মন্ত্রীর হাতে ঝাড়ু, মেয়রের খোলা চিঠি

মোশাররফ হোসেন ও আ জ ম নাছির উদ্দিন।
মোশাররফ হোসেন ও আ জ ম নাছির উদ্দিন।

গণপূর্তমন্ত্রী যখন ঝাড়ু হাতে একটি পার্কের পরিচ্ছন্নতার কাজে নেমে পড়লেন, তখনই মনে হয়েছিল এর কোনো প্রতীকী তাৎপর্য আছে। ওই দিনই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নগরবাসীর উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি দেওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া গেল, অনুমান সঠিক। দুয়ে দুয়ে চার মিলেছে।

চট্টগ্রাম ডিসি হিল পার্কে নিয়মিত প্রাতর্ভ্রমণ করেন, এমন কিছু ব্যক্তি ‘ইয়োগা প্রভাতী’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। ‘পরিচ্ছন্নতা নিজেরাই করি, কারও জন্য অপেক্ষা নয়’ শিরোনামে পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন সংগঠনটির ৮১ জন সদস্য।
এই কার্যক্রমে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে নিজেই ঝাড়ু হাতে নেমে পড়ে মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন প্রকারান্তরে এ কথাই তুলে ধরতে চেয়েছেন যে সিটি করপোরেশন ঘরে ঘরে প্রচারাভিযানসহ নানা রকম উদ্যোগ-আয়োজন করেও শহরটিকে আদৌ ময়লা-আবর্জনামুক্ত করতে পারেনি। ডিসি হিল পার্কের দুরবস্থা তারই প্রমাণ।

মন্ত্রীর না বলা কথার মর্ম মেয়র যথার্থ অনুধাবন করতে পেরেছেন বলেই মনে হয়। ভোর সকালে হাতে ঝাড়ু নিয়েছিলেন মন্ত্রী, ওই দিন রাতেই নগরবাসীর কাছে খোলা চিঠি লিখে নিজের গৃহীত কার্যক্রমের বর্ণনা তুলে ধরে তাই ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা করেছেন মেয়র। গণমাধ্যমকর্মীদের ই-মেইলে পাঠানো নাগরিকদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে মেয়র তাঁর গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের ফিরিস্তি দিয়ে বলেছেন, আগের নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক দায় মাথায় নিয়ে নাগরিকদের সেবায় তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। নগরে বিলবোর্ডের জঞ্জাল সরিয়েছেন। নিরাপদ চলাচলের জন্য ফুটপাত হকারমুক্ত করেছেন, জনবলসংকট সত্ত্বেও ডোর টু ডোর বর্জ্য সংগ্রহের কাজ চলছে।

এসব উদ্যোগই যে যথেষ্ট নয়, তা-ও বিলকুল অবহিত আছেন মেয়র—এ কথা তাঁর চিঠি পড়লেই বোঝা যায়। ‘আর্থিক সংকট’কে এর মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, আগামী আট মাসের মধ্যে তাঁর দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর সব বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হবে।

খোলা চিঠিতে মেয়র অভিযোগ করেছেন, নানা মহল তাঁর বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এই ‘নানা মহল’ কে বা কারা?

চট্টগ্রামে বিএনপি বা অন্য কোনো বিরোধী দলকে নগর উন্নয়ন বা স্থানীয় কোনো ইস্যুতে কথা বলতে দেখা যায়নি দীর্ঘকাল। দলীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষিত কিছু কর্মসূচি দায়সারাভাবে পালন ছাড়া স্থানীয় বিএনপির আর কোনো তৎপরতাও অবশ্য চোখে পড়ে না। এই শহরের অধিবাসীদের নাগরিক সুখ-দুঃখ নিয়ে কথা বলতে হলে নাগরিক সংগঠন বা ফোরাম গড়ে তোলা দরকার। সে রকম উদ্যোগ, এমনকি সামর্থ্যও হয়তো তাদের নেই। তা ছাড়া অন্যদিক থেকে ভাবলে ক্ষমতাসীন দলের মেয়রের বিরুদ্ধে যদি তাঁর দলেরই নেতা-কর্মীরা সরব থাকেন, তাহলে অনর্থক বিরোধী দল কেন শক্তির অপচয় করতে যাবে। তাহলে এটা নিশ্চিত হওয়া গেল, ‘বিভ্রান্তি’ ও ‘অপপ্রচারের’ জন্য যে ‘নানা মহলের’ প্রতি ইঙ্গিত করেছেন মেয়র, তাঁরা তাঁর দলেরই নেতা-কর্মী। তাঁদের কারও কারও সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরোধ তাঁর, কারও সঙ্গে এ বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে সাম্প্রতিক কালে।

গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে বিরোধ যে খুব বেশি দিনের নয়, এর স্বীকারোক্তি পাওয়া যায় সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র চৌধুরী মোহাম্মদ হাসনীর বক্তব্যে। এক অনুষ্ঠানে সম্প্রতি নাছিরের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত এই কাউন্সিলর মন্ত্রীর উদ্দেশে এ কথাও বলেছেন, ‘আপনারাই তাঁকে (আ জ ম নাছির উদ্দিন) মেয়র বানিয়েছেন। আপনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁকে মেয়র করার জন্য সুপারিশ করেছিলেন...।’

তাহলে এই সুসম্পর্কের দ্রুত অবনতি হলো কেন? আমাদের ধারণা, জাতিসংঘ পার্কের কর্তৃত্ব সিটি করপোরেশনের, না গণপূর্ত বিভাগের—এই নিয়ে দ্বন্দ্ব সম্পর্কের অবনতির মূল কারণ। পাঁচলাইশ জাতিসংঘ পার্কের উন্নয়নের জন্য একটি প্রস্তাব দিয়েছিল গণপূর্ত বিভাগ। কিন্তু সিটি করপোরেশন আপত্তি তোলায় প্রকল্পটি আটকে যায়। এ নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানিয়েছেন মন্ত্রী। বিষয়টি এখন আইনি জটিলতায় গড়িয়েছে।

সাধারণ নাগরিকেরা চান পার্কটির উন্নয়ন হোক। অবকাশযাপন ও মুক্ত নিশ্বাস নেওয়ার স্থান যেখানে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে, সেখানে এ রকম পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা সুপরিসর পার্কটিকে ঢেলে সাজালে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। এখন মালিকানা স্বত্বের বিরোধের কারণে নাগরিকদের বঞ্চিত করাটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এর মীমাংসাও খুব দুরূহ বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে মেয়র নিজেই উদ্যোগ নিয়ে তাঁর এককালের ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’র দ্বারস্থ হতে পারেন।

মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ সালামের বিরোধ রয়েছে। এখন নতুন করে প্রবীণ রাজনীতিবিদ মোশাররফ হোসেনের সঙ্গেও তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় তিনি যে দলে ক্রমে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন, এ কথা তো তাঁর না বোঝার কথা নয়।

দলীয় অন্তঃকোন্দলের কথা বাদ দিলেও মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে আ জ ম নাছিরের নগর উন্নয়ন ও নাগরিক সেবার বিভিন্ন প্রশ্নে মতবিরোধ আছে। এই মুহূর্তে সামনে চলে এসেছে গৃহকর পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি। গৃহকর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সোচ্চার মহিউদ্দিন চৌধুরী। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে এ নিয়ে সভা-সমাবেশও করেছেন তিনি। আ জ ম নাছির বলছেন, গৃহকর নির্ধারণের ব্যাপারটি তাঁর এখতিয়ারভুক্ত নয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গেজেটের মাধ্যমে এটি নির্ধারণ করে। মেয়র বা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব তা বাস্তবায়ন করা। কিন্তু যত যুক্তির কথাই তিনি তুলে ধরেন না কেন, এখানকার নাগরিকেরা জানেন আগের দুজন মেয়র গৃহকর বাড়ানোর পদক্ষেপ নেননি। ফলে আগে পাওয়া সুবিধা থেকে নাগরিকেরা সহজে বঞ্চিত হতে চাইবেন না। তার ওপর মহিউদ্দিনের মতো নেতার ইন্ধন পেলে মানুষের ক্ষোভ সংগঠিত রূপ পাবে।

মেয়র হিসেবে নাছির উদ্দিনের দায়িত্ব গ্রহণের ২৬ মাস অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য নগরের বিলবোর্ড উচ্ছেদ। বর্জ্য অপসারণ ও ফুটপাত হকারমুক্ত করার উদ্যোগেও কিছুটা সাফল্য দাবি করতে পারেন তিনি। তবে এর পুরোপুরি সুফল পেতে আরও সময় লাগবে বলে ধারণা করি।

সাম্প্রতিক কালে নগরের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জলাবদ্ধতা। এর আগে সিডিএ, ওয়াসাসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীন কার্যক্রমের কারণে জলাবদ্ধতার মতো নাগরিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন মেয়র। অর্থাৎ সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এর সমাধান আশা করা যায় না।

এদিকে চট্টগ্রাম শহরের অধিকাংশ রাস্তাঘাট বেহাল। এ বিষয়ে মেয়রের প্রতিনিধি প্যানেল মেয়র চৌধুরী মাহমুদ হাসনী ভাগ্যকে দোষারোপ করে বলেছেন, ‘হয়তো শহরের রাস্তাঘাট কিছু কিছু খারাপ। এই ক্ষেত্রে বৃষ্টির জন্য কাজ করতে পারছি না। অথচ মৌসুমের এই সময়ে বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। হয়তো ভাগ্য আমাদের পক্ষে নাই।’

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর কারও হাত নেই। যেখানে ‘ভাগ্য অপ্রসন্ন’, সে বিষয়ে আমাদের বলারও বিশেষ কিছু নেই। কিন্তু যেসব সমস্যা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সমাধান সম্ভব, সেই সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না কেন, সেই প্রশ্ন তো নাগরিকেরা তুলবেনই। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অনৈক্য, উন্নয়ন প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে মতভিন্নতার দায় কেন বহন করতে হবে নগরবাসীকে?

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।