তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার নিশ্চিতে আইন জরুরি

কেউ পড়াশোনার সুযোগ পেলেও বেশি দূর এগোতে পারেননি। কারও কপালে হয়তো তা-ও জোটেনি। অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্যকে সঙ্গী করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। সমাজের এই শ্রেণির মানুষ ‘হিজড়া’ হিসেবেই পরিচিত। আজ এক গোলটেবিল বৈঠক আলোচনায় তৃতীয় লিঙ্গের এ মানুষদের বঞ্চনা দূর করতে মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য আইন করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন বক্তারা।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি: প্রতিবন্ধকতা ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সহযোগিতায় আয়োজিত এ বৈঠকে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘হিজড়ারা সব গুণ নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। কোনো অংশেই অন্যদের চেয়ে কম নয়। আমাদের মানসিক দৈন্যের জন্য তাদের গ্রহণ করতে পারছি না। যেহেতু দৈন্য আছে, সেহেতু আইন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, হিজড়াদের প্রাপ্য অধিকার কেউ না দিলে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানান তিনি।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য সরকারের নানা কর্মসূচির উল্লেখ করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নুরুল কবির বলেন, তাঁদের জন্য ৬০০ টাকার বিশেষ ভাতা রয়েছে। ৫০ বছর বয়স্করা এ ভাতা পান। তিনি আরও জানান, সারা দেশে কমবেশি ১১ হাজারের মতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আছে। এর মধ্যে সাড়ে ১৩০০ জনকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। দেশের ৩৮টি জেলায় ৫০ জন করে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন কর্মসংস্থানের জন্য।

বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘এঁদের নিয়ে ২০ বছর ধরে কাজ করছি। মারাত্মক বৈষম্যের স্বীকার হন তাঁরা। শুধু সরকার না সিভিল সোসাইটির মানুষদেরও তাঁদের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ যদি সম্মান ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পান, তাহলে রাস্তায় নেমে টাকা চাইবেন না।

এনজিও-বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক খন্দকার রাকিবুর রহমান বলেন, নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। তাঁর এনজিও ব্যুরোতে যাঁরা এ বিষয়ে নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা যেন কোনো প্রতিবন্ধকতার স্বীকার না হয়, সে চেষ্টা করবেন।

আলোচনায় উপস্থিত তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজন নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। চৈতি নামের একজন বলেন, ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল মামুন। সে নামেই তিনি স্কুল, কলেজে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজের পরিবর্তন বুঝতে পেরে নিজের নাম রাখেন চৈতি। তিনি বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ছোটবেলায় ছেলেদের মতো করে বড় করানো হয়। স্কুল-কলেজেও সেই ছেলে হিসেবে পড়ালেখা চালাতে হয়। কিন্তু বড় হওয়ার পরে তাঁরা নিজেদের প্রয়োজন বোঝেন। তখন নাম পরিবর্তন নিয়ে সমস্যায় পড়েন। তাঁর চাওয়া শিক্ষা বোর্ড যেন এ বিষয়টি নিয়ে ভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও কোটা চান তিনি।

শাম্মী নামের আরেকজন বলেন, ছেলে বা মেয়ে না হওয়ার কারণে পরিবারের সম্পত্তির ভাগ থেকে বঞ্চিত হন। চিকিৎসা নিতে গেলে টিকিট কাউন্টার থেকে পরীক্ষাগার পর্যন্ত লজ্জার মুখে পড়েন। আরেকজন অভিযোগ করেন, সবার জন্য আইন থাকলেও পুলিশের কাছে গেলে তাঁরা সহযোগিতা পান না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম বলেন, ‘আমি হিজড়া বলতে চাই না। এটা একটা গালির মতো হয়ে গেছে। ভীষণ অবমাননাকর। তাঁদের প্রথম পরিচয় মানুষ।’ আরও বলেন, তাঁদের মানসিক ও শারীরিক বিষয়গুলো অনেকেই বোঝে না। গণমাধ্যমেও এসব নিয়ে কথা হয় না।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। তিনি বলেন, তাঁদের জন্য চাকরি, হাসপাতাল ও সংসদে বিশেষ কোটা এবং নাচ-গানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সালে সরকার এঁদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্রে মেডিকেল পরীক্ষা দিয়ে ‘হিজড়া’ প্রমাণ করার সিদ্ধান্ত ভুল। এটি একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক ব্যাপার। এটাকে তিনি মনোজাগতিক লিঙ্গীয় নির্মাণ হিসেবে দেখার কথা বলেন।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাদিয়া ইসলাম মৌ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মেধাবী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তাঁদের যেকোনো প্রয়োজনে তিনি পাশে থাকবেন।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন। এতে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সের বিভাগীয় প্রধান এ কে এম নুর-উন-নবী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম আমানউল্লাহ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস এসটিসি প্রোগ্রামের সহকারী পরিচালক তড়িৎ কুমার সাহা, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন, আইসিডিডিআরবির এইচআইভি প্রোগ্রামের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ইজাজুল ইসলাম চৌধুরী ও ইউএনডিপির চিফ হিউম্যান রাইটস শর্মিলা।

আলোচনার শুরুতেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে বানানো একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের বঞ্চনার চিত্র দেখানো হয় এতে।