সু চিকে বেশি দোষী করলে সশস্ত্র বাহিনী লাভবান হবে

কুয়ালালামপুরে আয়োজিত আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের মূল সংগঠক, মালয়েশিয়ার মানবাধিকারকর্মী অধ্যাপক চন্দ্র মোজাফফর। তিনি অলটারনেটিভ পলিটিকস ফর সাউথ এশিয়া: আ বুড্ডিস্ট-মুসলিম ডায়ালগ (১৯৯৯) বইয়ের লেখক। কুয়ালালামপুরে তাঁর সাক্ষাৎকারটি নেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান

অধ্যাপক চন্দ্র মোজাফফর
অধ্যাপক চন্দ্র মোজাফফর

প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক গণ-আদালত শুক্রবার রায়ে মিয়ানমার রাষ্ট্রকে গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছে। এই রায়ের কী প্রভাব আশা করেন?
চন্দ্র মোজাফফর: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর এর একটা প্রভাব থাকবে। কিন্তু তা অনতিবিলম্বে অনুভূত হবে না। তবে তিনটি পর্যায়ে এর প্রভাব পড়বে। স্বল্প মেয়াদে আমি অন্তত কিছু প্রভাব আশা করি। কিন্তু মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে যে প্রভাব পড়বে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের নাগরিক সমাজের ওপর এর প্রভাব পড়বে। মানুষ এখন আগের থেকে অনেক বেশি ভালোভাবে বুঝতে পারবে যে মিয়ানমারে গণহত্যা চলছে। আসিয়ান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বুঝতে পারবে। সরকারগুলোও এখন এই রায় দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত হবে বলে আমি আশাবাদী। সরকারগুলোর পদক্ষেপ সর্বদা মন্থর হয়ে থাকে। তবে বিশেষ করে গণতান্ত্রিক দেশ ও সমাজগুলোতে একটা সাড়া পড়বে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত এবং নিশ্চিতভাবেই পশ্চিম ইউরোপের সরকারগুলোর মধ্যে একটা মূল্যায়নের বিষয় থাকবে। সর্বোপরি মিয়ানমারের অভ্যন্তরে এই রায় ও তার পর্যবেক্ষণের একটা প্রভাব আশা করি। সেখানে কী ঘটছে সেটা জনগণকে জানতে দেওয়া হচ্ছে না। মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কোনোভাবেই শ্রদ্ধাশীল কোনো মর্যাদার আসনে নেই। তাই এখন সময় এসেছে দেশটির জনগণ প্রশ্ন করতে শুরু করবে যে এসব যা করা হচ্ছে, তা কী করে তাদের স্বার্থের সুরক্ষা দেবে। আর তখন মিয়ানমারের সরকার পরিস্থিতির প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিতে শুরু করবে।
প্রথম আলো: এই রায়ের অন্যতম অর্জন হলো, মিয়ানমারে গণহত্যা ঘটছে তা প্রতিষ্ঠা। আসিয়ান এটা মানবে?
চন্দ্র মোজাফফর: আসিয়ানের সনদে যদিও এটা লেখা আছে যে তারা তাদের সদস্যরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না, কিন্তু সরকারগুলো এখন থেকে নিশ্চয়ই গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে শুরু করবে যে এটা গণহত্যা। শিগগিরই তারা বিষয়টি বিবেচনায় নিলেই মঙ্গল। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশীয় সরকারের তরফে একটা সাড়া কিন্তু মিলতে পারে।
প্রথম আলো: মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রশ্নে রাজপথে নেমেছেন। এখানে সরকার কি গণহত্যা বলেছে?
চন্দ্র মোজাফফর: সরকার এটাকে গণহত্যা ভাবে বলে মনে হয়।
প্রথম আলো: সরকারিভাবে দেওয়া তাদের বিবৃতিতে এটা বলা হয়েছে?
চন্দ্র মোজাফফর: না, এখনো তারা তা বলেনি। সরকারিভাবে দেওয়া বিবৃতিতে এবং রাজনীতিকেরা একাধিকবার জাতিগত নিধন (এথনিক ক্লিনজিং) শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এটা তো কোনো আইনি পরিভাষা নয়। আন্তর্জাতিক আইন এটা সমর্থন করে না।
প্রথম আলো: শাস্তি এড়াতে সার্ব যুদ্ধাপরাধী মিলোসেভিচের বের করা জাতিগত নিধন শব্দ কেন ব্যবহৃত হচ্ছে? এমনকি কয়েক দিন আগে জাতিসংঘের মহাসচিব পর্যন্ত এক প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করেন, জাতিগত নিধন ছাড়া রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তিনি আর কী জুতসই শব্দ ব্যবহার করবেন?
চন্দ্র মোজাফফর: গণহত্যার পরিবর্তে জাতিগত নিধন শব্দের ব্যবহার অজ্ঞতাপ্রসূত মনে হয়। মিলোসেভিচের বিষয়টি তাঁরা জানেন না। মিয়ানমার তো রাখাইনে কোনো ভূমি পরিষ্কার করছে না। এই পরিভাষা ব্যবহারের কোথাও একটা গ্রহণযোগ্যতা থাকতে পারে। কিন্তু রাখাইনের পরিস্থিতিতে মোটেই তা যথাযথ নয়।
প্রথম আলো: আপনি কি জাতিসংঘ, আসিয়ান এবং সিএনএন ও বিবিসির মতো সংস্থাগুলোর কাছে গণহত্যা শব্দ ব্যবহার করতে আহ্বান জানাবেন?
চন্দ্র মোজাফফর: সাত সদস্যের পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনালের সভাপতি দানিয়েল ফিয়েরেস্তেইন যেমনটা বলেছেন, পিপিটির পক্ষ থেকে এর অনুলিপি জাতিসংঘ, আসিয়ান, বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকসহ শীর্ষস্থানীয় সব সংবাদ সংস্থার কাছে পাঠানো হবে। আর রায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত থাকবে। সুতরাং এটা প্রেরণের পরে কী ফলাফল পাওয়া যায়, সেটা দেখতে আমি উদ্গ্রীব থাকব। এবারে রোহিঙ্গারা যখন ব্যাপকভাবে নৃশংসতার শিকার হলো, তখনই কিন্তু বিশ্বকে সজাগ হতে দেখা গেছে। অথচ দীর্ঘদিন ধরেই তারা নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে চলছিল। যদি এবারে তারা এতটা ব্যাপক মাত্রায় সহিংসতার কবলে না পড়ত, তাহলে বিশ্বকে এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা যেত না।
প্রথম আলো: রায়ের পর্যবেক্ষণে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে যে এখনই মিয়ানমারকে না থামালে সামনে আরও বড় মাপের গণহত্যা ঘটতে পারে সেখানে। আপনার মন্তব্য কী?
চন্দ্র মোজাফফর: সেটা আমরা জানি না। তবে অধুনা মিয়ানমার সরকারের তরফে কিছুটা বিচক্ষণতার ইঙ্গিত মিলছে। আপনি যদি অং সান সু চির সর্বশেষ ভাষণ দেখেন, সেখানে কিন্তু তিনি আগে যেমনটা বলেছিলেন, তা থেকে কিছুটা ভিন্নতর মনে হয়। সু চির আগের অবস্থান থেকে আমি কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করি।
প্রথম আলো: আপনি কীভাবে এটা যৌক্তিক মনে করেন?

সু চি বেসামরিক নাগরিক এবং একটি নির্বাচন হওয়ার মানে এই নয় যে দেশটি সামরিক বাহিনীর নিগড়মুক্ত হয়েছে। সব ক্ষমতা তাদের হাতেই রয়ে গেছে

চন্দ্র মোজাফফর: এর আগে এ বিষয়ে দেওয়া তাঁর বক্তব্য মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বক্তব্যের অত্যন্ত কাছাকাছি ছিল। কিন্তু এবারের তাঁর ভাষণ সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হলো, এক অর্থে তিনি সামরিক বাহিনীর অবস্থানের সঙ্গে নিজের অবস্থানের কিছুটা হলেও দূরত্ব তৈরির চেষ্টা করেছেন। যা-ই হোক না কেন, এটা তো ঠিক যে সশস্ত্র বাহিনী তার বিরুদ্ধে ছিল। আপনি লক্ষ করবেন যে তিনি বলেছেন, আমরা দীর্ঘ সময় একটা কর্তৃত্ববাদী শাসনের কবলে ছিলাম। মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে একটা বড় পরিবর্তন আশা করা চলে না। সুতরাং তিনি যাকে কর্তৃত্ববাদী শাসন বলে একটা অনাস্থার মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, সেটা তো সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধেই গেছে। তাই নয় কি? সে কারণে আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক চাপ এবং সু চির প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মানুষের মন্তব্য—এসব তিনি বিবেচনায় নিয়ে নিজের অবস্থানকে একটু পরিশীলিত করার চেষ্টা করেছেন।
প্রথম আলো: তাহলে বিশ্ব কি এত কিছুর পরও সু চির ওপর ভরসা রাখবে? সু চি তাঁর বর্তমান অবস্থানে থেকে পরিবর্তনে সহায়ক হবেন বলে আশা করেন? তাঁর ওপরে আমাদের আস্থাশীল থাকতে বলেন?
চন্দ্র মোজাফফর: আমি মনে করি না যে বিষয়টিকে এভাবে দেখাটাই গুরুত্বপূর্ণ। অং সান সু চির ওপর খুব বেশি ফোকাস করার মতো ভুল আমাদের করা উচিত হবে না। কারণ, তিনি মিয়ানমারের একটি অবয়ব মাত্র। দেশটির প্রকৃত ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর কাছে রয়ে গেছে। সরকারটি সু চির নয়, সামরিক বাহিনীর। সু চি বেসামরিক নাগরিক এবং একটি নির্বাচন হওয়ার মানে এই নয় যে দেশটি সামরিক বাহিনীর নিগড়মুক্ত হয়েছে। সব ক্ষমতা তাদের হাতেই রয়ে গেছে। আমি মনে করি, আমাদের অবশ্যই এটা বুঝতে হবে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আমরা সুখী করতে পারি না। আমি মনে করি, সামরিক বাহিনী এখন নিজেদের সুখী ভাবতে পারে। কারণ, আমরা সু চির ওপর যথেষ্ট বেশি আলো ফেলছি।
{উল্লেখ্য, মিয়ানমারের বর্তমান সংবিধান সু চির ক্ষমতা সীমিত করে ফেলেছে। বিদেশি নাগরিক বিয়ে করায় সু চি এই সংবিধান অনুযায়ী দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। তা ছাড়া, পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ, নিম্নকক্ষ ও রাজ্যস্তরে সেনাবাহিনীর জন্য ২৫ শতাংশ আসন বরাদ্দ রয়েছে। মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদ প্রতিরক্ষা, সীমান্ত সুরক্ষা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদেও আছেন সেনা কর্মকর্তারা৷ সু চির দল এনএলডি ক্ষমতায় থাকলেও তিনি শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি স্টেট কাউন্সেলর পদে আছেন।}
প্রথম আলো: নিউইয়র্কভিত্তিক জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যানটন বলেছেন, সু চি রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করে তাঁর বাবার অনুসৃত নীতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
চন্দ্র মোজাফফর: আমি ড. স্ট্যানটনের সঙ্গে একমত। রোহিঙ্গাসহ জাতিগত সংখ্যালঘুদের ধারণ করে তাঁর পিতা অং সান একটি বুদ্ধিদীপ্ত নীতি গ্রহণ করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, অং সান তাঁর মন্ত্রিসভায় সুচিন্তিতভাবে মুসলিম মন্ত্রী নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু এখন সু চি দেখছেন, মিলিটারি না চাইলে তিনি ক্ষমতায় আসতে বা থাকতে পারবেন না।
প্রথম আলো: ডেসমন্ড টুটু সু চিকে তাই লিখেছেন, রোহিঙ্গা নিধনে নীরবতা যদি তার মূল্য হয়, তাহলে সেটা চড়া। ক্ষমতায় টিকে থাকা না-থাকা, কোন বিকল্প নেবেন তিনি? ক্ষমতা ছাড়বেন?
চন্দ্র মোজাফফর: তিনি (সু চি)ÿক্ষমতা ছাড়বেন না। বিশ্বে কমসংখ্যক মানুষই সেটা দেখাতে পেরেছেন।
প্রথম আলো: একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে রোহিঙ্গা ইস্যু মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য আপনারা কোনো সুপারিশ?
চন্দ্র মোজাফফর: রায় ঘোষণার দিন মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিনিধি বাংলাদেশের নেওয়া পদক্ষেপের যে বিবরণ দিয়েছেন, তাতে এটা মনে হয় যে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অঙ্গীকারের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে গিয়েছেন, তাদের সুরক্ষায় অঙ্গীকার করেছেন, তা বেশ সন্তোষজনক।
প্রথম আলো: মালয়েশীয় সমাজে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে কোনো ভিন্নমত আছে কি?
চন্দ্র মোজাফফর: কিছু উদ্বেগ আছে। যেমন রাখাইনে কী ঘটে চলছে এবং দীর্ঘ মেয়াদে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন কী উপায়ে মোকাবিলা করা হবে, সেসব বিষয়ে। এখন বড় প্রশ্ন হলো, রোহিঙ্গাদের জন্য কী করে আইনের শাসনের সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব। মানবিক সহায়তা প্রদানের প্রশ্নে মালয়েশীয় নাগরিক সমাজে বিরাট ঐকমত্য রয়েছে।
প্রথম আলো: মালয়েশীয় বিরোধী দল কীভাবে দেখছে?
চন্দ্র মোজাফফর: আমি মনে করি, সার্বিকভাবে মালয়েশিয়ার বিরোধী দল রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহানুভূতিশীল রয়েছে। শুধু সরকারই নয়, বিরোধী দলও এর সুরাহা চাইছে।
প্রথম আলো: মাহাথির মোহাম্মদের বিখ্যাত রাজনৈতিক শত্রু কারাবন্দী আনোয়ার ইব্রাহিমের দলের ভূমিকা কী?
চন্দ্র মোজাফফর: তারাও রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম আলো: সরকারের ভূমিকার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে?
চন্দ্র মোজাফফর: সরকারের প্রতি নয়, মিয়ানমারের জনগণের (রোহিঙ্গা) প্রতি তারা তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে। বিরোধী দলের সব সময় একটি নিজস্ব অবস্থান থাকে, সেটা এখানেও রয়েছে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
চন্দ্র মোজাফফর: ধন্যবাদ।