যুক্তরাষ্ট্রের ইউনেসকো ত্যাগ

আমাদের গ্রামাঞ্চলে একসময় মোড়লেরা বিচার করতেন। কিন্তু এখন আর সেই সময় নেই, আধুনিক বিচারব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পর তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। আবার বৈশ্বিক রাজনীতিতেও মোড়লদের দেখা যায়। স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময় ধরে সারা বিশ্বে মোড়লেরা ছড়ি ঘুরিয়ে দাপট দেখিয়ে গেলেও তাঁদের আগের সেই দাপট এখন অনেকটাই ম্লান। তবে বিশ্বের কোনো কোনো মোড়ল অবশ্য তা মেনে নিতে নারাজ। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দেশটির আচরণে সেই প্রবণতা শুরু থেকেই লক্ষ করা যাচ্ছে, যার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হলো জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংগঠন ইউনেসকো থেকে দেশটির বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত।
ইসরায়েলের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে ইউনেসকো ত্যাগের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছে। মার্কিন প্রশাসন বলছে, ইসরায়েলবিরোধী পক্ষপাতমূলক অবস্থান থেকে ইউনেসকো সরে না এলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সংগঠনের পাওনা কয়েক হাজার কোটি ডলার ওয়াশিংটন পরিশোধ করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতে পারার ঠিক পরপর ইসরায়েলও ওয়াশিংটনের লেজ ধরে ইউনেসকো ছেড়ে চলে যায়।
ইসরায়েল অনেক দিন থেকেই ইউনেসকোর বেশ কিছু সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গোস্বার কথা জানিয়ে আসছিল। সেসব সিদ্ধান্তের অধিকাংশই ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার খর্ব হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। সে রকম কয়েকটি সিদ্ধান্তে আবার অধিকৃত ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনি জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সরাসরি ইসরায়েলের সমালোচনাও করা হয়েছে, যা ছিল সব দিক থেকেই যুক্তিসংগত। এ ছাড়া ইউনেসকোর ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিজের রাজনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী হওয়ায় সেটা নিয়েও ইসরায়েল সরকারকে শুরু থেকেই হা-হুতাশ করতে শোনা গেছে। যেমন ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে এককভাবে ইহুদিদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক থেকে যাওয়ার দাবি নাকচ করে দিয়ে ইউনেসকোর গৃহীত একটি প্রস্তাবকে ইসরায়েল দেশটির ইতিহাসের প্রতি ইউনেসকোর অবজ্ঞা প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছে। তবে কথা হচ্ছে, ইতিহাসের ব্যাখ্যা কখনো কারও নিজস্ব সংজ্ঞায় নির্ধারিত হয় না। ইসরায়েলের পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রকে তা মেনে নিতে হলে ইতিহাসকেই অস্বীকার করা হয়। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে প্রতিশ্রুত ভূমির ধারণার যে বর্ণনা আমরা পাই, সেটা তো ইহুদি ধর্মের অনুসারীদের একতরফা বয়ান, অন্যদের মনোভাবের প্রতিফলন সেখানে দেখা যায় না।
এ বছর জুলাই মাসে হেবরনকে ফিলিস্তিনের একটি বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত ইউনেসকোতে গৃহীত হওয়া ইসরায়েলের মনঃকষ্ট আরও অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। ইসরায়েলের কট্টর ইহুদিবাদীরা হেবরনকে নিজেদের শহর হিসেবে দাবি করলেও ইতিহাস ও সাম্প্রতিক বাস্তবতা কিন্তু অন্য কথা বলে। হেবরন হচ্ছে ইসরায়েলের দখলাধীন পশ্চিম তীরের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু শহর, যার জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ হচ্ছে ফিলিস্তিনি। সে রকম অবস্থায় হেবরনকে ইসরায়েলের শহর কিংবা ইহুদি শহর হিসেবে তালিকাভুক্ত করার উপায় নেই। ট্রাম্প প্রশাসন এখন সেই সিদ্ধান্তকেও ইউনেসকোর পক্ষপাতিত্বের দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে।
জাতিসংঘের এই সংগঠনকে ঘিরে ওয়াশিংটনের অসন্তোষ অবশ্য অনেক আগে থেকেই। এর আগে রিগ্যান প্রশাসনের অধীনে আরও একবার যুক্তরাষ্ট্র ইউনেসকো থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। সেবারও ওয়াশিংটনের অভিযোগ ছিল পক্ষপাতিত্বের, তবে ইসরায়েলবিরোধী অবস্থানের নয়। ১৯৮০-র দশকে ইউনেসকো নয়া বিশ্ব তথ্যব্যবস্থার ধারণা নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠলে তথ্যের কান্ডারি হিসেবে পরিচিত বিশ্বের সংবাদপ্রবাহের হাল ধরে বসে থাকা নেতৃস্থানীয় সংবাদমাধ্যম ইউনেসকো এবং সংগঠনের তৎকালীন মহাপরিচালকের পেছনে লেগে যায়। পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের সহায়তায় ইউনেসকোকে কোণঠাসা করে ফেলার তৎপরতায় লিপ্ত হয়। এরই ফল হিসেবে রিগ্যান প্রশাসন ইউনেসকো ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বেশ কয়েক বছরের বিরতিতে যুক্তরাষ্ট্র আবারও ইউনেসকোতে ফিরে গেলেও সংগঠনটির প্রতি দেশটির উষ্মা কোনো অবস্থাতেই কমেনি। এর কারণ অবশ্যই হচ্ছে ইউনেসকোর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের একঘরে হয়ে পড়া। পরবর্তী সময়ে বারাক ওবামার নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত ‘উদার’ যুগেও দেখা গেছে, ইউনেসকোকে তারা চাঁদা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। উল্লেখ্য, ২০১১ সাল থেকে ওয়াশিংটন ইউনেসকোতে চাঁদা পরিশোধ স্থগিত রেখেছে। ইউনেসকো সে বছর ফিলিস্তিনকে সংগঠনের সদস্যপদ দেওয়ায় ‘মানবতা ও ক্ষুদ্রঋণের বন্ধু’ বারাক ওবামা চাঁদা পুরোপুরি বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এর আগে থেকেই ইউনেসকোকে দেওয়া তহবিল অনেকটাই সংকুচিত করে এনেছিল।
ফলে দেখা যায়, ইউনেসকোর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের গোড়ায় আছে সংগঠনটিকে নিজের মতো করে পরিচালনা করতে না পারার কারণে সৃষ্ট অসন্তোষ। ওয়াশিংটন হয়তো চাইছে, ইউনেসকোতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মতো একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে, বিশ্বের মোড়লেরা যেখানে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো এটাকে চালিত করতে সক্ষম হবে। ট্রাম্প প্রশাসনের গোস্বার পেছনে সে রকম হিসাব থাকলেও এর বাইরে আরও কিছু চিন্তাভাবনা নিশ্চয় আছে।
২০১১ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইউনেসকোর কোনো রকম চাঁদা পরিশোধ করেনি। ফলে সংস্থায় ওয়াশিংটনের বকেয়ার পরিমাণ এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ কোটি ডলার। ট্রাম্প হয়তো ভাবছেন, প্রভাব না খাটাতে পারা একটি সংস্থায় এই পরিমাণ অর্থ দেওয়া হলে এর পুরোটাই গচ্চা যাবে। ব্যবসায়ী বলে কথা! শানশওকতের জীবন নিজে কাটালেও টাকাপয়সার বেলায় হিসাবি মানুষ তিনি। ফলে অযথা অর্থ ব্যয় তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। টাকাপয়সা বাকি পড়ায় সংগঠন থেকে বের হয়ে যাওয়া অন্যদের চোখে ভালো দেখা যাবে না বলেই হয়তো ভিন্ন অজুহাত তাঁর খুঁজে দেখা। নিজের ঘরের ইহুদি জামাতা জেরার্ড কুশনার হয়তো ট্রাম্পকে ইহুদি ঝান্ডা তুলে ধরার মতো বুদ্ধি দিয়ে থাকবেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনেসকো ত্যাগে সন্তোষ প্রকাশের সুযোগ নেই। কেননা, সংস্থাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর এই দেশের প্রয়োজন আছে। সংগঠনের ভেতরে থেকে বর্তমান বিশ্বের নেতৃত্বে থাকা দেশটি অবশ্যই আরও বেশি গঠনমূলক অবদান রাখতে সক্ষম। মার্কিন সিদ্ধান্তে দুঃখ প্রকাশ করে ইউনেসকোর বিদায়ী মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা তাই বলেছেন, ‘সংঘাত যখন বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সমাজে তোলপাড় তুলছে, সে রকম এক সময়ে শান্তির শিক্ষা ও সংস্কৃতি রক্ষার ধারণা এগিয়ে নেওয়ায় কাজ করে যাওয়া জাতিসংঘের এই সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে যাওয়া খুবই দুঃখজনক।’
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।