উল্টো পথের মানুষ

জরিমানা করা হলেও উল্টো পথে গাড়ি চলছেই
জরিমানা করা হলেও উল্টো পথে গাড়ি চলছেই

বাংলাদেশের ট্রাফিক পুলিশ এক অভূতপূর্ব কাজ করছে কয়েক দিন ধরে। ঢাকা শহরের রাস্তায় উল্টো পথে চলা গাড়ি ধরছে তারা। এই অপরাধের জন্য জরিমানা করছে এবং মামলাও দিচ্ছে। অবৈধ পথে চলা গাড়িগুলোর মালিক বা যাত্রীরা ছিলেন প্রতিমন্ত্রী, বিচারক, সচিব, পুলিশ, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী।

এসব শ্রেণির মানুষের সমাজে যথেষ্ট প্রতিপত্তি রয়েছে। তাঁদের অনেকে বড় বড় অনিয়ম করলেও থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাঁদের হাত ক্ষেত্রবিশেষে কতটা বড় হতে পারে, তার একটি দৃষ্টান্ত কিছুদিন আগে আমরা পেয়েছি প্রথম আলোর রোজিনা ইসলামের প্রতিবেদনে। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সরকারদলীয় এক প্রভাবশালী দম্পতি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এক নৃশংস খুনিকেও পাগল সাজিয়ে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে ক্ষমা করিয়ে নিয়েছেন। এই অবিশ্বাস্য ঘটনা আমাদের আবারও দেখিয়ে দিয়েছে যে এ দেশের আইন আর বিচারব্যবস্থাকে কী অবলীলায় বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পারেন ক্ষমতাশালীরা।

উল্টো পথে চলা যাঁদের গাড়ি আটকে দিয়েছে পুলিশ, তাঁরা একই বা কাছাকাছি ধরনের ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ। তাঁদের ক্ষমতা জানি আমরা। ঢাকা শহরের পথে আমরা সাধারণ মানুষেরা আটকে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আটকে থাকে স্কুল-ফেরতা শিশু, হাসপাতালগামী বৃদ্ধ, ক্লান্ত পোশাকশ্রমিক। আর আমাদের নাকের ডগা দিয়ে হুস করে উল্টো পথে চলে যায় তাঁদের পতাকাধারী গাড়ি। এমনও দেখা যায় যে ট্রাফিক পুলিশকেই বিকট হর্ন দিয়ে ছিটকে ফেলে উল্টো পথে যাচ্ছেন তাঁরা।

এসব দৃশ্য ঢাকা শহরে এবং দেশের আরও বহু জায়গার নিত্যদিনের ঘটনা। রাজপথে এত প্রকাশ্যে আইনের লঙ্ঘন কোনো সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে এই লঙ্ঘনকারীদের কেউ কেউ আবার নিজেরাই আইনপ্রণেতা বা আইন প্রয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্ত। এসব জেনেশুনেও আমরা কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাই না। পুলিশকে একবার জিজ্ঞেসও করতে পারি না। রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে, তৃষ্ণায় হাঁপাতে হাঁপাতে প্রতিদিন আমরা দেখি এই নির্লজ্জ অনাচার। এমন এক দেশে পুলিশ হঠাৎ ধরছে এসব গাড়ি! বিশ্বাস হয় আমাদের?

বিশ্বাস হয়তো হচ্ছে কোনোমতে। কিন্তু সন্দেহ হয়, আসলে এগুলো গিমিক বা ফ্লুক কি না। এই অভিযান শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে কি না। নাকি আরও বহু ঘটনার মতো কিছু শিরোনাম তৈরি করে মিলিয়ে যাবে ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা।

এসব প্রশ্ন সমাজে আছে। আছে আরও কিছু প্রশ্ন।

২.

ট্রাফিক পুলিশ নাকি উল্টো পথের গাড়ি ধরছে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান বলেছেন বলে। প্রশ্ন হচ্ছে উল্টো পথের গাড়ি ধরতে বলা কি দুদকপ্রধানের কাজ? ট্রাফিক পুলিশের প্রধান, পুলিশের আইজি—তাঁরা কখনো বলেননি পুলিশকে উল্টো পথের গাড়ি ধরতে? নাকি তাঁরাও চলেন উল্টো পথে? কিংবা বিশ্বাস করেন যে আদেশে উল্টো পথে চলা শক্তিধররা থাকবেন আইনের ঊর্ধ্বে? আইন প্রয়োগ হবে শুধু সাধারণ মানুষের বেলায়?

ট্রাফিক পুলিশের প্রশংসনীয় গাড়িধরা অভিযানেও আমরা দেখি একধরনের বৈষম্য। এই অভিযানে জরিমানা হচ্ছে কেবল চালকদের। সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিবের গাড়ি নিয়ে পরপর দুবার উল্টো পথে গিয়ে একজন চালক চাকরি থেকে অব্যাহতিও পেয়েছেন। অথচ কে না জানে গাড়ির মালিকের নির্দেশ বা সমর্থন না থাকলে কোনো চালকের সাহস হবে না উল্টো পথে চলার। যদি তা-ই হয়, তাহলে সমবায়সচিবেরও শাস্তি হওয়ার কথা। শৃঙ্খলাবিধি বা আচরণবিধি অনুসারে কোনো না কোনো জবাবদিহির মধ্যে পড়ার কথা উল্টো পথের অন্য সরকারি কর্মকর্তাদেরও। কিন্তু আমরা কি সত্যি আশা করতে পারি কোনো শাস্তি পাবেন তাঁরা? পারি না। কত বড় বড় অপরাধ করে পার পেয়ে যান এ দেশের উঁচুতলার মানুষেরা। আর সামান্য উল্টো পথে চলার জন্য শাস্তি হবে তাঁদের? মনে হয় না।

কিন্তু উল্টো পথে যদি আটক হতো সাধারণ মানুষকে বহনকারী সাধারণ কোনো মালিকের কোনো বাস? নিশ্চয়ই দফারফা হয়ে যেত চালক-মালিক দুজনেরই। এই শ্রেণির মানুষ নিশ্চয়ই জানেন এটা। আমরা তাই দেখি না উল্টো পথে গিয়ে আটকে পড়েছেন তাঁরা। উল্টে পথে আমরা শুধু একধরনের বাসকেই দেখি মহা সমারোহে যেতে। সেটি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বহনকারী বাস। একসময় এই ছাত্ররাই প্রতিবাদ জানাত সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচার আর ভুয়া শাসকের অন্য পথে চলাকে রুখে দিত বুকের রক্ত দিয়ে। সময় বদলেছে। তাদের তেজ আর বিক্রম এখন রাজপথে সোজা পথে চলা সাধারণ মানুষের যানবাহনকে ছিটকে ফেলে দিয়ে এগোনোর মধ্যে। এরা জানে কখনো সমস্যায় পড়লে তাদের ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য আছেন ভিসি বা প্রভাবশালী শিক্ষকনেতা। এরা জানে কয়েক বছর পর বড় চাকরি পেয়ে বা বড় নেতা হয়ে স্বনির্ভরভাবেই উল্টো পথে চলতে পারবে তারা। পুলিশও জানে এটা।

এমন এক দেশে এমন এক সমাজ-সংস্কৃতিতে সত্যি কি উল্টো পথে চলার আসল কুশীলবদের কোনো শাস্তি হবে? পুলিশের অভিযানে সত্যি কি থেমে যাবে উল্টো পথে গাড়ি চলা? নাকি অচিরেই শেষ হয়ে যাবে এই অভিযান। আমার ধারণা, দ্বিতীয়টাই ঘটবে খুব শিগগির। যাঁরা বোকার মতো একটু আশাবাদী হয়েছেন, তাঁদের ভুল ভাঙবে। এই সমাজে রাজপথে উল্টোভাবে চলা মানুষ বরং বাড়বে। বাড়বে আরও বহুভাবে উল্টো পথে চলা মানুষের সংখ্যাও।

৩.

উল্টো পথের মানুষের অবশ্য নানা অজুহাত থাকে। যেমন তাঁরা ঘুষ দেন, ঘুষ নেন স্পিড মানি হিসেবে। তাঁরা দুর্নীতিকে যৌক্তিক করেন পুঁজিবাদের প্রথম পর্বের মানি অ্যাকুমিউলেশন হিসেবে। তাঁরা স্বজনপ্রীতি করেন অপশক্তিকে রুখে দেওয়ার কথা বলে। নির্বাচনে কারচুপি করেন উন্নয়নের জোয়ার ধরে রাখার কথা বলে।

উল্টো পথের গাড়ি চালনার অজুহাতও আছে তাঁদের। তাঁরা সমাজের অতি ব্যস্ত বা অতি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা মিটিংয়ের কথা বলে তাঁরা উল্টো রাস্তায় চলেন। উল্টো পথের রাস্তায় যদি লাগে এক ঘণ্টা, দুঃসহ যানজটের এই শহরে
সোজা রাস্তায় তাহলে লাগে তিন ঘণ্টা। অফিস বা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সময় তাঁদের বাঁচাতে হয় দুই ঘণ্টা, বাসায় ফিরে বিশ্রাম নেওয়ার জন্যও বাঁচাতে হয় আরও দুই ঘণ্টা। কাজেই যুক্তি একটা আছে তাঁদের।

কিন্তু এই যুক্তি অসাড় যুক্তি। কারণ, রাজপথে চলা প্রায় প্রত্যেক মানুষেরই রয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রত্যেকেরই রয়েছে বাসায় ফেরার তাড়া। চাকরি বাঁচাতে, সারা দিন দূরে রাখা সন্তানের মুখ দেখতে, জরুরি চিকিৎসা নিতে—এমন আরও বহু প্রয়োজনে সবাইকেই গন্তব্যে পৌঁছাতে হয় ঠিক সময়ে।

উল্টো পথে কিছু গাড়ি চলার কারণে কখনো কখনো আরও দেরি হয়ে যায় তাঁদের। চোখ তাতিয়ে ওঠে জাজ্বল্যমান বৈষম্য দেখে। মন বিষিয়ে ওঠে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা ভেবে।

উল্টো পথের মহারথীরা কি জানেন এসব? নিশ্চয়ই জানেন। কিন্তু পাত্তা দেন না, দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন না।

৪.

প্রশ্ন আসে, তাহলে সমাধান কিসে? সমাধান হওয়া উচিত ছিল আরও আগে। ঠিকমতো নগর আর যান ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা করা গেলে এতটা দুঃসহ হতো না শহরের ট্রাফিক জ্যাম। যে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা রাস্তায় নষ্ট হয় প্রতিদিন, যে অতিরিক্ত প্রায় ২০০ শতাংশ তেল আর গ্যাস পোড়ে এই সময়ে, তা-ও অনেকাংশে এড়ানো যেত তাহলে।

আমাদের কর্তাব্যক্তিরা তা করেননি। নিজস্ব কোটারি স্বার্থে বা অদক্ষতায় তাঁরা অপরিকল্পিতভাবে শহরকে বেড়ে উঠতে দিয়েছেন। গণপরিবহনের ওপর জোর না দিয়ে প্রাইভেট গাড়ির জঙ্গল গড়ে উঠতে দিয়েছেন, মাস্তানকে ফুটপাত দখল করতে দিয়েছেন, এই শহরের জমি দখল করতে দিয়েছেন ভূমিদস্যুদের। যথেচ্ছ প্রটোকলের নামে নিজেরা রাস্তা গ্রাস করে রাখার সংস্কৃতি চালু করেছেন। ভয়াবহ জনবহুল এই দেশে চরম এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে ঢাকাকে পৃথিবীর মন্থরতম শহরে পরিণত করেছেন।

এতে তাঁদের সমস্যা হয়নি। কারণ, তাঁদের রয়েছে উল্টো পথ। নিজের গতি ঠিক রাখার জন্য তাঁরা বা তাঁদের শ্রেণির মানুষেরা উল্টো পথ ধরছেন। আরও বেশি ক্ষমতাশালী হলে পুরো শহরকে থামিয়ে দিয়ে নিজেরা চলাচল করেছেন। শহরের উপকণ্ঠে একরের পর একর জমির মালিক হয়ে নিজেদের অবকাশকেন্দ্র করেছেন। কেউ কেউ আবার সেখানে যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টার কিনেছেন। নিজেদের সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে গতিময় শহরগুলোতে।

তাঁদের কয় দিন ঠেকাবে সামান্য ট্রাফিক পুলিশ? কয় দিন তাঁদের খবর ছাপাবে সামান্য সংবাদপত্র?

তবু এই অভিযান চলুক যত দিন সম্ভব। গাড়ির পেছনে নিজের চেহারা, নিজের নাম লুকিয়ে রাখুক মহারথীরা। কিছুদিন কিছুটা সময় হলেও আনন্দিত থাকি আমরা আমজনতা।

চোরের নাকি দশ দিন, গৃহস্থের এক দিন। আমাদের দেশে চোরের থাকে প্রতিটি দিন, গৃহস্থের খুবই হঠাৎ এক দিন। তবু সেই হঠাৎ এক দিনের জন্য ধন্যবাদ ট্রাফিক পুলিশ ভাইদের। ধন্যবাদ তাঁদের, যাঁরা মাত্র কয়েক দিনের জন্য হলেও আইনকে ঊর্ধ্বে থাকতে দিয়েছেন। কিছুটা হলেও কান রগড়ে দিয়েছেন স্বেচ্ছাচারী আর স্বার্থপর মানুষদের।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।