দৃশ্যমান শিকড় অদৃশ্য শিকড়

রোডমার্চ, মানববন্ধন, সমাবেশ বা যৌথ বাহিনীর অভিযান—এসব সময়োচিত, প্রয়োজনীয় ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ, তবে সুদূরপ্রসারী নয়। আগাছার মাথা বারবার কাটলেও নতুন মাথা গজায়। শিকড়-বাকড় উপড়ে ফেলতে না পারলে রাবণের মাথার মতো সে মাথা আবার গজাবে। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস নির্মূল করতে চাইলে তাই আগাপাছতলা ভাবা দরকার। সাময়িক ব্যবস্থার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাটাও জরুরি। না হলে সহসাই বালির বাঁধ ভেঙে ভুক্তভোগীদের চোখের জল মাতৃভূমিকে আবার সিক্ত করবে।
সাম্প্রতিক নতুন মাত্রার সাম্প্রদায়িক হামলা মোকাবিলায় খুব জোরের সঙ্গে যে দুটি দাবি মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে তা হলো: এক. দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে অপরাধীদের বিচার করতে হবে। দুই. ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এ ধরনের ঘটনায় বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি দেশে গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে এসে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা গেলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে বলে অনেকে মনে করছেন। একইভাবে একাত্তর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত চিহ্নিত ও আত্মস্বীকৃত অপরাধী সংগঠন জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা গেলে সাম্প্রদায়িকতার মূলোৎপাটন করা যাবে বলেও ভাবছেন কেউ কেউ। এমন ভাবনা অমূলক নয়, তাই দাবি দুটির বাস্তবায়ন জরুরি।
তবে সাম্প্রদায়িকতার শিকড় এই পর্যন্তই—এমন ধারণা ঠিক নয়, এর শিকড় মাটির আরও গভীরে। এ হলো বটগাছের শিকড়ের মতো—খানিকটা বাইরে, খানিকটা ভেতরে। ওই দুটি দাবি বাস্তবায়িত হলে ওপরের দৃশ্যমান শিকড় কাটা পড়বে, কিন্তু এর আসল অংশ থেকে যাবে মাটির অনেক নিচে। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তিরই বহিঃপ্রকাশ। আইন প্রয়োগ করে সাময়িকভাবে সন্ত্রাস দূর করা যেতে পারে, সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি দূর করা সম্ভব নয়। আর সমাজে সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির মূল থেকে গেলে তা আবার বাড়তে বাড়তে মহিরুহে রূপ নেবে। আসলে আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা ও রাজনীতির খাঁজে খাঁজে প্রায় স্থায়ীভাবে গেঁথে যাওয়া নানামুখী স্খলনের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা এমনভাবে মিলেমিশে আছে, একে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে চেঁছেখুঁড়ে পরিষ্কার করা খুবই কঠিন কাজ।
মানবসমাজে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতি, ভাষা ও অঞ্চলের পার্থক্য তথা সাংস্কৃতিক পার্থক্য স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচিত। এই বৈচিত্র্য মানবসভ্যতার সৌন্দর্যও বটে। নিজ নিজ ভাষা, ধর্ম, জাতির ব্যাপারে মানুষের অতি অহংবোধ ও অতি ভাবাবেগ কাজ করাটা অস্বাভাবিক নয়। এসব ধারণ করেই সভ্যতা এগিয়ে যায়। সভ্যতার অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয় তখনই, যখন মানুষের এই ধর্মীয়, জাতিগত বা অঞ্চলগত অহংবোধ ও ভাবাবেগকে উসকে দিয়ে মতলববাজেরা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। যেখানে ধর্মের ভিন্নতা নেই, সেখানে একই ধর্মের মধ্যে ব্রাহ্মণ-শূদ্র বা শিয়া-সুন্নি ইত্যাদি বিভেদক আবেগকে উসকে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে চলে ভাষা, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ ও অঞ্চলগত বিভেদকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা। স্বার্থসিদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত এ ধরনের সব বিভেদকারী মনোবৃত্তিই সাম্প্রদায়িকতা। আর এই স্বার্থ হতে পারে নির্বাচনে জেতার স্বার্থ, ক্ষমতায় যাওয়া বা পদ লাভের স্বার্থ, সম্পত্তি ও চাকরির স্বার্থ—এককথায় ভোগ-লোভের স্বার্থ।
বাংলাদেশে জাতি-ধর্ম-অঞ্চলবিভেদক ভাবাবেগকে ব্যবহার করে স্বার্থসিদ্ধির চর্চা নতুন নয়। এই চর্চা শুরু করা হয়েছে সমাজ ও রাজনীতির উঁচুতলা থেকে। দীর্ঘদিন এই চর্চা অব্যাহত থাকায় ধীরে ধীরে তা সমাজের নিচু স্তরকেও আচ্ছন্ন করেছে। ক্রমাগত অপচর্চার ফল হয়েছে এই যে সমাজ এখন এতে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এ ধরনের কাজ যে ন্যায়বত্তা পরিপন্থী, তা এখন সমাজ মনেই করে না।
‘ন্যায়’ শব্দের অর্থ অনেক বিস্তৃত। যুক্তি, নীতি, সুবিচার, সততা, যোগ্যতা, বিবেক, সাম্য—সবই ন্যায়ের মধ্যে পড়ে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে সব নাগরিকের জন্য এই ন্যায় বা ন্যায্যতা নিশ্চিত করা। প্রশ্ন হলো, আমাদের রাষ্ট্র সব নাগরিকের জন্য এই ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে পারছে কি না। ন্যায়ের কথা সংবিধানে লেখা থাকলেই হবে না, রাষ্ট্রকে তা কার্যকর করে দেখাতে হবে। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে সমাজে বিভেদক কর্মকাণ্ড টিকে থাকবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্র স্বয়ং বিভেদক নীতির পথ ধরে ন্যায়কে বিসর্জন দিতে পারে। আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তন এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। এই বিভেদক নীতি সমাজের মধ্যে অন্যান্য বিভেদকারী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে নৈতিকভাবে দাঁড়াতে দেয় না। ফলে বিভেদক নীতিটাই সমাজে ন্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়; সমাজের নিজস্ব ঔদার্য ও ঔচিত্য ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকে।
সমাজ কীভাবে তার ঔচিত্যবোধ হারিয়ে ফেলে, তার কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সম্প্রতি দেশে হিন্দুধর্মাবলম্বী অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। প্রতিবেশীরা বহু স্থানে আক্রান্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়িয়েছে নাগরিক সমাজও। আক্রান্ত মানুষের জন্য প্রতিবেশীর এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সমাজের স্বাভাবিক প্রবণতা। কিন্তু সমাজ যখন আক্রান্ত মানুষের কাছে এসে বলে, ‘আপনারা ভাববেন না, আমরা আপনাদের পাশে আছি,’ তখন সমাজ নিজের অজান্তেই ‘আপনারা’ ও ‘আমরা’—এমন বিভেদ সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রের চোখে সব নাগরিক সমান বিবেচিত হলে আপনারা ও আমরার অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। অথচ রাষ্ট্রধর্ম ‘আপনারা’ ও ‘আমরা’র বিভেদ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আক্রান্ত মানুষ যে এতে প্রতিবেশীর সহানুভূতিকে করুণা হিসেবে বিবেচনা করতে পারে, সমাজ হয়তো তা মাথায় রাখে না। সমাজের এতে দোষও নেই, দোষ রাষ্ট্রের বিভেদকারী নীতির।
এবার উঁচুতলার একটি উদাহরণ। কোনো সরকারপ্রধানের পাঁচজন উপদেষ্টা বা মন্ত্রী নিয়োগদানের প্রয়োজন হলো। তিনি কেবল নাগরিক বিবেচনায় নিজ দলের সবচেয়ে যোগ্য পাঁচজনকে নিয়োগ দিলেন। দেখা গেল, পাঁচজনই কথিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। বর্তমান সমাজবাস্তবতায় এমনটা সম্ভব কি? না, সম্ভব নয়। ন্যায্যতার বিপরীতে এমন অসম্ভবের চর্চা চলছে অন্যান্য ক্ষেত্রেও। এবং সমাজ তা মেনে নিয়েছে।
কেবল ধর্মের বিভেদ নয়, অঞ্চলের বিভেদ বা আঞ্চলিকতাকেও সমাজ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করছে। যখন যিনি ক্ষমতার কোনো পদে বসবেন, তখন তাঁর এলাকার মানুষের গুরুত্ব বাড়বে—এটাই যেন নিয়তি। কোনো অঞ্চলে মন্ত্রী চাই। শুরু হলো আন্দোলন। যোগ্য লোক না থাকলেও ভোটারদের তুষ্ট করতে ওই অঞ্চল থেকে দেওয়া হলো একজন মন্ত্রী। উন্নয়নকর্মের ক্ষেত্রেও এ দেশে ন্যায়ের চেয়ে অঞ্চলপ্রীতি প্রাধান্য পায়। আবার নির্বাচনে জয়লাভের বেলায়ও অঞ্চলপ্রীতি লক্ষণীয়। দুই থানায় দুই প্রার্থীর অবস্থান হলে যোগ্যতা ও দল বিবেচনার থেকে থানাপ্রীতি বেশি কাজ করে এবং যে থানায় ভোটারসংখ্যা বেশি, সেই থানার প্রার্থী জয়লাভ করে। সমাজ কিন্তু এ ধরনের বিভেদক আঞ্চলিকতাকে অন্যায় মনে করছে না।
এ সমাজে সাম্প্রদায়িক মতলব হাসিল করতে মানুষের দারিদ্র্যকেও ব্যবহার করার নজির কম নয়। দরিদ্র ব্যক্তিমাত্রই সাম্প্রদায়িক নয়। কিন্তু কিছু নগদ অর্থ বা লুটকৃত সম্পদের লোভে তারা অনেক সময় সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে বাধ্য হয়। দোষ এখানে দরিদ্র ব্যক্তি নয়, দোষ ধনবৈষম্যের।
যে সমাজে দুর্নীতি বেশি, সে সমাজে বিভেদক উপাদানের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। আমাদের সমাজের ওপরতলা, প্রশাসন, রাজনীতি, ব্যবসায়সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি বাড়তে বাড়তে আজ একটা স্বাভাবিক চেহারা নিয়ে ফেলেছে। এ সমাজে তাই দুর্নীতিকেই নীতি বলে ভ্রম হয়। এখানে ঘুষ চাওয়া যেমন স্বাভাবিক ব্যাপার, ঘুষ দেওয়াও তেমনই সাধারণ ঘটনা। দাতা ও গ্রহীতা কোনো পক্ষই একে অন্যায় বিবেচনা করে না। এখানে চক্ষুলজ্জারও বালাই নেই।
দুর্নীতির হাতে হাত রেখেই চলে অপরাধ, অন্যায় আর অবিচার। দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষেরা নিজেদের মধ্যে এক পৃথক বলয় তৈরি করে ফেলে। সমাজের সাধারণের থেকে একটা বিভেদরেখা টেনে দিয়ে তারা উঠে যায় ওপরে। আবার সমাজের অন্যান্য বিভেদক উপাদানগুলোর নিয়ন্ত্রণও থাকে তাদের হাতেই। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ে সামগ্রিক ব্যবস্থার দাস। ইচ্ছার বিরুদ্ধেও বিরাজমান ব্যবস্থার কারণে তারা সাম্প্রদায়িক উসকানির ক্রীড়নকে পরিণত হয়, মনে হয় গোটা সমাজটাই সাম্প্রদায়িক।
সাম্প্রদায়িকতা বা সমাজের বিভেদকারী উপাদানগুলোর শিকড় যখন অন্যায়, অবিচার, অপরাধ, দুর্নীতি আর অসত্যের শিকড়ের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তখন সে শিকড়কে খুঁজে বের করা এবং উপড়ে ফেলা এক দুঃসাধ্য কাজ হয়ে ওঠে। সুতরাং আমাদের সংস্কৃতি তথা রাজনীতি, সমাজনীতি, আর্থিক ব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে না ভাবলে সাম্প্রদায়িকতার মূলোৎপাটন করা যাবে না।
যত দুঃসাধ্যই হোক, কাজটা তো শুরু করতে হবে। নতুন প্রজন্মের জাগরণ এ ব্যাপারে আমাদের আশাবাদী করে তোলে। আমরা তাদের দিকেই তাকিয়ে থাকি।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও নাট্যকার।