিভাবক বললেন, ‘যে কটা দিন ছুটি থাকে, একটু শান্তিতে থাকি। কলেজ খুললেই তো দুশ্চিন্তার শেষ নেই, অফিসে বসেও খোঁজখবর নিতে থাকি ছেলেটা ঘরে ফিরল কি না।’ অথচ এই অভিভাবকই কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে তাঁর ছেলের ভর্তি হওয়ার সুসংবাদ ফেসবুকে বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেছিলেন একজন গর্বিত পিতা হিসেবে।

কোনো সন্দেহ নেই চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে পড়ার সুযোগ পাওয়া এ অঞ্চলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য গৌরবেরই বিষয়। পাশাপাশি অবস্থিত এ দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আগ্রহের কারণ কিছুটা আঁচ করা যায় পরীক্ষার ফলাফল দেখলে। এ ছাড়া অবকাঠামোগত সুবিধা, শিক্ষকদের সংখ্যা ও যোগ্যতা ইত্যাদি গুণ-মান বিবেচনা করলে দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় ওপরের দিকে রাখতে হবে কলেজ দুটিকে। কিন্তু এত কিছুর পরও ভালো নেই দুই কলেজের ৩০ হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকেরা।

কলেজের শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও অভিভাবকদের স্বস্তির জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ ও ছাত্রলীগ। একই ছাত্রসংগঠনের নাম তিনবার উচ্চারিত হলো এ কারণে যে ইসলামী ছাত্রশিবির বা ছাত্রদল তো নয়ই, অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের কর্মকাণ্ড এখানে প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ ছাত্রলীগেরই তিনটি উপদলের সংঘর্ষে নিয়মিত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ক্যাম্পাস। প্রতিপক্ষ নেই বলে এখানে নিজেরাই নিজেদের সঙ্গে লড়ছে ছাত্রসংগঠনটি। শুধু এ দুটি কলেজ তো নয়, এই এলাকার আরও তিনটি স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদেরও আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। সংঘর্ষের বিস্তৃতি কখন কত দূর পর্যন্ত গড়াবে, তার আগাম অনুমান তো সম্ভব নয়। সংঘর্ষ কলেজের আঙিনা থেকে প্রায়ই ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের এলাকায়। ভীত–সন্ত্রস্ত শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের দিশেহারা অবস্থা, কলেজ রোডে পথচারী ও যানবাহনের দিগ্‌বিদিক ছোটা—সব মিলিয়ে এক নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয় তখন।

প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছাত্রদের ধাওয়া করছে এক যুবক—এ রকম ছবিও ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। অথচ কি প্রশাসন, কি কলেজ কর্তৃপক্ষ, কেউই এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে পারছে না। পারছে না কারণ ছাত্রলীগের এই তিন উপদল মহানগর আওয়ামী লীগের তিন নেতার সমর্থনপুষ্ট।

নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী দ্বিধাবিভক্ত ছাত্র-কর্মীরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো বটেই, পাড়া-মহল্লায়ও নিজেদের শক্তির মহড়া দিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলামের সমর্থক ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ।

ছাত্রলীগের বিবদমান গ্রুপগুলোর বিরোধ মীমাংসার চেষ্টায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা নানা সময়ে নানা রকম পরামর্শ দিয়েছেন। মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসভবনে এক সভায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ‘কারও পকেটের রাজনীতি’ না করার উপদেশ দিয়েছিলেন। বিরোধ মীমাংসার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীমকে। এমনকি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে কেন্দ্রে তলব করেছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

সর্বশেষ গত ১৩ আগস্ট চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজ ছাত্রলীগের বিবদমান গ্রুপগুলো বৈঠক করে নিজেদের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছেছিল। কিন্তু এর মাত্র ছয় দিনের মাথায় নতুন করে সংঘর্ষে জড়িয়ে কর্মীরা জানান দিয়েছেন, আধিপত্য বিস্তারের জায়গাটিতে ছাড় দিতে রাজি নয় কোনো পক্ষই।

এবার একটু পেছন ফিরে তাকাই। আশির দশকের শুরু থেকেই দীর্ঘকাল চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজে একক দখলদারি বজায় রেখেছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম কলেজের পেছনের গেটে ছাত্রলীগের মিছিলে হামলা চালিয়ে তবারককে হত্যা করে, ১৯৮৪ সালে এই কলেজেরই ছাত্রাবাসে ঘুমন্ত অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী শাহাদাতকে নৃশংসভাবে জবাই করে প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল তারা।

নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে কলেজসংলগ্ন দেবপাহাড় এলাকার বাসভবন থেকে ছাত্রলীগের এক কর্মীকে কলেজে তুলে এনে ড্রিল মেশিন দিয়ে হত্যা করেছিল শিবিরের ক্যাডাররা। এরপর থেকে ক্যাম্পাসে আর টুঁ শব্দ করার সাহস বা সুযোগ পায়নি অন্য কোনো ছাত্রসংগঠন। এর মধ্যে দেশে সরকার পরিবর্তন হয়েছে বারবার। কিন্তু প্রায় প৩৫ বছর এ দুটি কলেজে শিবিরের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা খুব একটা হয়নি। ছাত্রাবাস, কলেজসংলগ্ন চকবাজার ও চন্দনপুরা এলাকাজুড়ে শিবির তাদের সমর্থকদের জন্য অবাধ বিচরণক্ষেত্র গড়ে তুলেছিল। নানা নামে কোচিং সেন্টার, এলাকায় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বায়তুল মাল আদায়, ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের কাছে গাইড বুক বিক্রি ইত্যাদি নানা লাভজনক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে সংগঠনের আর্থিক দিকটাও পোক্ত করে নিয়েছিল তারা। অন্যদের রাজনৈতিক তৎপরতা তো বন্ধ ছিলই, উপরন্তু সহশিক্ষা কার্যক্রম যেমন জাতীয় দিবসগুলো উদ্‌যাপন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা বিতর্ক অনুষ্ঠান ইত্যাদিও হয়েছে তাদের পরিচালনায়, তাদের নিজস্ব নিয়মে। অধ্যক্ষ থেকে কলেজের শিক্ষকমণ্ডলী—সবাইকেই মেনে চলতে হয়েছে শিবিরের অলিখিত নির্দেশাবলি।

তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, শিবির এই দীর্ঘকাল নিজেদের কোনো অন্তঃকোন্দলকে প্রকাশ্যে আসতে দেয়নি। ক্যাম্পাসে শিবিরের সমর্থকেরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছে, এমন কোনো উদাহরণ নেই।

অবশেষে ২০১৫ সালে প্রশাসনের পরোক্ষ সহযোগিতায় চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজ থেকে শিবিরকে বিতাড়িত করে মহানগর ছাত্রলীগ। ধারণা করা হয়েছিল, দীর্ঘকাল পর শিবিরমুক্ত ক্যাম্পাসে আবার প্রগতিশীল ধারার রাজনীতির সূচনা হবে। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন নিজেদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আবার প্রাণবন্ত করে তুলবে ক্যাম্পাস। কিন্তু তা তো হয়ইনি, বরং অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা উত্তপ্ত কড়াই থেকে পড়েছেন জ্বলন্ত উনুনে।

চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজে ঈদুল আজহার ছুটির আগে ৪০ দিনে অন্তত চারবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে ছাত্রলীগ। এতে আহত হয়েছে ১৫ জনের বেশি। এই অরাজক অবস্থা কি চলতেই থাকবে? এ প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত জানা নেই ছাত্রলীগ নগর কমিটির নেতাদেরও। এ কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম বলেছেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজে কারা রাজনীতি করবেন। কলেজ দুটিতে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি না থাকায় কারও বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোনো অবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি। তবে কমিটি গঠিত হলেই যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের তৎপরতা তার প্রমাণ।

আমাদের ধারণা, এই বিরোধ মীমাংসার দায় এখন নগর আওয়ামী লীগের দুই নেতার। উদ্যোগ নিতে হবে তাঁদেরই। মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির সমঝোতার উদ্যোগ নিলেই এ দুটি কলেজের ছাত্রলীগ কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কিন্তু তাঁদের দুজনের সম্পর্কই এখন প্রায় জোয়ার-ভাটার মতো। আজ দুজনে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহের কথা বলে কাছে আসছেন, কাল আবার পরস্পরের প্রতি বিষোদ্গার করে দূরে সরে যাচ্ছেন। ‘সমঝোতা’র উদ্যোগ যাঁরা নেবেন, তাঁদের মধ্যে ‘সমঝোতা’র ঘাটতি মেটাবে কে?

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।