পুরুষতন্ত্র ও মর্যাদাহীনতার রাজযোটক?

‘মানুষ আসতিয়াছে নাফ নদীর বানের লাহান।’ যখন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ভয়াবহতা এ দেশের সব মানুষের সার্বক্ষণিক মাথাব্যথার কারণ, তখনো ধর্ষণের খবর। মানুষের এত দুর্ভাবনার মধ্যেও কুপ্রবৃত্তি থেমে নেই। কারণ, দুর্বৃত্তরা জানে, ধর্ষণ কোনো শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। ধর্ষণ আবার কবে থেকে অপরাধ হয়ে উঠল? ওরা তো হামেশাই এসব কৃতিত্ব প্রদর্শন করে থাকে। দুর্বৃত্ত পুরুষের অবদমিত কামস্পৃহার স্ফুরণ ঘটাতে তো হবে। এ জন্য হাতের কাছে পাওয়া যেকোনো বয়সের নারীই শিকার করা যেতে পারে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৮০টি। পরের তিন মাসের পরিসংখ্যান জানা নেই। ৩০০ পার হয়ে গেছে ধারণা করা যায়। সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমে বা ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক আলাপচারিতায় ধর্ষণ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বিষয়টি ইদানীং নানাভাবে উঠে আসছে। পারিবারিকভাবে সন্তানদের সঙ্গে আচরণে, পাঠ্যসূচিতে, প্রতিষ্ঠানে, নীতিনির্ধারণীতে, আইনে, দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এনে ধর্ষণ মানসিকতা নিরসন করার প্রচেষ্টার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ধর্ষণের কারণের মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার ব্যবহার। লিখিত-অলিখিতভাবে যুদ্ধবিগ্রহে প্রতিপক্ষের নারী ধর্ষণ বৈধ বিবেচনা করা হয়। নারীরা পরিবার ও তাঁর জাতিগোষ্ঠীর সম্মান বাঁচাতে আক্রমণের আগে নিজেরাই আত্মাহুতি দিয়েছেন বা আত্মীয় পুরুষ কর্তৃক তাঁদের হত্যা করা হয়েছে, এমন ঘটনাও ইতিহাসে বিধৃত। এক আলোচনায় একজন বক্তা বলছিলেন, একটা ধর্ষণ একজন নারীর সারা জীবনের কান্না। কারণ, আত্মীয়-অনাত্মীয়, পুলিশ, আদালত, চিকিৎসক, জেরাকারী, এমনকি স্বপ্নের মধ্যেও ওই নির্যাতিত নারী বারবার ধর্ষিত হন। বিচারের দিল্লিও দূর অস্ত। কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। ধর্ষকের বিচার হতে পারে কিন্তু ধর্ষণের শিকার মেয়েটি চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠার পর কেন সারা জীবন কাঁদবেন? কারণ, সমাজ তাঁকে অশুচি বলে দূরে সরিয়ে রাখে এবং সমাজের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতাই তাঁকে সারা জীবন কাঁদায়। একজন অপারগ বা অনিচ্ছুক মেয়ে তাঁর স্বামী কর্তৃক জোরপূর্বক ধর্ষিত হওয়ার পর কিন্তু সারা জীবন কাঁদেন না।

পুরুষের ভেতর কেন রিপুর এ তাড়না? অনেকে পুরুষদের ও নারীদেহের পৃথক চরিত্র এবং চাহিদার কথা তুলে ধরেন। পুরুষ অস্থির, নারী স্থিতধী; পুরুষ বহির্মুখী, নারী অন্তর্মুখী; পুরুষ চায় সুখ, নারী চায় শান্তি—এসব বিজ্ঞানবিবর্জিত সুবিধালব্ধ যুক্তির অবতারণা করে পুরুষ যথেচ্ছাচার করে যেতে পারেন। কিন্তু সব পুরুষই তো আর প্রবৃত্তির দাস নন। অবশ্য আমাদের এক পুরুষ সহকর্মী বলতেন, ‘সুযোগের অভাবে আমরা সবাই সুশীল।’ একজন স্বনামধন্য টিভি উপস্থাপককে এক অনুষ্ঠানে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, বিশ্বসুন্দরী আপনাকে প্রেমের প্রস্তাব দিলে আপনি কি সাড়া দেবেন? তিনি স্ত্রীর ছবির দিকে আঙুল তুলে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘ইচ্ছে তো ষোলো আনা, কিন্তু সাহস নেই।’ সামাজিক নিয়ম, প্রথা, নিষেধ আছে বলেই না আমরা ইচ্ছা হলেও জনসমক্ষে নিরাবরণ চলি না বা প্রাকৃতিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন করি না।

কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির ভয়াবহতা রোধে রীতিমতো নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ পুরুষেরা তাঁদের অধস্তন নারী সহকর্মীদের যৌন হয়রানি করে থাকেন। চাকরি হারানোর ভয়ে অনেক নারী মুখ খোলেন না। এখানেও সেই ক্ষমতার ব্যবহার। একে পুরুষ তাঁর ওপরে উচ্চপদস্থ। কেউ তাঁর সামনে যথাযথ আদব প্রদর্শন না করলে তাঁর মর্যাদাহানি হয় কিন্তু যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের খবর চাউর হলে তাঁর মর্যাদা কোথায় থাকে? ধরা পড়লে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে বা শেষ অস্ত্র ওই নারীর চালচলন ভালো ছিল না বলে অনেক সময় পার পেয়ে যান। কর্মক্ষেত্রে বা গৃহে যৌন হয়রানির অভিযোগ থেকে রেহাই পাওয়া বীরদের অনেককেই বুক ফুলিয়ে চলতে দেখা যায়। কারণ, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যা—এসব তো পৌরুষের অলংকার। এ তো তাঁর মর্যাদারই অংশ। আমরা খোলা চোখে যাকে মর্যাদাহীনতা বলি, পুরুষ যদি তাকে গৌরব ভেবে থাকে, তাহলে তো রাজযোটক। তা না হলে বনানীর দুই ছাত্রীর ধর্ষক ও তাদের সুযোগ্য পিতৃকুল ধর্ষণ যে কোনো অপরাধ, তা জেনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যেতেন না।

এদিকে আত্মমর্যাদাবোধ রক্ষায় পুরুষের তুলনায় নারী এগিয়ে আছেন। নারী সচরাচর বিপরীত লিঙ্গের মানুষ পছন্দের ক্ষেত্রে বয়স, শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদায় সমতা বা আরও উচ্চতা প্রাধান্য দেন। আত্মীয়স্বজনের ভালোবাসা ও সংশ্লিষ্টতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভেবে হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু পুরুষ প্রাধান্য দেন তাঁর প্রবৃত্তিকে, যেখানে তাঁর মর্যাদাবোধের অবস্থান একেবারে নিচের সারিতে। পুরুষতন্ত্র নারীর মধ্যে বিচরণ করলেও তা আরোপিত কিন্তু পুরুষের যেন তা জন্মগত অধিকার। ক্ষমতার দাম্ভিকতায় অন্ধ পুরুষ আত্মমর্যাদার তোয়াক্কা করেন না। তাই নিজের ঘরে, কর্মক্ষেত্রে বা রাস্তাঘাটে অনায়াসে যৌন হয়রানি করতে বাধে না।

এ বছরই নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় গৃহপরিচারিকা ধর্ষণ ও হত্যার সংবাদ প্রকাশিত হয়। এক বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার আট বছর ধরে তাঁর সৎমেয়েকে ধর্ষণ করে আসছিলেন। পোশাকশিল্প কারখানায় নারী শ্রমিক ধর্ষণ তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। গত মাসে আশুলিয়ার উন্বেষা পোশাক কারখানার এক কর্মকর্তাকে একাধিক নারী শ্রমিককে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ তাঁদের সবারই পরিবার-পরিজন আছে। আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ড. ড্যানিয়েল গ্রেগরি এসব মর্যাদাহীন পুরুষদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাকে ভাবতে হবে আপনি শুধু জৈবিক উদ্দেশ্য পূরণ করার প্রাণী নন, মস্তিষ্কে হরমোনের প্রভাবে যে প্রতিক্রিয়া হয়, তা অনুসরণ করা উচিত নয়। আপনি তখন নিজেকে প্রশ্ন করবেন, আমার যে সম্পর্কগুলো রয়েছে, তার লক্ষ্য কী? আপনার জীবনে যেসব মানুষ রয়েছেন, তাঁদের ভালোবাসুন এবং তাঁদের নিরাপত্তা প্রদান করুন। শেষ পর্যন্ত এটাই আপনার কাজে লাগবে।’

উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।