পাঠকের মাঝেই সব শক্তি

ঢাকার পূর্ব বাসাবোয় কদমতলা স্কুল অ্যান্ড কলেজে শনিবার প্রথম আলো পাঠক সমাবেশে বক্তব্য দেন শিক্ষক শিরিন আক্তার। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকার পূর্ব বাসাবোয় কদমতলা স্কুল অ্যান্ড কলেজে শনিবার প্রথম আলো পাঠক সমাবেশে বক্তব্য দেন শিক্ষক শিরিন আক্তার। ছবি: প্রথম আলো

‘আপনার কথা শুনবে প্রথম আলো’ শীর্ষক এক পাঠক সমাবেশে গিয়েছিলাম ৭ অক্টোবর শনিবার। রাজধানীর কদমতলা পূর্ব বাসাবোর স্কুল অ্যান্ড কলেজে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রথম আলোর পাঠকদের মুখোমুখি থেকে তাদের চাহিদা, সমস্যা ও অনুভূতির কথা সরাসরি জানতে এই অনুষ্ঠান। চা খেতে খেতে আন্তরিকভাবে গল্প বা মতবিনিময়।

প্রথম আলো নিয়ে পাঠকদের ভাবনা কী, এই পত্রিকাটির কাছে পাঠকের প্রত্যাশা কী, পাঠকদের কাছ থেকে এসব কথা সরাসরি জানতে সম্পাদক মতিউর রহমান নিজেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রথম আলো ডিজিটাল বিভাগের একজন কর্মী হিসেবে আমিও সেখানে যাই। পাঠকদের বক্তব্য শুনি।

সমাবেশে পাঠকদের জন্য রাখা চেয়ার সব ভরে গিয়েছিল। দেখে ভালো লাগল যে পাঠকেরা সবাই শিক্ষিত, মার্জিত। পাঠকদের মধ্যে এলাকার রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্যান্য পেশার মানুষও ছিলেন। ছিলেন নানা বয়সী শিক্ষার্থী।

বেশ কয়েকজন পাঠক একে একে বক্তব্য দিলেন। একেকজন একেক বিষয়ে মত দিলেন। কেউ বললেন এলাকার রাস্তা বিষয়ক সমস্যার কথা, কেউ বললেন বেতন-ভাতা নিয়ে জটিলতার কথা, কেউ কেউ বললেন প্রথম আলোর বিষয়ভিত্তিক ভালো লাগা না-লাগা নিয়ে।

মুগ্ধ হয়ে লক্ষ করলাম, প্রত্যেকেই খুব ভালো বক্তা। পাঠককে বলতে দিলে তাঁরা যে সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিজ নিজ কথা বলতে পারেন, তা দেখিয়ে দিলেন কদমতলা পূর্ব বাসাবোর প্রথম আলোর পাঠকেরা। তাঁদের রুচিবোধ, দেশের সংস্কৃতি লালনের অদম্য স্পৃহা অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে। একজন পাঠক ভাই দেয়ালপত্রিকা প্রকাশ করেন। এই প্রচেষ্টা ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যেতে তাঁর যে ব্যাকুলতা, তা সত্যিই ‘শাবাশ’ পাওয়ার দাবিদার। কৈশোর-তারুণ্যে বাষ্পীভূত আবেগ নিয়ে লেখা সাহিত্য বিকাশের এক বলিষ্ঠ মাধ্যম দেয়ালপত্রিকা, যা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।

অনুষ্ঠানে আরেকটি বিষয় ভালো লেগেছে। তা হলো অল্পবয়সী দুটি বোন প্রথম আলো নকশায় ‘যে কথা যায় না বলা’ নিয়মিতভাবে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। এখানে যে জিনিসটি মূর্ত, তা হচ্ছে তারা কিছু বলতে চায়। এমন অনেক কিশোরী-তরুণী আছে, যাদের মনে কিছু কথা প্রকাশ হতে মাথা কুটে মরছে, কিন্তু কাউকে তারা বলতে পারছে না। তারা একটি পত্রিকাকে এমন কথা বলার মাধ্যম হিসেবে ভাবছে। তার মানে একটি পত্রিকা তাদের কাছে কত বড় আস্থার জায়গা! সমস্যা বা বিড়ম্বনার কথা সেখানে জানাতে ও প্রকাশ হতে চায়। সমস্যা সম্পর্কে না জানলে, বিড়ম্বনার ধরন না বুঝলে এর সমাধান হবে কী করে? সে ক্ষেত্রে পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যম অবশ্যই আস্থার বিশাল জায়গা।

পাঠকদের এই আস্থা অমূলক নয়। পাঠক যখন অসহায়, সবচেয়ে কাছের মানুষটিও পাশে নেই, তখন ভরসা ও নির্ভরতার একটি জোরালো স্থান হতে পারে ভালো মানের নিরপেক্ষ পত্রিকা। লোকচক্ষুর আড়ালে যে ভয়ানক কোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে, অনৈতিক কাণ্ড ঘটতে থাকে, তা কিন্তু সংবাদমাধ্যম বা পত্রিকাই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সবার সামনে তুলে আনে। এ জন্য কত রক্তচক্ষুর তির হজম করতে হয়, অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার মতো সংকট উতরাতে হয়, তা অনেকেই জানে না।

পাঠকদের পরম আস্থা ও নির্ভরতার জায়গা যেমন হতে পারে পত্রিকা, তেমনি পাঠকদের চাহিদা আর প্রত্যাশার ওপর নির্ভর করে পত্রিকার ভবিষ্যৎ।

সত্তর ও আশির দশকে এ দেশে সাপ্তাহিক আর পাক্ষিক পত্রিকা বা সাময়িকীগুলো কী দোর্দণ্ড প্রতাপই না ছিল! ‘বিচিত্রা’, ‘রোববার’, ‘সাপ্তাহিক ২০০০’, ‘সচিত্র সন্ধানী’, ‘পূর্বাণী’, ‘চিত্রালী’, ‘আনন্দ বিচিত্রা’, ‘তারকালোক’, ‘আনন্দভুবন’—এসব সাময়িকী এর উজ্জ্বল উদাহরণ। এসব সাময়িকীর কোনোটা ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনানির্ভর, কোনোটা-বা ছিল পুরোপুরি বিনোদননির্ভর। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে যখন দৈনিক পত্রিকাগুলোয় এসব বিষয় আসতে শুরু করে, তখন পাঠক সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্রিকাগুলো থেকে দৈনিক পত্রিকায় নজর ফেরাতে থাকে। পরে যখন ইন্টারনেট অবারিত হয়ে যায়, উল্লিখিত পত্রিকা ও সাময়িকীগুলোর ভরাডুবি ঘটে তখন। এসব পত্রিকা বেশির ভাগই এখন বিলুপ্ত। এর মূল কারণ হচ্ছে পাঠকের মুখ ফেরানো। পাঠক যখন দৈনিক পত্রিকায় চাহিদার রসদ খুঁজে পেয়েছেন, তখন সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক পত্রিকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। রাজনীতি, সামাজিক জীবন, জীবনযাপন, খেলা আর বিনোদনের নিত্যনতুন আকর্ষণীয় জিনিস যেখানে একটি দৈনিকে রোজই পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে একটি সাময়িকীর জন্য সাত দিন বা পনেরো দিন অপেক্ষা করার দরকারটা কী? কাজেই পত্রিকা টিকে থাকার ক্ষেত্রে পাঠকের চাহিদা ও প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতি রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাঠকই পত্রিকার প্রাণভ্রমর।

পাঠক মুখ ফেরালে পত্রিকা টিকবে না—এ কথা যেমন সত্য, তেমনি পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার বেলায়ও একটি ভালো মানের পত্রিকার জোরালো ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে দৈনিক পত্রিকার। কোনো বাড়িতে একটি পত্রিকা এলে তা পরিবারের সদস্যদের হাতে হাতে ঘোরে। দেখা যায়, বাড়ির কর্তা রাজনৈতিক খবরের প্রতি বেশি আগ্রহী হলে কর্ত্রী সামাজিক খবরই বেশি পড়েন। তরুণ সদস্যদের আগ্রহ দেখা যায় তথ্যপ্রযুক্তি, খেলা, বিনোদনের দিকে। পাঠাভ্যাসের চর্চা মানুষের জ্ঞানপিপাসা বাড়ায়। পাঠক তখন আরও বেশি পড়ার দিকে ঝোঁকে। কাজেই পারিবারিক জীবনে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলায়ও ভূমিকা রাখে সংবাদপত্র ও পত্রিকা। পত্রিকা ও পাঠকের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা দুনিয়াজুড়েই। পাঠক বিমুখ হলে যেমন পত্রিকা টিকবে না, তেমনি পত্রিকা না থাকলে পাঠকের পথের দিশারি আর নিরাপদ আস্থায় জায়গা বলেও কিছু থাকবে না। পাঠক আর পত্রিকার এই মেলবন্ধন অনন্তকাল অটুট থাকবে, এটাই আমাদের কাম্য।

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]