ম্যার্কেলকেই চাইছে জার্মান জনগণ?

১২ বছর ধরে জার্মানির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল আবারও কি নির্বাচনে জয়লাভ করবেন—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে ২৪ সেপ্টেম্বর। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ জার্মানির নির্বাচনকে ঘিরে ইউরোপসহ বহির্বিশ্বের দৃষ্টি এখন জার্মানির দিকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যুক্তরাজ্যের চলে যাওয়া, পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে ও আটলান্টিকের অপর পাড়ে কট্টরবাদী ট্রাম্পের ক্ষমতায়ন, ইউক্রেন নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ইউরোপের টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জার্মানির এই নির্বাচন বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

জার্মানির ১৯তম পার্লামেন্ট নির্বাচনে মোট ৪২টি দল অংশ নিলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ক্ষমতাসীন কোয়ালিশন দলের দুই প্রধান শরিক ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন দল ও সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে। চার বছর ধরে একই সঙ্গে দেশ শাসন করলেও এখন এই দুই দলের নেতারা আসন্ন নির্বাচনে পরস্পরের মুখোমুখি। তবে এর বাইরে রয়েছে বর্তমান পার্লামেন্টের বিরোধী দল, বাম দল, পরিবেশবাদী সবুজ দল, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও কট্টর ডানপন্থী অলটারনেটিভ ফর জার্মানি নামের দলটি। এবারের পার্লামেন্ট নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ১ লাখ।
জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর ও ক্ষমতাসীন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন দলের প্রধান জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবার চতুর্থবারের মতো তাঁর দলের চ্যান্সেলর প্রার্থী। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলের নেতা ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাবেক সভাপতি মার্টিন শুলজ।
পরপর তিনবারের বিজয়ী বর্তমান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবারের নির্বাচনেও অন্যতম জনপ্রিয় প্রার্থী। আঙ্গেলা ম্যার্কেল সাবেক চ্যান্সেলর হেলমুট কোলের মন্ত্রিসভায় ১৯৯১ সালে পরিবারবিষয়ক এবং ১৯৯৪ সালে পরিবেশবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৯৮ সালে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হন। ২০০০ সাল থেকে তিনি দলের সভানেত্রী। রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন দলে অনেক ঝানু রাজনীতিক থাকলেও
ম্যার্কেল প্রতিভা আর কৌশলের জোরে নিজ দলে ও জার্মানির রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান
গড়ে তুলেছেন।
অন্যদিকে অপর প্রধান চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী মার্টিন শুলজ ১৯৮৭ সাল থেকে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। নিজের এলাকার মেয়র পরবর্তী সময়ে ১৯৯৪ সাল থেকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য এবং সর্বশেষ ২০১২ থেকে এই বছর অবধি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলে তিনি বাম ঘরানার রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত।
জার্মানির পার্লামেন্ট নির্বাচনে মোট ভোটারের ৫ শতাংশ ভোট পাওয়া না গেলে কোনো দলের পার্লামেন্টে যাওয়ার সুযোগ নেই। আপাত-পরিসংখ্যানে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন ও সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রথম ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পাবেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। তৃতীয় স্থানে আবারও বাম দল বা পরিবেশবাদী সবুজ দল অথবা কট্টর ডানপন্থী অলটারনেটিভ
ফর জার্মানির আসার সম্ভাবনা রয়েছে। চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের শরণার্থী নীতির সমালোচক অলটারনেটিভ ফর জার্মানি দলটি ভোটের রাজনীতিতে সস্তা স্লোগান সম্বল করে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে।
১২ বছর ধরে ক্ষমতাসীন চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল নিজের দেশে দল ও জনগণের কাছে বেশ জনপ্রিয় এবং ইউরোপীয় ঐক্যসহ ইউরো মুদ্রার প্রসার ও বাজার ধরে রাখতে অগ্রগণ্য নেত্রী হিসেবে পরিচিত। ইউরোপের বিভিন্ন বড় দেশ যখন রাষ্ট্রীয় বাজেট নিয়ন্ত্রণ ও পূর্বতন প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন জার্মানিতে পুঁজির বিস্তার, রপ্তানি খাতে রেকর্ড পরিমাণ আয়, ক্রয়ক্ষমতাসহ প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে। এককথায় জার্মানির অর্থনীতি এগোচ্ছে, তবু গত আগস্ট মাসের এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করছে, জার্মানির অর্থনৈতিক সাফল্যের সমবণ্টন ঘটছে না।
জার্মানির নির্বাচনে শরণার্থীবিষয়ক ইস্যুকে একটি বড় বিতর্কিত বিষয় বলে ভাবা হয়েছিল। জার্মানিসহ ইউরোপের নানা দেশে ইসলামি সন্ত্রাসীদের হামলা বিষয়টিকে আরও প্রকট করেছিল। এ ছাড়া জার্মানির বৃহৎ দুই দলের জোট সরকারের নেতারা ১০ লাখের বেশি শরণার্থী গ্রহণ করার বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার জন্য জার্মানির জনগণকে বোঝাতে সচেষ্ট হয়েছেন। নির্বাচনের আগে ১৫০ জন সমাজবিজ্ঞানী শরণার্থীবিষয়ক এক গবেষণায় জার্মানির সমাজব্যবস্থায়, সাংস্কৃতিক পরিচয়ে বা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কতটুকু সমস্যা বা সম্ভাবনা রয়েছে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করে বলেছেন, সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে এ বিশালসংখ্যক শরণার্থী জার্মানিতে কার্যকর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।
তবে এ ধরনের সমাজ বিশ্লেষণের বাইরে জার্মানিতে বিশালসংখ্যক মানুষ আঙ্গেলা ম্যার্কেলের শরণার্থী নীতি মোটেও পছন্দ করেননি। জার্মানির পূর্বাঞ্চল বা সাবেক পূর্ব জার্মানির বেশির ভাগ অংশেই যেখানে ম্যার্কেল নির্বাচনী প্রচারণায় গেছেন, সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন, স্লোগান ও ভেঁপু বাজিয়ে বিক্ষোভ এবং তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বলা হয়েছে। স্বল্পভাষী ম্যার্কেল একটি সভায় তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের উদ্দেশে বলেই ফেলেছেন, ভেঁপু বাজিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যায় না। ২৭ বছর আগে পূর্ব জার্মানির যে মানুষেরা সমাজতান্ত্রিক শিবির থেকে
বেরিয়ে এসে পশ্চিমা বা পশ্চিম জার্মানির রাজনীতি বা রাজনীতিকদের ওপর আস্থা
রেখে দুই জার্মানির একত্রকরণ চেয়েছিল, শরণার্থী ও অভিবাসন নিয়ে তাদের এমন আচরণ অভাবনীয়।
জার্মানির রক্ষণশীল, উচ্চবিত্ত, শিল্পপতিদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার দল হিসেবেই ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন দলের পরিচিতি আর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের পরিচয় প্রগতিশীল, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ খেটে খাওয়া নাগরিকদের দল হিসেবে। তবে যেহেতু এই বড় দুই দল চার বছর ধরে জোটবদ্ধ হয়ে দেশ শাসন করেছে, সেহেতু অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো দলকেই এককভাবে দোষ দেওয়া যাবে না।
নানা জনমত ও জরিপে জার্মানির রাজনীতিতে এবং নিজের দলে শক্ত ভিত গড়া বর্তমান চ্যান্সেলরকে সম্ভাব্য বিজয়ী মনে
হলেও ভবিষ্যতে তিনি কোন দলের সঙ্গে আগামী চার বছরের জন্য সরকার গঠন করবেন, তা দেখতে ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি।
[email protected]