কোথায় আমাদের ভুল খুঁজে বের করা দরকার

এ এন এম মুনিরুজ্জামান
এ এন এম মুনিরুজ্জামান
আগে থেকে চার লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ছিল। মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের কারণে সম্প্রতি আরও তিন লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। এখনো তাদের আসা অব্যাহত রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিপস) সভাপতি এ এন এম মুনিরুজ্জামান


প্রথম আলো
: চীন, ভারত ও রাশিয়ার মতো দেশ যেখানে মিয়ানমারের প্রতি সহানুভূতিশীল, সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের প্রস্তাবিত সেফ জোন গড়তে রাজি হবে? তারা মিয়ানমারকে চাপ দেবে কেন?

এ এন এম মুনিরুজ্জামান : মানবিক দিকটা এখানে সব থেকে ধারালো অস্ত্র। তা ছাড়া বিশ্বকে যদি রোহিঙ্গা বিতাড়নের পরের সমস্যাগুলো কীভাবে আঘাত হানবে তা বোঝানো যায়, তাহলে বরফ গলবে।

প্রথম আলো : বসনিয়া হার্জেগোভিনাতেও দেখা গেছে, নিরাপত্তা পরিষদ খুব তৎপর হয়নি, তারা অন্যত্র হয়েছে, এখানেও তো সেই আশঙ্কা।

মুনিরুজ্জামান : এটা ঠিক, তারা মুখে না বললেও এখানে একটি ধর্মীয় দিক আছে। অন্য ধর্মের হলে হয়তো প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু অভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিপূর্বে সাড়া মিলেছে। সুতরাং আমরা সমর্থন পাব না, এই মতের সঙ্গে একমত নই।

প্রথম আলো : অং সান সু চি দেশ কীভাবে চালাবেন, সেটা বিবেচনায় না নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব বিনা শর্তে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল। এখন তারা সেখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, এখন এর চাকা উল্টো ঘুরবে?

মুনিরুজ্জামান : না, তেমন সম্ভাবনা দেখি না। বিনিয়োগ যেটা ঢুকেছে, সেটা থাকবে, তবে তাদের পক্ষে বড় ধরনের চাপ দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিনিয়োগ বেশি, তাই পাশ্চাত্যের চাপ বাড়ানোর সুযোগটাও বেশি। সেটাই কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশকে আর হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। বিষয়টির যাতে জোরালো আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটে, সেদিকে নজর দিতে হবে। আমরা কেন ওআইসির মতো সংস্থাকে কাজে লাগাতে পারছি না?

প্রথম আলো : তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া যেভাবে সক্রিয়, সেভাবে সৌদি আরবসহ আমাদের পারস্য উপসাগরীয় মিত্রদের কেন সক্রিয় দেখি না?

মুনিরুজ্জামান : সৌদি আরবের মতো দেশ সাধারণত পশ্চিমা বিশ্ব না নড়লে তারাও নড়ে না। তবে এ কারণে আমরা নিষ্ক্রিয় থাকব না, তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালাব। তবে প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র, যাদের জন্য আমরা এত কিছু করলাম, তারা কেন পাশে দাঁড়াল না, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।

প্রথম আলো : রোহিঙ্গাবিরোধী বর্মি সশস্ত্র সামরিক অপারেশনের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার যান, সেখানে ‘রোহিঙ্গা জঙ্গিদের সন্ত্রাসের নিন্দা’ করেন। তবে তাঁর দেশে ফেরার পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

মুনিরুজ্জামান : এর কিন্তু খুব মূল্য নেই। ভারত-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এর উল্লেখ বাঞ্ছনীয় ছিল। এমনকি বহুপক্ষীয় বালি সম্মেলনেও ভারত এ–সংক্রান্ত একটি বিবৃতিতে সই দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

প্রথম আলো : ভারতকে দুষলে চীনকে কী বলবেন? দেশটির মোট বিদেশি বিনিয়োগের ৩০ শতাংশ (১৮ বিলিয়ন ডলার) চীনের এবং তারাও মিয়ানমারের পাশে। কী বলবেন?

মুনিরুজ্জামান : চীন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত কারণে তাদের পাশে থাকবে। তাই আমাদের আজ নিজেদের জানতে হবে, আমরা যাদের এত দিন বন্ধু হিসেবে জেনে এসেছি, তারা আমাদের সত্যিকারের বন্ধু কি না।

প্রথম আলো : মিয়ানমারের নিরাপত্তা উপদেষ্টার দাবি, নিরাপত্তা পরিষদে তাদের পক্ষে চীন ও রাশিয়া আছে!

মুনিরুজ্জামান : যদি এমনটাই হয়, তাহলে তো বলতে হবে, আমাদের থেকে তাদের কূটনৈতিক অবস্থান উত্তম। আমাদের যা ছিল বলে প্রতীয়মান হয়েছে, তা একেবারে নড়বড়ে। আপনি যে তিনটি (চীন, ভারত ও রাশিয়া) দেশের কথা বললেন, তাদের সঙ্গে গত ১০ বছরে আমরা কূটনৈতিক, সামরিক ও ব্যবসাগত দিক থেকে গভীরভাবে যুক্ত আছি। এখন এত ঘনিষ্ঠতা ও সহযোগিতার যদি এই ফলাফল হয়, তাহলে আমরা এত দিন যা অর্জন করেছি বলে দাবি করেছি, তা আসলে ব্যর্থ হয়ে গেছে।

প্রথম আলো : তাহলে এখন করণীয় কী?

মুনিরুজ্জামান : একটি ব্যাপকভিত্তিক নির্মোহ বিচার-বিশ্লেষণ করে আমাদের সঠিক অবস্থানটি নিরূপণ করা দরকার। কোনো ভাসা–ভাসা কথা নয়। আমাদের কূটনৈতিক শক্তি-সামর্থ্য কোন পর্যায়ে আছে, সেটা আগে বোঝা দরকার। আর সেটা বুঝে নিয়ে আমাদের পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করা উচিত। মানবিক এবং অন্যবিধভাবে তারা যদি সহায়তা না দিতে পারে, তাহলে পরিস্থিতিটা কোথায় যেতে পারে, সেটা তাদের বোঝানো দরকার। শুধু মানবিক বিপর্যয়ের নয়, জঙ্গিবাদ বা উগ্রপন্থা কোথায় যেতে পারে, তার একটা সম্ভাব্য চিত্রও তাদের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে।

বিশ্বকে বলতে হবে মানবিক বিপর্যয় রুখতে, বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের বাসস্থান, খাদ্যের সংস্থান ও স্বাস্থ্যগত দিকে নজর দিতে হবে। তা যদি সঠিকভাবে না করা হয়, তাহলে তার প্রভাব দেশের অন্যত্র গিয়েও পড়বে।

প্রথম আলো : প্রতিরক্ষাবিষয়ক স্টকহোমভিত্তিক সামরিক সাময়িকী সিপ্রির মতে, চীন, রাশিয়া ও ইউক্রেন হলো দেশটির প্রধান অস্ত্র বিক্রেতা। অন্যদিকে ১৫৭ জন ব্রিটিশ সাংসদ মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে দেওয়া প্রশিক্ষণ রোহিঙ্গা নিধনে ভূমিকা রেখেছে কি না, সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।৮ সেপ্টেম্বর দ্য ইনডিপেনডেন্ট–এর খবর হলো, ইসরায়েল বার্মায় ১০০ ট্যাংক বিক্রি করছে, তাই সার্বিকভাবে অবস্থাটা হতাশাব্যঞ্জক কি না?

মুনিরুজ্জামান : কিছুটা হতাশাব্যঞ্জক। এই সমস্যা কোন দিকে যেতে পারে, সেটা হয়তো আমরা আঁচ করতে পারিনি। তবে এ কারণে আমরা পিছিয়ে থাকব, সেটা আমি বলতে চাই না। যেটা হওয়ার কথা ছিল, সেটা আমরা করতে পারিনি। এখন কোথায় আমাদের ভুল, কোথায় গাফিলতি ঘটে গেছে, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। মিয়ানমার হয়তো নিজেদের আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরতে পেরেছে, সেটা আমরা পারিনি। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে আমরা নিজেদের সমস্যা তুলে ধরতে পারিনি।

প্রথম আলো : সমস্যা শতাব্দী–প্রাচীন, তাহলে এখন মিয়ানমারের এতটা অনমনীয় হাওয়ার কারণ কী? কী এমন নতুন ঘটনা ঘটেছে, যাতে তারা এ রকম করতে পারছে?

মুনিরুজ্জামান : এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণভাবে চাপ বাড়ার ফলে তারা এই পথে গেছে। রাখাইনসহ বিভিন্ন প্রদেশে দেখা গেছে, সেখানে একটি উগ্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে, যারা কোনোভাবেই কোনো সমঝোতায় বিশ্বাসী নয়। তারা বিশ্বাস করে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে এসেছিল, তাদের মেরে তাড়িয়ে দিতে হবে। আরসার সম্পৃক্ততা আরও জটিল করেছে।

প্রথম আলো : অনেকের সন্দেহ, আনান কমিশনের রিপোর্টের পর কথিতমতে আরসা এটা করেছে। আইএসআই সম্পৃক্ত?

মুনিরুজ্জামান : এটাও ঠিক, আরসার যে এটা করেছে বলে দাবি করেছে, সেটার বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। আরসার মুরব্বিরা সৌদিভিত্তিক এবং তাঁদের টাকার উৎসও ওখানকার বলেই জানা যায়।

প্রথম আলো : বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল প্রধানমন্ত্রীকে চীন ও ভারত সফরের পরামর্শ দিয়েছেন। করা উচিত?

মুনিরুজ্জামান : সফরের চেয়েও তাদের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে আলাপ-আলোচনা বাড়ানো উচিত।

প্রথম আলো : জঙ্গিবাদসহ অনেক সমস্যাই সরকার সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে, কিন্তু এই সংকট ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। এটা কি দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম নিরাপত্তা–সংকট?

মুনিরুজ্জামান : এটা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটা বড় ধরনের হুমকি এবং চ্যালেঞ্জ। সমস্যাটির যদি আশু সমাধান করা না হয়, তাহলে আমাদের সীমান্তসংলগ্ন এলাকাতে একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্রস্থল হওয়ার আশঙ্কা আছে। যেহেতু ইতিমধ্যেই আইএস ও চেচেন যোদ্ধারা এবং সিরিয়াতে যুদ্ধরত বিদেশি যোদ্ধারা রোহিঙ্গাদের এই সংগ্রামে একাত্ম এবং সংযুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, কাজেই আমাদের সীমান্ত নিরাপত্তা বাড়ানোর দরকার আছে বলে আমি মনে করি।

প্রথম আলো : ধন্যবাদ।

মুনিরুজ্জামান : ধন্যবাদ।