তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থান : অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও

খালেদ মোশাররফ
খালেদ মোশাররফ

এক.

১৯৭৫ সালে বিশ্বজুড়ে সাতটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। তার মধ্যে তিনটি ঘটেছিল বাংলাদেশে। বাকি অভ্যুত্থানগুলো ঘটেছিল কমরোস, নাইজেরিয়া, চাদ ও গ্রিসে।

পশ্চিমের প্রচারমাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের ‘সামরিক অভ্যুত্থান’-এর ভাবমূর্তি ভালো নয়। বাংলাদেশের ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানগুলোও বহির্বিশ্বে এ দেশকে তাৎক্ষণিকভাবে একটা অস্থিতিশীলতার ভাবমূর্তি এনে দিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে মাত্র চার বছর আগে স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি ম্লান হয়ে এ সময় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আন্তর্জাতিক প্রচারের বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু নিকট অতীতে সশস্ত্র বাহিনীতে রাজনৈতিক অস্থিরতার বীজ কারা, কীভাবে রোপণ করেছিল, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম খুব কমই অনুসন্ধান করে দেখে ওই সময়। এমনকি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যের গবেষকরাও ১৯৭৫ সালের তিনটি অভ্যুত্থান নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা ও অনুসন্ধান করে গেলেও এসব অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক পটভূমি নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে কমই।

যেমন, তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের আলোচনায় বরাবর যে প্রশ্নটি চলে আসে, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে কারা গুলি করেছিল, কীভাবে তিনি নিহত হলেন ইত্যাদি। কিন্তু কখনো এ প্রশ্ন ভালোভাবে খতিয়ে দেখা হয়নি, খালেদের জন্য মৃত্যুর পটভূমিটি কারা তৈরি করেছিল? কারা তাঁকে অভ্যুত্থানে প্ররোচিত করেছিল? কেন তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার দায় খালেদ ব্যতীত তাঁর অন্য গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীদের বইতে হয় না? উপরন্তু তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের প্রধান প্রধান চরিত্রের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই বা কী ছিল?

আমরা জানি, খালেদের অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি ছিলেন ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান—যাঁর নেতৃত্বে মিরপুর ও সাভারের কয়েকটি রক্ষী ব্যাটালিয়ন এই অভ্যুত্থানে সংশ্লিষ্ট ছিল এবং এভাবেই এই অভ্যুত্থানের প্রধান ও এক শক্ত ভিত হয়েছিলেন মুজিব বাহিনী থেকে রক্ষীবাহিনী হয়ে আসা সেনা কর্মকর্তারা। এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল? এর রাজনৈতিক তাৎপর্যই বা কী? তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার গ্লানি কেন শেষোক্ত এই শক্তিকে খুব বেশি স্পর্শ করে না? 

একইভাবে আমরা দেখব, সাতই নভেম্বর অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার জন্যও মুজিব বাহিনী থেকে উঠে আসা কোনো জাসদ নেতাকে বড় ধরনের শাস্তির বোঝা বা দায়ভার বইতে হয়নি, ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে কেবল লে. কর্নেল আবু তাহেরকে—যিনি দলটিতে যুক্ত হয়েছিলেন ভিন্ন এক রাজনৈতিক সামরিক ঘরানা থেকে।
কেবল ১৯৭৫ সালেই নয়, গত শতাব্দীর ষাট-সত্তর-আশির দশকে তৃতীয় বিশ্বে অনেক সামরিক অভ্যুত্থানই ঘটেছে রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে। যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। যেমনটি আমরা দেখব বাংলাদেশের ১৫ আগস্ট ও ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে। কিন্তু আজও স্পষ্ট না, তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক-আদর্শিক অবস্থান কী ছিল। এটা ভেবে খুব অবাক হতে হয়, খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সহযোগীরা স্বাধীনতা-উত্তর একটি দেশে যে সামরিক অভ্যুত্থান করতে যাচ্ছেন, তার নাম রেখেছিলেন ‘অপারেশন প্যান্থার’! (কর্নেল জাফর ইমাম, দাম দিয়ে কিনেছি এই বাংলা, পৃ.১৩৭) একটি সামরিক অভ্যুত্থানের এরূপ নামকরণ আমাদের কী বার্তা দেয়? এটা কী আমাদের কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক ঘোষণার কথা জানায়, যে ঘোষণা আজ দরকারি মনযোগ দাবি করে?
‍তবে উপরিউক্ত প্রশ্নগুলো থেকে এ রকম ধারণা করার নিশ্চয়ই অবকাশ নেই, এই অভ্যুত্থানটি অরাজনৈতিক চরিত্রের ছিল। কারণ পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখতে পাব এই অভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আজও অনালোচিত একটা রাজনৈতিক দিক রয়েছে।

দুই.
তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থান সম্পর্কে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যে দুটি সিদ্ধান্ত হাজির করা হয়। প্রথমত, এটা ছিল সশস্ত্র বাহিনীতে ‘চেইন অব কমান্ড’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। দ্বিতীয়ত, এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছিল তার বিরুদ্ধে এইরূপ প্রচারণার কারণে যে, এটা ভারতীয় মদদপুষ্ট। অর্থাৎ খালেদ ও তাঁর অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব ভারত-সমর্থিত হিসেবে ‘ভুলভাবে’ চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল বলে দাবি করা হয় এবং সেটাই অভ্যুত্থানের পরাজয়ের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থান বিষয়ে উপরিউক্ত দুটি অনুসিদ্ধান্তই আরও গভীর অনুসন্ধান দাবি করে বৈকি। যে অভ্যুত্থান নিজে থেকে সেনাপ্রধানকে আটকের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল, তাকে চেইন অব কমান্ড পুনরুদ্ধারে আয়োজন হিসেবে মেনে নিতে শুরুতেই মুশকিলে পড়তে হয়। আবার একে স্রেফ চেইন অব কমান্ড উদ্ধারের সামরিক উদ্যোগ বলাও দুরূহ। কারণ, এই অভ্যুত্থানের পূর্বে এর সংগঠকেরা তখনকার সময়ের বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, যার মধ্যে বাকশালও ছিল। এ বিষয়ে অভ্যুত্থানের অন্যতম তরুণ সংগঠক মেজর নাসির উদ্দিন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ (গণতন্ত্রের বিপন্নধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী, পৃ.১১৫) বিস্তারিত ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির নামও রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যে যৌথভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই অভ্যুত্থানের সমর্থনে মিছিল করে, সে বিষয়টিও অক্টোবরে নির্ধারিত ছিল। দেশের একটি প্রধান কমিউনিস্ট দলের তৃতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক রিপোর্টে (১৯৮০) এ বিষয়টিরও উল্লেখ পাওয়া যায়। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তা আনোয়ার উল আলমের গ্রন্থও (রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা, পৃ.১৭৪) এইরূপ সাক্ষ্য মেলে যে, অভ্যুত্থানের পক্ষে রাজনীতিবিদদের অবহিত করা হয়েছিল বা ওই ধরনের যোগাযোগ ছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এসব আলোচনা ও যোগাযোগে তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানকারীদের উৎসাহিত করা হয়েছিল কি না? এ বিষয়ে আমরা আজও বিস্তারিত জানি না। কিন্তু জানা জরুরি যে, তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের পেছনে থাকা এই রাজনীতির লক্ষ্য কী ছিল? কথিত সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডের পাশাপাশি তাঁরা আসলে কোন রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছিলেন? কিন্তু রাজনৈতিক সাহিত্য তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নিয়ে যতটা সোচ্চার, ঠিক ততটাই অনুল্লেখিত ওই সামরিক প্রচেষ্টার রাজনৈতিক দিকটি।
এই পর্যায়েই আলোচিত হয় তেসরা নভেম্বর-কেন্দ্রিক দ্বিতীয় অনুসিদ্ধান্তটি, যার মূল বক্তব্য হলো, খালেদ মোশাররফকে ভুলভাবে ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ভারতপন্থী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল। বস্তুত এটা কতটা ভুল বা ষড়যন্ত্র, তা নিয়ে আরও নির্মোহ অনুসন্ধান দরকার।

খালেদ মোশাররফ
খালেদ মোশাররফ

খালেদ মোশাররফ ‘ভারতপন্থী’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার একটি কারণ হতে পারে, ‘র’-এর পাকিস্তান শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত এস শংকর নায়ারের (যিনি কর্নেল মেনন ছদ্মনাম নিয়ে চলতেন) সঙ্গে মোশাররফের একাত্তরের যুদ্ধকালীন যোগাযোগ। অশোকা রায়নার ‘ইনসাইড র’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ওই সময় শংকর নায়ার বাংলাদেশ সীমান্তজুড়ে অবিরাম যোগাযোগের জন্য অনেক ‘নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র’ খোলেন। খালেদ মোশাররফকে শংকর নায়ারের একজন ‘কেন্দ্রপ্রধান’ হিসেবে অভিহিত করেছেন রায়না (অশোকা রায়না, ইনসাইডার, পৃ.৬২)। এমনকি তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে যে ব্রিগেডিয়ার খালেদ ও ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান ভারতে পালিয়ে যাবেন, তা-ও নির্ধারিত ছিল। (আনোয়ার উল আলম, পূর্বোক্ত)
তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থান ‘ভারতপন্থী’ ক্ষমতা দখল প্রচেষ্টা হিসেবে চিত্রিত হওয়ার অন্তত আরও একটি সুনির্দিষ্ট কারণ ঘটিয়েছিলেন ঢাকার তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেন। তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় বঙ্গভবনে ক্ষমতার নাটকীয় পরিবর্তন যজ্ঞে, বিশেষ করে ব্রিগেডিয়ার খালেদের সেনাপ্রধান হওয়া এবং বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করার প্রক্রিয়ায় সমর সেন সক্রিয় ছিলেন বঙ্গভবনে। ৫ নভেম্বর সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল। এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ (সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, পৃ.৪৮)। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকতার কাজে তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়টিতে বঙ্গভবনে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। উল্লিখিত গ্রন্থ তিনি তাঁর সেদিনের অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।
উপরিউক্ত প্রসঙ্গে আরেকটি কারণের দিকে আলোকপাত করেছেন বাংলাদেশের সেই সময়কার ঘটনাবলির আরেক চরিত্র পিটার কাস্টার্স তাঁর IRONIES OF A PALACE INTRIGUE: THE SHORT-LIVED PUTSCH STAGED ON NOVEMBER 3, 1975 শীর্ষক রিপোর্টে। এটি এখনো অপ্রকাশিত। কারাগারে থাকাবস্থায় তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত বিমানবাহিনীর সাত কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপচারিতার ভিত্তিতে পিটার এই রিপোর্টটি লিখেন ১৯৭৭ সালে। সেখানে তিনি বলেছেন, …It is true that during the month of October, pro-Indian groups and political parties had started leafleting around Dhaka. তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক যোগাযোগ বিষয়ে অভ্যুত্থানকারী পাইলটদের থেকে পাওয়া পিটারের এই রিপোর্ট, মেজর নাসিরের উল্লিখিত তথ্য, সমর সেনের অবস্থান এবং অক্টোবরে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের রাজনৈতিক উদ্যোগ স্পষ্টত সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সুতরাং জনমানসে তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের ‘ভারতপন্থী’ হয়ে পড়ার ‘গুজব’-এর কিছু বাস্তব ভিত্তি তৈরি হয়েছিল বটে এবং তার পুরো দায় শুধু কথিত ‘ষড়যন্ত্রকারী’দের ছিল না। যদিও আপাতত আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্যে বিষয়টি সেভাবেই ঠাঁই করে নিয়েছে।

তিন.
তেসরা নভেম্বরের কথিত ‘অপারেশন প্যান্থার’ (!)-এর আরেকটি এবং সম্ভবত সবচেয়ে নাটকীয় দিকটি নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্যের অনাগ্রহ সবচেয়ে বেশি বিস্ময়কর। তা হলো এই অভ্যুত্থানের অভ্যন্তরীণ সংগঠকদের মধ্যেই একাংশ কর্তৃক একপর্যায়ে খালেদ মোশাররফকে ‘সরিয়ে দেওয়া’র উদ্যোগ।
অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক মেজর নাসির উদ্দিন আমাদের জানাচ্ছেন, (র‍্যাঙ্কগত বিবেচনায় অপারেশন প্যান্থারের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তিত্ব) ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান ওই অভ্যুত্থানের শেষলগ্নে খোদ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকেই নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিতে আরেকটি অভ্যুত্থান করতে চেয়েছিলেন (নাসির, পূর্বোক্ত, পৃ.১৩৭) ! প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদের কাছ থেকে জোর করে সেনাপ্রধান পদে নিয়োগ লাভের পর খালেদ যখন সব সৈনিককে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিয়ে তাঁর অভ্যুত্থানের সমাপ্তি টানতে চাচ্ছিলেন, তখনই ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান নতুন প্রকল্প শুরু করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ৬ নভেম্বর রাতে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে সংগঠিত সাধারণ সিপাহিদের বিদ্রোহ সেই পরিকল্পনা ভন্ডুল করে দেয়। অর্থাৎ এ পর্যায়ে চৌকস সমরবিদ খালেদ তাঁর অভ্যুত্থানকে স্রেফ সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফেরত আনার একটি উদ্যোগ হিসেবে সীমিত করতে চাইলেও নূরুজ্জামান চাইছিলেন আরও অনেক কিছু। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানরা কী চাইছিলেন?
উল্লেখ্য, (প্রাক্তন) রক্ষীপ্রধান নূরুজ্জামান তাঁর পরিকল্পিত অভ্যুত্থানে অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকেও সম্পৃক্ত করতে চেয়েছিলেন (এ বিষয়ে অভ্যুত্থানের দুই গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক নূরুজ্জামান ও নাসির উদ্দিনের ৬ নভেম্বরের কথোপকথন দেখুন, মেজর নাসির উদ্দিন, পূর্বোক্ত, পৃ.১৪৩)।
তবে সেনাবাহিনী ও দেশের সৌভাগ্য যে প্রচুর রক্তপাতের সম্ভাবনায় পূর্ণ তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের পরিকল্পকদের অভ্যন্তরীণ দ্বিতীয় অভ্যুত্থানটি আর ঘটেনি বা ঘটতে পারেনি। তাঁরা কাজে নামার আগেই সিপাহি অভ্যুত্থানের উদ্যোক্তারা নিজেদের কার্যক্রম অনেক এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। নূরুজ্জামানদের পরিকল্পনার ১২ ঘণ্টার মধ্যে জাসদ ও আবু তাহের তাঁদের বিপ্লবী সিপাহি সংস্থার মাধ্যমে আঘাত হানেন। প্রস্তুত হয় গণবাহিনী।
লক্ষণীয়, তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানে এবং তার মাঝেই পরিকল্পিত দ্বিতীয় অভ্যুত্থানটিতে ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানের শক্তির উৎস ছিল মুজিব বাহিনীর গর্ভজাত রক্ষী ব্যাটালিয়নগুলো। অন্যদিকে জাসদ যেভাবে আশা করেছিল তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সিপাহিদের অভ্যুত্থান শেষে দেশব্যাপী তাদের ‘গণবাহিনী’ পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নেবে, সেই গণবাহিনীরও শক্ত ভিত ছিল মুজিব বাহিনী থেকে আসা যোদ্ধারা। অর্থাৎ তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থান এবং তার বিরুদ্ধে সংঘটিত পাল্টা অভ্যুত্থান—উভয় ক্ষেত্রে চালকের আসনে দেখা যাচ্ছে মুজিব বাহিনীর দ্বিতীয় প্রজন্মের সংগঠনগুলোকে।
তবে নূরুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীদের মতো জাসদের উদ্যোগও ব্যর্থ হয়েছিল সেদিন। এটাই ছিল মুজিব বাহিনীর বহুমাত্রিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হোঁচট খাওয়া। অর্থাৎ ১৯৭৫-এর নভেম্বরে এসে মুজিব বাহিনীর প্রধান দুটি ধারাকে প্রথমবারের মতো থমকে দাঁড়াতে হয়, তত দিনে অবশ্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ খাদের প্রায় কিনারে পৌঁছে গেছে।

আলতাফ পারভেজ: রাজনৈতিক ইতিহাসের একজন গবেষক।