রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আমরা কোথায় পিছিয়ে

রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগ চলছেই
রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগ চলছেই

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করেছেন। এটি করে তিনি একটি বড় মানবিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এ জন্য তিনি দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হবেন। তবে প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের এই মানবিক অবস্থানকে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে যদি দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা যায় ও রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানো যায়, তা আরও অনেক বড় কাজ হবে।
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে কফি আনান কমিশন সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমারের ওপর বাংলাদেশকে এখন আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এই কমিশন মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সব অধিকারসহ পুনর্বাসন করতে বলেছে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সহায়তা প্রদানের সুপারিশও করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে একটি উন্নত কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে।
বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে স্পষ্টভাবে এই বার্তা দিতে হবে যে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ নিতান্ত মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এই অবস্থা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অনির্দিষ্টকাল যাবৎ মেনে নিতে পারে না। অন্য দেশ থেকে অবৈধভাবে ঠেলে দেওয়া মানুষের বোঝা অনির্দিষ্টকাল যাবৎ কোনো দেশই গ্রহণ করতে পারে না।
আমাদের মূল লক্ষ্য হবে তাই একটিই। তা হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের পিতৃভূমিতে ফেরত নেওয়ার জন্য মিয়ানমারকে বাধ্য করা। ১৯৭৮ ও ১৯৮২ সালে আমরা তা অনেকাংশে করতে পেরেছিলাম। প্রশ্ন হচ্ছে, এটি করার ক্ষেত্রে আমাদের এখনকার সামর্থ্য কতটুকু? যেটুকু সামর্থ্য আছে, তা–ও কি সঠিকভাবে ব্যবহারের চিন্তা করতে পারছি আমরা?

২.
রোহিঙ্গাদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও বিতাড়নকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ইতিমধ্যে এথনিক ক্লিনজিং বা জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের সুবিধার জায়গা হচ্ছে এটিই। নির্বিচার ও পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং জাতিগত নিধন গণহত্যা কনভেনশন, রোম স্ট্যাচুট, জাতিসংঘের চার্টারসহ বিভিন্ন সনদে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত। আন্তর্জাতিক অপরাধগুলোর মধ্যে এগুলো আবার সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ হিসেবে ‘অ্যাটরোসিটিস ক্রাইমস’ হিসেবে আখ্যায়িত।
এ ধরনের অপরাধ দমনে রাষ্ট্রের দায়দায়িত্বকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০০৫ সালে রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট নামে একটি নীতি গ্রহণ করে। এই নীতি অনুসারে প্রতিটি দেশের ভেতরে থাকা যেকোনো জাতিসত্তা বা জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সে দেশের। দেশটি তাতে ব্যর্থ হলে আন্তর্জাতিক মহলের অধিকার রয়েছে তাকে এটি করতে বাধ্য করা।
সারা পৃথিবীতে এসব দায়দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রকে বাধ্য করার জন্য নিরাপত্তা অঞ্চল গঠন করা এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে নিরাপত্তা দেওয়ার বিভিন্ন উদাহরণ রয়েছে। বর্তমানে এর পরিধিও বেড়েছে বহুগুণ। শুধু যুদ্ধাবস্থা বা সংঘর্ষ নিরসন নয়, বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে রক্ষা, মানবাধিকার লালন, আইনের শাসন পুনরুদ্ধারসহ বিভিন্ন লক্ষ্যে এখন শান্তিরক্ষী বাহিনী নিয়োগ করা হয়।
সমস্যা হচ্ছে নিরাপত্তা অঞ্চল সৃষ্টি বা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের একমাত্র রাস্তা হচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। এখন পর্যন্ত যে ৫৮টি ঘটনায় এবং এখনো যে ১৫টি দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী রয়েছে, তার প্রতিটি ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই এই বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। মিয়ানমারে চীনের প্রভাব এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন করার চিন্তা থেকে এ ধরনের কোনো উদ্যোগে হয়তো আমেরিকা রাজি হতে পারে। কিন্তু তারপরও এটি ভেস্তে যেতে পারে একটিমাত্র দেশের ভেটো প্রয়োগের মাধ্যমে। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক বিবেচনায় নিলে চীনের অবশ্যই এই ভেটো প্রয়োগের কথা। তা ছাড়া রাশিয়ার ভূমিকাও সেখানে বাংলাদেশের অনুকূলে যাবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে মিয়ানমারে জাতিগত নির্মূলের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রস্তাবও দিচ্ছেন বর্তমানে কেউ কেউ। এ ধরনের অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য রোম স্ট্যাটিউট নামের একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি রয়েছে। বাংলাদেশ নিজে রোম স্ট্যাটিউট অনুসমর্থনকারী একটি দেশ। কিন্তু মিয়ানমার এই চুক্তিটি গ্রহণ করেনি। পক্ষ নয়, এমন দেশের কাউকে বিচারের আওতায় আনার বাকি একমাত্র পথ হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু এ ধরনের কোনো উদ্যোগে আরও শক্ত বাধা আসার কথা চীন বা রাশিয়ার পক্ষ থেকে।
কেউ কেউ বিমসটেকের মতো অর্থনৈতিক ফোরামগুলোর মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের কথা বলছেন। কেউ আবার ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার মাধ্যমে আসিয়ানে বিষয়টি তোলা যায় কি না বলছেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের তুলনায় বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বর্তমানে কতটুকু, এ প্রশ্ন সেখানেও বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি নিয়ে কিছুটা হলেও চাপ সৃষ্টির জায়গা হচ্ছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের বিভিন্ন মানবাধিকার ফোরামে বিষয়টি তুলতে পারে বাংলাদেশ। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম হচ্ছে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল। এই কাউন্সিলের অধিবেশন চলবে এ মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। এই কাউন্সিলের অধিবেশনেই জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিয়ানমারের বর্বরতার নিন্দা করেছেন তাঁর ভাষণে। তবে তাঁর ভাষণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিষয়টি কাউন্সিলের চূড়ান্ত প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করা। বাংলাদেশ কাউন্সিলের উদ্যোগে আগামী বছর অনুষ্ঠেয় ইউনিভার্সাল পিরিওডিক্যাল রিভিউতেও বিষয়টি অভিযোগ আকারে তুলতে পারে।
তবে নিরাপত্তা পরিষদ বাদে জাতিসংঘের বাকি যেকোনো ফোরামে এমনকি তা সাধারণ পরিষদে হলেও তার প্রায়োগিক মূল্য খুব বেশি নেই। জাতিসংঘ সনদ অনুসারে কেবল নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তই সদস্যরাষ্ট্রগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক, অন্য কোনো ফোরামের কোনো সিদ্ধান্ত বড়জোর নৈতিক বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে। তাই বলে নৈতিক বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি মূল্যহীন নয়। মিয়ানমারের মতো বিশ্বের দরবারে নতুন করে উন্মুক্ত হওয়া দেশের জন্য এই চাপ কিছুটা হলেও প্রভাব রাখতে পারে।

৩.
মিয়ানমারের ওপর আরও কার্যকর চাপ সৃষ্টি করা যেত আঞ্চলিকভাবে। সেই সুযোগ নিজেদের দোষে আমরা হারিয়েছি কিছুটা। আমাদের ব্যক্তিজীবনে যেমন, আন্তর্জাতিক পরিসরেও তেমনি যেকোনো আন্তরাষ্ট্র বিবাদে দুই পক্ষের তুলনামূলক শক্তিমত্তা ও গুরুত্ব অনেক বড় নির্ধারক শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। এই তুলনামূলক শক্তিমত্তা বলতে শুধু সামরিক শক্তি বা অর্থনৈতিক সামর্থ্যকে বোঝায় না, বোঝায় সরকারের গ্রহণযোগ্যতা এবং আন্তর্জাতিক মহলে রাষ্ট্রের অবস্থানও। মিয়ানমারের আগের সামরিক শাসকদের তুলনায় একটি অবাধ নির্বাচনে বিজয়ী অং সান সু চি সরকারের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। সে তুলনায় আমাদের দেশে গত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকারের বৈধতার সংকট রয়েছে।
সমস্যা রয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে সমর্থন অর্জনের ক্ষেত্রে। এর একটি বড় দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই মিয়ানমার নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করলে। বাংলাদেশের মতো ভারতের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও এ বিষয়ে ভারতকে কাছে পায়নি বাংলাদেশ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফরে গিয়ে বরং প্রকারান্তরে সন্ত্রাস দমনের নামে রোহিঙ্গা নির্মূলকে সমর্থন দিয়ে এসেছেন। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও মোদি-সু চির যুক্ত বিবৃতির তুলনায় এর গুরুত্ব নগণ্যপ্রায়।
অনেকে বলতে পারেন মিয়ানমারের ওপর চীনের প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে এ ছাড়া ভারতের উপায় ছিল না। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরের মাধ্যমে চীন আরব সাগরে প্রবেশাধিকার পেয়েছে, মিয়ানমারের সঙ্গে তেল গ্যাস পাইপলাইন ও অন্যান্য কানেকটিভিটি প্রজেক্টের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার পেতে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার মতো মিয়ানমারেও সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে ভারত মহাসাগরে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার করতে চায় চীন। এসব নিয়ে ভারতের উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক। ভারত উদ্বিগ্ন চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে মিয়ানমারের সমর্থন নিয়েও। ভারত এখন চাইছে চীনের প্রভাবে ভারসাম্য আনার জন্য ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিপক্ষীয় হাইওয়ে এবং মিজোরামের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে যুক্ত করার জন্য কালাদান মাল্টি-মডেল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের বাস্তবায়ন। কাজেই মিয়ানমারে কৌশলগত অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে চীন আর ভারত দুই দেশই মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে—এটাই বাস্তবতা।
প্রশ্ন হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশও কেন চীন আর ভারতের মধ্যে তাকে সমর্থন দেওয়ার প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারল না? কেন মিয়ানমারের মতো একই রকম দর-কষাকষির জায়গায় আমরা ভারতকে রাখতে পারলাম? কেন গত এক দশকে ট্রানজিট, আন্তনদী, নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক মহলে সমর্থনসহ সব বিষয়ে ভারতকে একতরফাভাবে সবকিছু দিয়ে ফেলে দর–কষাকষির জায়গায় আমরা নিজেদের অনেকাংশে গুরুত্বহীন করে ফেললাম?

৪.
পশ্চিমা বিশ্ব বাদে বাংলাদেশের জন্য এখন অন্যতম আশাবাদের জায়গা হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন আদায়। রোহিঙ্গারা যে বর্বরোচিত নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, তার পেছনে একটি বড় কারণ তাদের ধর্মীয় পরিচয়। ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে হিন্দু, খ্রিষ্টান বা ইহুদি যারাই যখন নির্যাতিত হয়েছে, নির্যাতিতদের ধর্মের মানুষের দেশগুলো একসঙ্গে প্রতিবাদ করেছে। বাংলাদেশের অধিকার রয়েছে ওআইসির মতো ব্যানারে এ ধরনের সম্মিলিত প্রতিবাদ সংগঠিত করা। এ নিয়ে কোনো রকম দ্বিধা, চাপ বা বিভ্রান্তির মধ্যে থাকলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলে জনমত সৃষ্টির একটি বড় সুযোগ হারাবে।
কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের ভিত্তিতে একটি সমাধানে মিয়ানমারকে চাপে ফেলার জন্য সরকারকে এখন সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। যেকোনো ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ এখানে অবশ্যই পরিহার করতে হবে।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়