জার্মান ঐক্যের ২৭ বছর পর

জার্মান ঐক্যের ২৭ বছর: বিভক্তি পেছনে ফেলে সামনে এগোচ্ছে
জার্মান ঐক্যের ২৭ বছর: বিভক্তি পেছনে ফেলে সামনে এগোচ্ছে

বার্লিন প্রাচীর ভাঙার বয়স হতে চলল প্রায় তিন দশক। জার্মানিকে বিভক্ত করে রাখা কংক্রিটের সেই শক্ত প্রাচীর ভেঙেছে অনেক দিন, তবে এখনো ভাঙেনি মনের প্রাচীর। প্রায় ৪০ বছর পূর্ব জার্মানির মানুষ ছিল সমাজতান্ত্রিক নিয়মনীতির কড়া শাসনে আবদ্ধ। তারা নিজেদের মুক্ত করতে চেয়েছিল, পশ্চিমা গণতন্ত্রের স্বাদ পেতে সম্পৃক্ত হতে মিছিল জমায়েত করেছিল। নিজেদের মুক্ত করতে দেশত্যাগ করে ৫০ হাজার মানুষ হাঙ্গেরি আর অস্ট্রিয়ায় গিয়ে শরণার্থী হয়েছিল।

আজ এত দিন পর দেখা যাচ্ছে এদের অনেকেই যা চেয়েছিল, আর তারা যা পেয়েছে, সেই মূল্যায়নে কোথাও গড়বড় হচ্ছে। জার্মানির ঐক্যের ২৭ বছর পূর্তির ঠিক সপ্তাহখানেক আগে অনুষ্ঠিত ১৯তম নির্বাচনে দেখা গেল পূর্বাঞ্চলের ২২ শতাংশ ভোটার জার্মানির মূল ধারার দলগুলোকে সমর্থন না দিয়ে কট্টরবাদীদের ভোট দিয়েছেন। পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে সাক্সেনে আবার ৪৭ শতাংশ মানুষ কট্টর জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে রায় দিয়েছেন।

জার্মানি যখন ইউরোপীয় ঐক্য তথা বিশ্বরাজনীতিতে নিজেদের প্রজ্ঞা ও দক্ষতা দিয়ে জার্মান জাতির নতুন ইমেজ নির্মাণে ব্যস্ত, তখন সেই প্রগতির চাকাকে পেছনে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। একটি দেশের রাজনীতি এবং রাজনীতিকেরাই সবকিছুর পরিবর্তন ঘটাতে পারেন না, জনগণকেও পরিবর্তিত হতে হয়, সহযোগিতা থাকতে হয়। অথচ সাবেক পূর্ব জার্মানির অনেক মানুষ একসময় পরিবর্তন চাইলেও এখন তা আর আত্মস্থ করতে পারছেন না।

বিশ্বযুদ্ধের দায়ভার কাঁধে নিয়ে জার্মান জাতি বিভক্ত হয়েছিল ১৯৪৯ থেকে ১৯৯০ প্রায় ৪০ বছর। পূর্বে সমাজতান্ত্রিক আর পশ্চিমে পুঁজিবাদী জার্মানির ঘাড়ে চেপে ছিল ওয়ারশ আর ন্যাটো সামরিক জোট। দীর্ঘ শীতল স্নায়ুযুদ্ধের সময় পূর্ব আর পশ্চিমের রাজনৈতিক নেতৃত্ব মাঝে মাঝে এপার-ওপার সফর করতেন। কিছু ছোটখাটো চুক্তিও ছিল, তবে এগুলো বেশ সীমিত পর্যায়ের। আর জনগণ ছিল পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।

পূর্ব থেকে পশ্চিমে আসা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল, যাতে ধনতন্ত্রের চাকচিক্য আর ভোগ্যপণ্যের প্রলোভনে পূর্বে প্রবেশ করতে না পারে। সেই সময় পূর্ব থেকে সীমান্ত বা প্রাচীর পেরিয়ে পালিয়ে পশ্চিমে আসার চেষ্টায় ৩২৭ জন পূর্ব জার্মান নাগরিক সীমান্তরক্ষীদের হাতে নিহত হয়েছিল। বার্লিন প্রাচীরের পূর্ব দিকে কেউ ভয়ে আসত না নিষিদ্ধ এলাকা বলে আর পশ্চিমের মানুষ প্রাচীরের গায়ে ছবি আঁকত, কবিতা, বাণী—এসব লিপিবদ্ধ করত।

গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত জার্মান সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে বিগত ২৭ বছরের পূর্ব আর পশ্চিমের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ের পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে, বিগত সময়ের থেকে ক্রমেই পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্য অর্থনৈতিক অসমতা কমে আসছে। পূর্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পশ্চিমের তুলনায় ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ অর্থাৎ পশ্চিমের তুলনায় ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ কম।

এক বছর আগে জার্মান সরকারের পূর্ব অঞ্চলের পাঁচটি রাজ্য বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ইরিস গ্লাইকে সতর্ক করে বলেছেন, ওই অঞ্চলে ক্রমাগত বিদেশবিদ্বেষ চলতে থাকলে সামাজিক স্থিতিশীলতা আসবে না। এতে করে ওই সব অঞ্চলে পুঁজি বিনিয়োগসহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন হ্রাস পাবে।

১৯৯০ সালে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির প্রথম নির্বাচনী প্রচারে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির চ্যান্সেলর সদ্য প্রয়াত হেলমুট কোহল বলেছিলেন, সাবেক পূর্ব জার্মানির অস্থিতিশীল ও ভঙ্গুরপ্রায় অর্থনীতির বদলে শিগগিরই পশ্চিমের মতো উন্নত অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা হবে, অবশ্য তা ছিল নির্বাচনী বুলি।

৪০টি বছর ধরে দুই বিপরীতধর্মী সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে এক করে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি সহজ ছিল না। পূর্ব জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে বা ভর্তুকিচালিত অধিকাংশ কলকারখানা বন্ধ হয়েছিল। শ্রমিক–কর্মচারীদের কোনো রকম সহানুভূতি না দেখিয়ে ছাঁটাই করা হয়েছিল। অর্থনীতির ভাষায় বলা যায়, এটা ছিল ক্রান্তিকালীন অর্থনীতি।

তা ছাড়া দুটি দেশ ৪০ বছর ধরে লালিত হয়েছিল দুটি ভিন্ন ধ্যানধারণায়। আঞ্চলিক পার্থক্য তো ছিলই। তাই ঐক্যবদ্ধ জার্মানিতে পূর্ব অংশের জনগণের মাঝে অধিক গণতন্ত্র ব্যক্তি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দ্রুত চলে এলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ব্যাপারে তারা কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। এসব কারণে পূর্বের জনগণের মাঝে সামাজিক স্বীকৃতি না পাওয়ার বঞ্চনা ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছিল।

তবে সেই পুরোনো হতাশাবোধকে পুঁজি করে ধর্ম, বর্ণ, শরণার্থী ও অভিবাসীবিরোধী রাজনীতিকে সমর্থন জোগানো কখনোই গণতান্ত্রিক রাজনীতির সহায়ক হতে পারে না। তা ছাড়া এই রাজনীতি ঐক্যবদ্ধ জার্মানির চেতনার পরিপন্থী।

বার্লিনের ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এক গবেষণায় জানিয়েছে, ২৭ বছরে যুক্ত জার্মান জাতির সামাজিক, অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে নানা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দেশটির দুই অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্য, চাকরির সুযোগ, যোগাযোগব্যবস্থার ক্রমেই উন্নতি ঘটছে। পূর্ব জার্মানির কাঠামো পশ্চিমি ধাঁচে গড়ে তুলতে যে অঢেল অর্থের প্রয়োজন হয়েছে, তা জোগান দিতে সেই ১৯৯১ সাল থেকে সংহতি ভ্যাট চালু রয়েছে, যা আগামী ২০১৯ সাল পর্যন্ত চালু থাকার কথা রয়েছে। জার্মানির ৭৫ শতাংশ মানুষ মনে করে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল। এই যাবৎ পূর্বাঞ্চলে উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ইউরো।

জার্মানির সাইট পত্রিকা শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্ধৃতি দিয়ে জার্মানির এই বছর এবং আগামী বছরের অর্থনৈতিক পূর্বাভাস দিয়েছে। তারা বলেছে, এই বছর জার্মানির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধ ঘটবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ আর ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে ২ দশমিক ১ শতাংশে। আর জার্মানির কেন্দ্রীয় চাকরি বিনিয়োগ সংস্থা ২৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত তথ্যে জানিয়েছে, ঐক্যবদ্ধ জার্মানির ইতিহাসে এই প্রথম বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে।

জার্মানির ২৭ বছরের ইতিহাসের পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, কিছু বৈষম্য, কিছু অসন্তোষ থাকলেও জার্মান জাতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুই জার্মানির বিভক্তিকে পেছনে ফেলে ঐক্যবদ্ধভাবে এগোচ্ছে। আঙ্গেলা ম্যার্কেল আর তাঁর সহযোগী রাজনীতিকেরা জাতীয়, আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে ক্রমেই জার্মানিকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলছেন।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি।