হঠাৎ উত্তাল জাপানের রাজনীতি

জাপানের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন হঠাৎ করেই ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দেশের রাজনৈতিক মেরুকরণে নতুন কোনো মোড় এটা নিয়ে আসতে পারে কি না, তা নিয়ে চলছে নানা রকম কানাঘুষা। হঠাৎ করে দেখা দেওয়া এই অনিশ্চিত অবস্থার পেছনে আছে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সংসদের নিম্নকক্ষ ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচন আহ্বানের ঘোষণা। জাপানের ক্ষমতাসীন উদার গণতন্ত্রী দলের নেতৃত্ব ভেবেছিলেন, প্রধান বিরোধী গণতান্ত্রিক দলের ভেতরে চলতে থাকা কোন্দলে দলের জনসমর্থনের ভিত্তি দুর্বল হয়ে আসার আভাস পাওয়া যাওয়ায় সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী ফলাফলে দলীয় অবস্থান আরও কিছুটা পোক্ত করে নেওয়ার সুযোগ তাঁরা পাবেন, যা কিনা সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসায় দলকে সাহায্য করবে।

সংসদীয় গণতন্ত্রের এটা হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ একটি দিক, যা কিনা সময়ের সুযোগ নেওয়ার মতো সুবিধাজনক অবস্থা ক্ষমতাসীনদের জন্য তৈরি করে দেয় এবং ক্ষমতাসীনেরাও ঝোপ বুঝে কোপ মারার আশায় সে রকম সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। তবে হাওয়া অনুকূলে বয়ে যাওয়ার আভাস পাওয়া সত্ত্বেও এটা যে সব সময় তাঁদের অনুকূলে যায়, তা কিন্তু নয়। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের নিজের আঙুল কামড়ানো অবস্থা আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। রাজনীতির খেলায় হাওয়ার দিকবদল হতে যে খুব বেশি সময়ের দরকার হয় না, সেই হিসাব মাথায় তিনি রাখেননি বলেই এখন তাঁকে নিজের হাতের আঙুল কামড়াতে হচ্ছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেও তাঁর ব্রিটিশ প্রতিপক্ষের মতোই ঝোপ বুঝে কোপ মারার অপেক্ষায় ছিলেন এবং কয়েক দিন ধরে ঘটে চলা রাজনীতির পালাবদলের ডামাডোলে মনে হচ্ছে, তাঁকেও হয়তো থেরেসা মের মতোই নিজের বোকামির মাশুল দিতে হতে পারে।

নির্ধারিত সময়ে সংসদকে কার্যকর রাখার সুযোগ দেওয়া হলে জাপানে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ। অর্থাৎ, স্বাভাবিক অবস্থায় নিম্নকক্ষের মেয়াদ ছিল আরও এক বছরের বেশি। সাধারণ নির্বাচন ডাকার মতো তেমন কোনো জরুরি অবস্থাও দেশের সামনে দেখা দেয়নি। উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি ইতিমধ্যে গতানুগতিক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সংসদ ভেঙে দেওয়ার ঘোষণায় সেটি কোনো বিবেচ্য বিষয় হয়ে দেখা দেয়নি। প্রধান বিরোধী দল গণতান্ত্রিক পার্টিতে বেশ কিছুদিন ধরে নেতৃত্বের সংকট চলছিল এবং এই গ্রীষ্মে টোকিওর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলটির রীতিমতো ধরাশায়ী হওয়া দলের জনসমর্থনে ধস নামার আভাস দিচ্ছিল।

ফলে প্রধানমন্ত্রী আবে মনে করেছিলেন, বিলম্ব না করে সে রকম অবস্থার সুযোগ কাজে লাগানো হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তবে মানুষকে ধোঁকা দিতে হলে জুতসই একটি কারণ বেছে নিয়ে সেটা উপস্থিত করার প্রয়োজনীয়তা থেকে আগাম নির্বাচন আহ্বানের কারণ হিসেবে যে যুক্তি তিনি উপস্থাপন করেছিলেন তা হলো, ২০১৯ সালে নির্ধারিত ভোগ্যপণ্য কর বৃদ্ধি থেকে হওয়া বাড়তি আয় তিনি শুধু সরকারি ঋণ পরিষদের বাইরে বৃদ্ধদের স্বাস্থ্যসেবা ও শিশু পরিচর্যার মতো সমাজসেবামূলক কাজেও খরচ করাতে চাইছেন এবং সে জন্য জনগণের সম্মতি তাঁর দরকার। প্রধানমন্ত্রীর হয়তো ধারণা ছিল যে মানুষ তাঁর এই মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে বিশাল ভোটে দলকে আবারও ক্ষমতাসীন করবে। তবে অন্য একটি হিসাব তিনি একেবারেই গণনার মধ্যে রাখেননি এবং সেটাই এখন তাঁকে থেরেসা মের ভাগ্যবরণ করে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।

গ্রীষ্মকালের টোকিও স্থানীয় পরিষদের একই নির্বাচনে জাপানের প্রধান ক্ষমতাসীন দলটিও ব্যাপকভাবে মার খেয়েছিল। উদার গণতন্ত্রীদের দলছুট এক নেত্রী ইয়োরিকো কোইকে এর আগে টোকিওর গভর্নর নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নিজে প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেছিলেন এবং টোকিওর স্থানীয় নির্বাচনের আগে নিজের একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। টোকিওর নির্বাচনে সেই সময়ে ‘সর্বাগ্রে টোকিওবাসী’—এই অদ্ভুত নামের দলটি উদার গণতন্ত্রীদেরও ধরাশায়ী করেছিল। সংসদ ভেঙে দেওয়ার হাওয়া বইতে থাকার আঁচ করতে পেরে টোকিওর গভর্নর দলটিকে জাতীয় পর্যায়ের একটি দল হিসেবে গড়ে নেওয়ার চিন্তা থেকে ভিন্ন নামে এটির পুনরাবির্ভাব ঘটান এবং দলটি এখন জাপানি ভাষায় ‘কিবো’ বা ‘আশা’ নামের নতুন একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

রাজনৈতিক অবস্থানগত দিক থেকে শিনজো আবের সঙ্গে ইয়োরিকো কোইকের তেমন বড় কোনো ফারাক নেই এবং নিজের নতুন দলকে নিজেই তিনি সংস্কারবাদী রক্ষণশীল দল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে কথা হচ্ছে, জাপানের জনগণ শিনজো আবের গত পাঁচ বছরের নেতৃত্বে বড় কোনো পরিবর্তন না দেখতে পেয়ে মোটামুটি হতাশ। ফলে তেমন কোনো বলিষ্ঠ বিকল্পের দেখা তাঁরা পেলে সেদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বলা যায় উন্মুখ হয়ে আছেন। হাওয়া যেন এখন তাই ‘আশা’র দিকেই বইতে শুরু করেছে। এর বাইরে আবার প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বের নেওয়া কিছু বালখিল্য পদক্ষেপ নতুন দলের সামনে দেখা দেওয়া সুযোগকে করে দিয়েছে আরও বেশি অর্জনযোগ্য।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে গণতান্ত্রিক দলের নেতৃত্ব দলের বিলুপ্তি ঘোষণা করে দেয়। সেই সিদ্ধান্ত উদার গণতন্ত্রীদের আরও বেশি উৎফুল্ল করে তোলার কথা ছিল। তবে গণতন্ত্রীরা একই সঙ্গে দলবদ্ধভাবে টোকিওর গভর্নরের নতুন দলে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় হঠাৎ করেই আবের শিবিরে এখন তা আতঙ্ক জাগিয়ে তুলছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী যে আশা নিয়ে আগাম নির্বাচনের পথে পা বাড়িয়েছিলেন, ‘আশা’র আবির্ভাব তাঁর সেই আশাকে এখন দুরাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

তবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এখন থেকে আরও তিন সপ্তাহ পর। জাপানের কঠোর নির্বাচনী আইনের আওতায় প্রচারাভিযান শুরু হবে ১০ অক্টোবর এবং ১০ দিনের প্রচারাভিযান শেষ হওয়ার পর ২২ অক্টোবর ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়ের মধ্যে দেশের রাজনীতির পরিমণ্ডলের আরও অনেক কিছু ঘটে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। গণতন্ত্রী দলের ভেতরেও দলের বিলুপ্তি ঘোষণা নিয়ে অসন্তোষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অন্যদিকে নতুন কোনো আশার বাণী ‘আশা’ নামের রাজনৈতিক দলটি ভোটারদের শোনাবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। ফলে ভোটের ফলাফল ঠিক কোন দিকে যেতে পারে, তা নিয়ে অনেকেই এখনো পর্যন্ত অনিশ্চিত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে অনেকেই অবশ্য মনে করছেন, উদার গণতন্ত্রীরা ক্ষমতা ধরে রাখতে হয়তো সক্ষম হবেন, তবে সংসদে যে ব্যাপক আধিপত্য দলের ছিল, তা হয়তো সংকুচিত হয়ে আসবে। অর্থাৎ, যে স্বপ্ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আবে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন ডেকেছিলেন, তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়। সে রকম অবস্থায় যা প্রত্যাশা করা যায়, তা হলো নেতৃত্বের রদবদল। নতুন কোনো নেতা হয়তো উদার গণতন্ত্রী দলের হাল ধরবেন এবং নবগঠিত দল ‘আশা’ সম্ভবত প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।

এর একটি আশঙ্কাজনক দিক অবশ্যই রয়েছে; কেননা, সে রকম অবস্থায় জাপানে পরাজিত হবে রাজনীতির উদার ধারা। উদার গণতন্ত্রী দলের নামের আগে ‘উদার’ শব্দটি যুক্ত থাকলেও দলটি হচ্ছে আপাদমস্তক একটি রক্ষণশীল দল। অন্যদিকে ‘আশা’ তো ঘোষণা করেই বসে আছে নিজের রক্ষণশীল অবস্থানের কথা। ফলে অর্থনীতির দিক থেকে কঠিন অবস্থা পার করতে হওয়া দেশটির সামনে দেখা দেওয়া জনসংখ্যা হ্রাস থেকে শুরু করে ফুলেফেঁপে ওঠা ঋণের বোঝার মতো সমস্যা সামাল দিতে বিকল্প নানা রকম চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটানোর সম্ভাবনা সম্ভবত হয়ে আসবে আরও অনেক বেশি সংকুচিত। সেদিক থেকে জাপানের রাজনীতিতে বয়ে যাওয়া এই ঝোড়ো হাওয়া এবং এর পেছনের বাস্তবতা সত্যিকার অর্থে সংকট কাটিয়ে মেঘমুক্ত আকাশের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনাকে অনেকটাই ম্লান করে দিচ্ছে।

মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক