সুযোগের অপেক্ষায় তুফান সরকারেরা

বঙ্গদেশে ইস্যুর অভাব হয় না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে একের পর এক ইস্যু এখানে হাজির হয়। কদিন তুমুল হইচই চলে। তারপর নতুন ইস্যুর নিচে চাপা পড়ে পুরোনো ইস্যু। আমরা গোল্ড ফিশের মতো পুরোনো ইস্যুর কথা দিব্যি ভুলে যাই। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় থাকেন তুফান সরকারেরা। 

এই তো সেদিনের কথা। গত ১৭ জুলাই বগুড়ায় ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেন শহর শ্রমিক লীগের তৎকালীন আহ্বায়ক তুফান সরকার। পরে তাঁর সহযোগীরা ধর্ষণের শিকার মেয়েটি ও তাঁর মাকে মারধর করে মাথা ন্যাড়া করে দেন।

লোমহর্ষক ঘটনাটির বিবরণ গণমাধ্যমে এলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো দেশ। ধর্ষক ও তাঁর সহযোগীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয় সর্বস্তরের মানুষ। নড়েচড়ে বসে পুলিশ-প্রশাসন। দ্রুততার সঙ্গে গ্রেপ্তার হয় ১১ আসামি। আসামিদের রিমান্ডে নেওয়া হয়। কয়েকজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন।

পুলিশের ত্বরিত তৎপরতায় আপাতত আশা জাগে—ভুক্তভোগীরা হয়তো ন্যায়বিচার পাবেন। তবে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে অনেকে শুরু থেকেই ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

শেষ পর্যন্ত সন্দেহবাদীদের সন্দেহটাই জোরালো হওয়ার আলামত দেখা যাচ্ছে। আলোচিত এই মামলার তদন্ত ঢিমেতালে চলছে। দুই মামলার অভিযোগপত্র এক মাসের মধ্যে দেওয়ার অবস্থান থেকে পুলিশ সরে এসেছে। জেলা প্রশাসনের কমিটি ৪০ দিনেও তদন্ত শেষ করতে পারেনি। বাদীপক্ষের সঙ্গে আসামিদের আপস-মীমাংসার সুযোগ করে দিতেই পুলিশ অভিযোগপত্র দিতে দেরি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে (১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, প্রথম আলো)।

ঘটনার পর দেশব্যাপী তীব্র ক্ষোভ-রোষের মুখে পুলিশের পক্ষ থেকে গরম-গরম কথা বলা হয়েছিল। কাজও দেখানো হয়েছিল বেশ। কিন্তু এখন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আবুল কালাম আজাদ আমতা-আমতা সুরে কথা বলছেন। ‘দিনক্ষণ বেঁধে দিয়ে এই মামলার তদন্ত শেষ করা সম্ভব নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। তাঁর এই মন্তব্য স্পষ্টত আসামিদের পক্ষেই গেল। তাঁর মন্তব্যে বাদীপক্ষের সঙ্গে আসামিদের আপস-মীমাংসার সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগটি আরও শক্ত হলো। তা ছাড়া বগুড়া শিশু আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মোহাম্মদ আমানুল্লাহ নিজেই জানিয়েছেন, তদন্ত শেষ করার ব্যাপারে পুলিশের কোনো তৎপরতা তাঁর চোখে পড়ছে না।

আসামি তুফানেরা প্রভাবশালী। তাঁদের টাকা আছে, ক্ষমতা আছে। কারাগারে বসেও তাঁরা থেমে নেই। তাঁরা এতই ভয়ংকর যে তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পর্যন্ত পাচ্ছেন না সাক্ষীরা।

অন্যদিকে, ভুক্তভোগীরা দরিদ্র, ক্ষমতাহীন। তুফানদের সঙ্গে তাঁদের পেরে ওঠার প্রশ্নই আসে না। তার ওপর পুলিশ-প্রশাসনের কাজ যদি তুফানদের পক্ষে যায়, তাহলে বিচারের বাণীর গুমরে কাঁদা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

বগুড়ায় তুফান-কাণ্ডের পর দেশে আরও অনেক বর্বর ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী রূপা খাতুনকে ধর্ষণের পর ঘাড় মটকে হত্যা অন্যতম। এই হত্যার সঙ্গে পরিবহনশ্রমিকেরা জড়িত। তাঁদের শক্তিশালী সংগঠন আছে। অপরাধী শ্রমিকদের বাঁচাতে তাঁদের সংগঠনের জুলুমবাজির নজির আমরা দেখেছি। এ অবস্থায় রূপাকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ন্যায়বিচার হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়া অমূলক নয়।

কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার এক বছর পেরিয়ে গেছে। তাঁকে হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছিল বলে ডিএনএ পরীক্ষায় আলামত মিলেছে। তনু হত্যার পর বিচার দাবিতে দেশজুড়ে কত আন্দোলন হলো। অথচ এই হত্যা মামলার কোনো আসামি এখন পর্যন্ত শনাক্তই হয়নি। দীর্ঘ সময়ে মামলার কোনো কিনারা করতে পারেনি সিআইডি। এমন হতাশাজনক অবস্থায় মানুষ বলছে, ‘নো ওয়ান কিল্ড তনু’।

নিত্যনতুন ইস্যুর ভিড়ে আমরা তনুর কথা ভুলেই গেছি। রূপার কথা এখন তেমন আর শোনা যাচ্ছে না। বগুড়ায় তুফানদের বর্বরতার পর আমাদের মনে যে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছিল, তা এখন মিলিয়ে গেছে। আমরা নতুন ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত।

গ্রেপ্তার তুফানের যে ছবি গণমাধ্যমে এসেছিল, সেখানে তাঁকে বেশ শান্ত লাগছিল। যেন কিছুই হয়নি, কিছু হবেও না—এই বার্তাই দিয়েছিল প্রতাপশালী তুফানের চোখমুখ। মামলার তদন্তের গতিপ্রকৃতি দেখে এখন বোঝা যাচ্ছে, তুফানেরা কীভাবে নিশ্চিন্তে থাকেন।

সাইফুল সামিন: সাংবাদিক
[email protected]