'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ', 'উন্নয়ন' এবং উদ্বাস্তু ভার

পাশের দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিকল্পিত জাতিগত নিধন ও নির্যাতনের ফলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পরিচয়ের মানুষ এখন বাংলাদেশে। এটা জাতিগত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তো বটেই, তবে তা টিকিয়ে রাখা, উন্মত্ত অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পেছনে গণতন্ত্রবিনাশী উন্নয়ন মডেল, বহুজাতিক পুঁজি ও বিভিন্ন বৃহৎ রাষ্ট্রের কৌশলগত ঐক্য ও দ্বন্দ্বও ভূমিকা পালন করছে। অনেকের ধারণা, একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী টিক্কা খানের মতো ওই অঞ্চলের সব মানুষ নিধন করে, তাড়িয়ে শুধু মাটি চায়। সেখানে তারা ‘উন্নয়ন’ করবে!

মিয়ানমারের ইতিহাস সরল নয়, জাতিগত সংঘাত বা আক্রমণ এটাই প্রথম নয়। এই দেশে প্রায় ৮৮ শতাংশ বৌদ্ধ, ৬ শতাংশ খ্রিষ্টান, ৫ শতাংশ মুসলিম। এই দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবেই ১৩৫টি জাতির অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। এই রাখাইন বা আরাকান ছিল একসময় প্রতাপশালী স্বাধীন রাজ্য। ১৭৮৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর বর্মিরাজের বর্বর হামলায় রাখাইন রাজ্যের পতন হয়। জানা যায়, সে সময় দুই লক্ষাধিক রাখাইনকে হত্যা করা হয়। বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে এই জাতির পুনরুত্থানের পথ বন্ধ করা হয়।

এই অঞ্চলেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাস, তুলনায় খুবই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, অথচ তাদের প্রতি এই রাষ্ট্র দশকের পর দশক ভয়ংকর সন্ত্রাসে লিপ্ত। এদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম, সে জন্য বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের মডেলে ফেলে গণহত্যা জায়েজ করার চেষ্টা করা খুব সহজ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিধনযজ্ঞের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত সে দেশের শাসকশ্রেণি থেকে বলা হয়েছে, এটা ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’, সেনাপ্রধান জনগণকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার ডাক দিয়েছেন! ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার পর শুরু করা হয়েছিল তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ছিন্নভিন্ন হয়, দখল হয়। ইরাকে মানববিধ্বংসী অস্ত্র আছে এই অজুহাতে সেই দেশে ১০ লক্ষাধিক মানুষকে খুন করা হলো। কিন্তু পরে প্রমাণিত হলো পুরোটাই ডাহা মিথ্যা!

বস্তুত, এই মিথ্যার ওপরই দাঁড়িয়ে আছে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ। বুশ নেই, কিন্তু এই মন্ত্রই চালাচ্ছে বিশ্ব। বিভিন্ন দেশের শাসকেরা সানন্দে এর ওপর ভর করেই সন্ত্রাস চালাচ্ছে জনগণের ওপর। যুদ্ধ অর্থনীতি, করপোরেট দখল সবই নতুন এক অস্ত্র পেয়ে ফুলেফেঁপে উঠছে। ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ ফর্মুলায় ফেলে দিলে সব রকম বর্বরতাই যেন এখন বৈধতা পায়। তাই বিস্ময়কর নয় যে মিয়ানমারে এখন যে গণহত্যা চলছে তার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার জন্যও হাজির করা হয়েছে একই মন্ত্র। মুসলিম উম্মাহর ধারণা কাজ করছে না, সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী একই মন্ত্র নিয়ে নিজেরাই মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম গণহত্যা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের অংশীদার।

মিয়ানমারের জাতিগত সহিংসতা মাত্রাতিরিক্ত রূপ নেওয়ার কারণে বিশ্ব জনমতের চাপে এর সমাধানের চেষ্টাও হয়েছে। কফি আনান কমিশন এ নিয়ে বিস্তৃত কাজ করে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে, যার বাস্তবায়নে একটি স্থায়ী সমাধান সম্ভব। সুপারিশ উপস্থাপনের পরদিনই গত ২৫ আগস্ট রাখাইনের ৩০টি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে হামলা হয়। এর সূত্র ধরেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নতুনভাবে অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতায় হামলা শুরু করে।

ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যখনই সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেছে, তখনই রহস্যজনক সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হয়েছে। অশান্তি টিকিয়ে রাখার সুবিধাভোগী আছে তো বটেই। বোঝাই যায়, যারা বারবার এভাবে আক্রমণ করেছে তারা চায় না এই সমস্যার সমাধান হোক। এ রকম ঘটনা এখানেই একমাত্র নয়। বিশ্বের বহু স্থানেই চলছে একই কৌশল।

২.

মিয়ানমারকে উপনিবেশ বানাতে ব্রিটিশদের তিনটি যুদ্ধ লেগেছিল। সাম্রাজ্য ও উপনিবেশের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, পরিচয় আর সংঘাত নিয়ে বর্তমান মিয়ানমার বা বার্মা রাষ্ট্র হিসেবে জন্মলাভ করে ১৯৪৮ সালে। নতুন যাত্রার পরিকল্পনা ও সম্ভাবনায় আতঙ্কিত দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী শুরুতেই খুন করে স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা অং সানকে। নাজুক অবস্থায় একপর্যায়ে চেপে বসে সামরিক শাসন। এরপর আর এই দেশ গণতান্ত্রিক জনপন্থী ধারায় অগ্রসর হতে পারেনি। কাগজপত্রে সমাজতন্ত্র নাম দিলেও প্রকৃতপক্ষে সামরিক জান্তার শাসনই অব্যাহত থেকেছে।

বার্মা নামেই এই দেশ দীর্ঘকাল পরিচিত ছিল। সামরিক জান্তা তার অস্তিত্বের সংকটকালে এই নাম পরিবর্তন করে রেখেছে মিয়ানমার। সবাই মানেনি বলে এখন দুই নামই চলে। আয়তনে বাংলাদেশের দ্বিগুণের বেশি, জনসংখ্যা তিন ভাগের এক ভাগ। মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের প্রায় সমান, মানে তারাও এখন মধ্য আয়ের দেশের তালিকায় প্রবেশ করেছে। কিন্তু দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, চিকিৎসাহীনতা এখনো ভয়াবহ। জনবসতি, ভূমি, সম্পদ বিবেচনা করলে এই দেশ বহু আগেই আরও অনেক সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতে পারত। কিন্তু হয়নি। কতিপয় জেনারেলসহ খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ বিশাল সম্পদ ও প্রতিপত্তির মালিক হয়েছে।

উপনিবেশকালেও বার্মা ছিল বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক দেশ। ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ কোম্পানি তেল রপ্তানি শুরু করে, পরে গ্যাস রপ্তানি শুরু হয় সামরিক জান্তার হাত ধরে। এসব প্রকল্পে ইউনোকলসহ বিভিন্ন মার্কিন কোম্পানি যুক্ত ছিল। এখন চীন অন্যতম অংশীদার। বহু দশক ধরে তেল-গ্যাস রপ্তানি বিপুল বেগে চললেও তার আয় মিয়ানমারকে সমৃদ্ধ করেনি, লাভবান হয়েছে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী। এখন সরকারি হিসাবে গ্যাসের দাম ২০১৪ সালের তুলনায় অর্ধেক হয়ে যাওয়ায় গত বছরেই রপ্তানি আয় কমে গেছে অর্ধেক, এ বছর গ্যাসের দাম আরও কমেছে। বর্তমানে এই দেশ আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম আফিম উৎপাদনকারী দেশ। ইয়াবাসহ অবৈধ মাদকদ্রব্য উৎপাদন ও রপ্তানি মিয়ানমারের অন্যতম কর্মসংস্থান ও আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক চাপে ২০১০ এরপর থেকে বহুজাতিক পুঁজির পক্ষে নানামুখী অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে অগ্রসর হয় মিয়ানমার। বহুজাতিক কোম্পানির জন্য সুযোগ-সুবিধা আরও সম্প্রসারণ করা হয়, দেশি অংশীদার রাখার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করা হয়। এরপর বিদেশি বিনিয়োগ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও অনেক উদারীকরণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক শাসকেরা মিয়ানমারে এসব পরিবর্তন এবং ‘গণতন্ত্রের আগমনে’ স্বস্তি প্রকাশ করলেও শাসনব্যবস্থায় সামরিক বাহিনী আর তার ওপর ভর করে গড়ে ওঠা ধনিক শ্রেণির একাধিপত্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

২০০৭ থেকে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের মুখে যে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় সামরিক গোষ্ঠী, তা তারা বাতিল করেছে নির্বাচনের পরপরই। ২০১৫ সালেও নির্বাচন হলো, কিন্তু সামরিক কর্তারা নিজেদের কর্তৃত্ব নিশ্চিত না রেখে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়নি। অতএব অদ্ভুত শর্তে আত্মসমর্পণ করে ২০১৬ সালে একটা তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে মিয়ানমার, যেখানে সংসদে ২৫ শতাংশ সদস্য সামরিক বাহিনী থেকে রাখা বাধ্যতামূলক।

এ ছাড়া সবচেয়ে ক্ষমতাধর ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি কাউন্সিলেও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, যা যেকোনো সময় সংসদ বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। এ কারণে সু চিসহ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এখন পুতুলের মতো কাজ করেই নিজেদের নাক বের করে রাখতে পারেন। তাঁরা যাতে উন্নয়ন ও প্রশাসনের পুরোনো পথেই চলেন, তার জন্য নানা বিধিব্যবস্থা ও হুমকি সক্রিয় আছে।

 দুঃখের বিষয়, রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনীর এই হামলা নিয়ে মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চলে এর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে না, হলেও তা জানা যাচ্ছে না। বরং রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে সারা দেশের মানুষকে উল্টো সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা ও তৎপরতার প্রতি সমর্থন তৈরিতে বহু ধরনের প্রচারণা চলছে, তার সাফল্যও দেখা যাচ্ছে। স্বৈরশাসনের কর্তৃত্বে বৃহৎ পুঁজির পরিচালনায় মিডিয়া কীভাবে একটি দেশে গণহত্যার পক্ষে উন্মাদনা তৈরি করতে পারে, দেশের মানুষকে বোকা, অজ্ঞ ও অন্ধ করে রাখতে পারে তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত মিয়ানমার। সামরিক বাহিনী পরিচালিত অপারেশনে লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে শরণার্থী হওয়ার কারণে বিশ্বজুড়ে সঠিকভাবেই সু চি এখন প্রবল সমালোচনার মুখে, ঘৃণা ও ধিক্কার চারদিকে। অন্যদিকে বিশ্বনন্দিত সু চির (রাজনৈতিক শক্তির) এই পতন সামরিক বাহিনীর জন্য, তাদের ভবিষ্যৎ ক্ষমতা আরও সম্প্রসারণের জন্য খুবই সুবিধাজনক।

মিয়ানমারের অর্থনীতি বিশেষত জ্বালানি সম্পদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি চীনের আধিপত্য দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। রাশিয়া, ভারতও নানাভাবে তার জায়গা তৈরিতে সচেষ্ট। মিয়ানমার সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন তাই আকস্মিক নয়। চীন বরাবরই নিজের রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক প্রভাবকেই বড় বিবেচনার বিষয় ধরে, আন্তর্জাতিকতার কোনো প্রকাশ নেই তাদের কাজে। মিয়ানমারের জান্তার প্রতি ভারতের সমর্থনের পেছনে বাণিজ্যিক স্বার্থের সঙ্গে যোগ হয়েছে মোদি সরকারের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী রাজনীতি। অন্যদিকে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের নানা তৎপরতা পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়েই বাড়ছে। সুতরাং পুরো অঞ্চলে এসবের প্রভাবে আরও অনেক সংঘাত ও রক্তপাতের আশঙ্কা রয়েছে। নিজেদের স্বাধীন ও দূরদর্শী অবস্থান না থাকলে বাংলাদেশকেও এর শিকার হতে হবে।

৩.

জাতিগত ভয়াবহ নিধনযজ্ঞের অভিজ্ঞতা আর তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। তারপরও স্বাধীনতার পর অন্য জাতির ওপর নিপীড়নের ব্যবস্থা থেকে দেশকে আমরা এখনো মুক্ত করতে পারিনি। সংখ্যালঘু জাতি ও ধর্মের মানুষকে সম্প্রদায় হিসেবে হত্যা, নির্যাতনের শিকার একেক দেশে হয় একেক গোষ্ঠী। কিন্তু এর ভেতরের মর্মকথা অভিন্ন। রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশের ভেতরের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিষয়ে আবারও উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। রোহিঙ্গা মানুষের আশ্রয় ও নিরাপদ প্রত্যাবর্তনে যথাসাধ্য চেষ্টা চালানোর পাশাপাশি আমাদের এ ধরনের অপতৎপরতা মোকাবিলায়ও সক্রিয় থাকতে হবে।

লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভার এখন বাংলাদেশের ওপর। আশা করতে চাই, এ থেকে উদ্বাস্তু ভার বুঝতে শাসকেরা সক্ষম হবে। দেশের ভেতর লাখ লাখ উদ্বাস্তু তৈরির মতো প্রকল্প নিয়ে সরকার আর অগ্রসর হবে না। কে না জানে, সুন্দরবনবিনাশী রামপাল বা দেশবিনাশী রূপপুর প্রকল্পের মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে, মিয়ানমারের মতো গণতন্ত্রবিনাশী উন্নয়ন মডেল নিয়ে অগ্রসর হলে, এর চেয়ে বহুগুণ বেশিসংখ্যক মানুষ দেশের ভেতরেই উদ্বাস্তু হবে। তাদের কারা আশ্রয় দেবে?

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।