রক্ষণাবেক্ষণের চেয়ে প্রকল্পে আগ্রহ বেশি

জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। ঢাকার জলাবদ্ধতার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন ইফতেখার মাহমুদ
প্রথম আলো:
আপনি তো ড্যাপ পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। সাত বছরেও এর বাস্তবায়ন শুরু হলো না কেন?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: ড্যাপ দুইবার পর্যালোচনা হয়েছে। ২০১০-এর ২৩ জুন এটি অনুমোদন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। তিন দিন পরে আরেকটি কমিটির গেজেট প্রকাশ করা হয়, আবার পর্যালোচনার জন্য। ওই কমিটিতে সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রীকে রাখা হয়। তখনই আমাদের মনে খটকা লাগে। পরে বুঝলাম, বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী আবাসন কোম্পানি ড্যাপের কারণে ক্ষুব্ধ। আমরা সবার মতামতকে যুক্ত করতে ড্যাপ এলাকার সাংসদদের সঙ্গে বৈঠক করলাম। ২০১০ সালেই ড্যাপের চার পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছে আমাদের সব মতামত ও পর্যালোচনা তুলে দিলাম। এরপর আমি আর এর সঙ্গে যুক্ত নই।

প্রথম আলো: আপনাদের করা ড্যাপে জলাবদ্ধতা দূর করার বিষয়টিকে কীভাবে দেখা হয়েছিল?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: ড্যাপে আমরা পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে দুই ধরনের এলাকা চিহ্নিত করে তা সংরক্ষণের প্রস্তাব করেছিলাম। একটি হচ্ছে বন্যাপ্রবাহ এলাকা বা ফ্লাড ফ্রি জোন ও আরেকটি সাব ফ্ল্যাপ ফ্রি জোন। আমরা বন্যাপ্রবাহ এলাকাকে পুরোপুরি সংরক্ষণের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। অর্থাৎ সেখানে কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না। আর সাব ফ্ল্যাপ ফ্রি জোনে ভবন নির্মাণ করা যাবে, তবে এর নিচের অংশ পানি চলাচলের সুবিধার জন্য ফাঁকা রাখতে হবে। এ ছাড়া বেশ কিছু এলাকাকে আমরা পানি সংরক্ষণ এলাকা বা ওয়াটার রিটেইন পন্ড এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করতে বলেছিলাম।

প্রথম আলো: সেগুলো কি সংরক্ষণ করা হয়েছে? বিশেষ করে বিচ্ছিন্ন পানি সংরক্ষণ এলাকাগুলো?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমরা যখন এসব এলাকা চিহ্নিত করার কাজ করছিলাম, তখন দেখলাম বেশ কিছু বড় আবাসন কোম্পানি নানাভাবে বন্যাপ্রবাহ এলাকাগুলোর দাগ ও খতিয়ান নম্বর জেনে যায়। দ্রুত তারা সেসব পানি সংরক্ষক এলাকা ও বন্যাপ্রবাহ এলাকা ভরাট করে ফেলে। আমরা পরে একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছিলাম মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তারা সেগুলো ভরাট করে অনেক উঁচু করে ফেলেছে।

 প্রথম আলো: জলাভূমি ও বন্যাপ্রবাহ এলাকাগুলো যখন ভরাট হচ্ছিল, তখন তা থামানোর কোনো উপায় কি ছিল না? সরকারি সংস্থাগুলো তখন কী করছিল? আইনগুলো কেন প্রয়োগ হলো না?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: হ্যাঁ, থামানো সম্ভব ছিল। এই দায়িত্ব ছিল রাজউকের। কিন্তু তারা তা করেনি। বরং তারা নিজেরাও বন্যাপ্রবাহ এলাকা ভরাট করে ঝিলমিল-২ আবাসিক এলাকা নির্মাণ করছে। সরকারি এই প্রকল্পটিসহ বেশ কিছু বেসরকারি আবাসিক প্রকল্প অনুমোদন না করার জন্য বলেছিলাম আমরা। কিন্তু পরে আমরা দেখেছি, সেগুলোর সবই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কী বৈপরীত্য! রাজউক নিজেই ডেভেলপার (ভূমি উন্নয়নকারী) ও নিজেই পরিকল্পনা এবং নিজেই অনুমোদনকারী। তারাই ড্যাপ মানছে না। ফলে বেসরকারি ভূমি উন্নয়নকারী কোম্পানিগুলোকে আর সে আটকাতে পারছে না। তারা জলাভূমি, বন্যাপ্রবাহ এলাকা ভরাট করলে বাধা দেওয়ার নৈতিক অধিকার রাজউক হারিয়ে ফেলেছে। তবুও তারা আপত্তি তোলে, আবার অনুমোদনও দেয়।

বেসরকারিকোম্পানিগুলো বলার চেষ্টা করে তাদের কারণে তো জলাবদ্ধতা সামান্য বাড়বে। কিন্তু সব একসঙ্গে দেখলে তো বিরাট প্রভাব। প্রশ্ন হচ্ছে, সবগুলো আবাসন প্রকল্পের সম্মিলিত প্রভাবে কী পরিমাণে জলাবদ্ধতা বাড়ছে তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব কেউ দিচ্ছে না। এটা বোঝার জন্যই তো ড্যাপ করা হয়েছিল। তারা সেটা মানতে রাজি নয়।

প্রথম আলো: ড্যাপের বিষয়ে তাদের আপত্তির জায়গা কোনটি?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: ড্যাপে জমির শ্রেণীকরণ করার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। কিন্তু এটাকে কোনো কোনো মহল এমনভাবে প্রচার করেছিল যে ড্যাপে অনেক সমস্যা। এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এসব কথা একদম ঠিক না। গুটিকয়েক কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থে এই অপপ্রচার চালানো হয়েছিল।

প্রথম আলো: তাহলে এখন জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য কী করার আছে? খাল ও পানি সংরক্ষণ এলাকা রক্ষা করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: তা আমি মনে করি না। যে নালা দিয়ে পানি খাল ও সংরক্ষণ এলাকায় যাবে, সেটাই তো ঠিকমতো কাজ করছে না। সেখানে ময়লা জমে এমনভাবে শক্ত হয়ে গেছে যে সেখান দিয়ে আর পানি প্রবেশ করছে না। ফলে সব পানি সড়কে গিয়ে জমছে। নিষ্কাশন নালাগুলো পরিষ্কার করতে হবে।

প্রথম আলো: শহর ডুবে যাচ্ছে। আর আলোচনা চলছে নিষ্কাশন নালা কে পরিষ্কার করবে, খালের মালিক কে, পরিষ্কার করবে কে—এই সব।

জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমি এ বিষয়ে কারও কোনো সদিচ্ছা দেখতে পাচ্ছি না। এই সমস্যা নিয়ে দেশের গণমাধ্যমে অনেক রিপোর্ট হয়েছে। আমরা বুয়েট অ্যালামনাই থেকে প্রথম আলোর সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক করেছি। তা এক পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হয়েছে। নাগরিক সমাজ আন্দোলন করেছে। কিন্তু এগুলোর কোনো কিছু কাজে আসছে না।

প্রথম আলো: কেন কাজে আসছে না বলে মনে করেন?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: সবার ওপরে রাজনৈতিক সদিচ্ছা; এটি না থাকলে কোনো কিছুই হবে না। যাঁরা জলাবদ্ধতা দূর করার ব্যাপারে নীতি নির্ধারণ করেন, তাঁদের এই সমস্যার সমাধানে সদিচ্ছার অভাব আছে।

 প্রথম আলো: আপনি কি সরকারের কথা বলছেন? না দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কথা বলছেন?

 জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমি সরকার বলতে সরকারের সব পর্যায়ের সবগুলো প্রতিষ্ঠানের কথা বলছি, সব মিলিয়েই তো সরকার। আমি বাপার সভাপতি থাকার সময় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সামনেই এ কথা বলেছিলাম। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেছিলাম, আপনার আশপাশের লোকেরাই নদী দখল করছে। অর্থাৎ প্রতিটি এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সাংসদ-মন্ত্রী এঁরাই নদী দখলের সঙ্গে জড়িত। তাহলে কীভাবে এগুলো রক্ষা পাবে। এক দল ক্ষমতায় থেকে যা দখল করে, অন্য দল গেলে তার চেয়ে বেশি করে। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, ঢাকার জলাভূমি রক্ষা ও জলাবদ্ধতা দূর করতে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান দরকার। যারা বাইরের কোনো শক্তির কাছে নতি স্বীকার করবে না। যে সমস্যাটা তাদের দেওয়া হলো তার সমাধান তারা করবে। এর জন্য যা করা দরকার তা-ই তারা করবে।

প্রথম আলো: এমন প্রতিষ্ঠান কোনটি হতে পারে?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: অনেক সময় এ ধরনের কাজে সরকার সেনাবাহিনীকে যুক্ত করে থাকে। হাতিরঝিলে ও পদ্মা সেতুতে তাদের যুক্ত করে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া গেছে। কিন্তু সব কাজে তাদের যুক্ত করা আবার ঠিক না। এতে তাদের যেটা মূল কাজ তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেসামরিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে একটি সীমিত পর্যায়ে তাদের যুক্ত করা যেতে পারে। তবে মূল কাজটি করতে হবে সরকারের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এটা যে সম্ভব তার প্রমাণও আছে। অনেক সময় সরকারের কোনো কোনো ম্যাজিস্ট্রেটই করে দেখিয়ে দেন। তিনি যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, তখন কারও দিকে না তাকিয়ে তাঁর কাজটি সঠিকভাবে করার চেষ্টা করেন। সেটা আমরা দেখেছি।

প্রথম আলো: ব্যক্তি দিয়ে তো বিচ্ছিন্নভাবে কিছু হতে পারে। নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করার জন্য তো প্রতিষ্ঠান লাগবে?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: পৃথিবীর অনেক শহরেই মেট্রোপলিটন সরকার আছে। শহরের সবগুলো সেবা তারাই দেখে। আমাদের এখানে তা হতে পারে। তবে রাজধানীতে যে কটি সংস্থা কাজ করে, তারা প্রত্যেকেই অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের চেয়ে নতুন প্রকল্প করার দিকে মনোযোগ বেশি। রক্ষণাবেক্ষণের সংস্কৃতি তাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। তারা একের পর এক ফ্লাইওভার বানাচ্ছে। তাদের সব মনোযোগ সেই দিকে। একটি সংস্থা রাস্তা বানাচ্ছে, আরেকটি সংস্থা অন্য কোনো উন্নয়নের নামে তা কাটছে। এটা তো হতে পারে না।

প্রথম আলো: নতুন প্রকল্পে তাদের আগ্রহ বেশি কেন?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: নতুন প্রকল্পের মধ্যে যেগুলো শুধু অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত, সেগুলোতে তাদের আগ্রহ বেশি। এর একটি কারণ হচ্ছে, নতুন প্রকল্প হলে দরপত্র ডাকা থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিগত লাভ থাকতে পারে। কোনো সমস্যাকে ছোট অবস্থায় সমাধান না করে তা বড় হতে দেওয়া হয়। যেমন ঢাকার অনেক রাস্তা ভেঙেচুরে গেছে, অনেক গুলোতে তো রাস্তা বলাটাই কঠিন। এগুলো অল্প খারাপ অবস্থায় মেরামত করা হয় না। পুরো রাস্তা নষ্ট হলে তারপর বড় প্রকল্প নেওয়া হয়। তোড়জোড় শুরু হয়। এটাই বড় সমস্যা।

প্রথম আলো: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

জামিলুর রেজা চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।