যিনি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ঠেকিয়েছিলেন

প্রণব মুখার্জি    ও   শাহ মোহাম্মদ কোরেশি
প্রণব মুখার্জি ও শাহ মোহাম্মদ কোরেশি

প্রণব মুখার্জিকে বলা হয় ট্রাবল শুটার বা মুশকিল আসানকারী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েই তিনি ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যে ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান সফর করেন। কিন্তু বিপত্তি ঘটায় ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা।

২৬ নভেম্বর ২০০৮। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ কোরেশি ভারত সফরে আসেন প্রণব মুখার্জির আমন্ত্রণে। ওঠেন দিল্লির হায়দরাবাদ ভবনে। প্রণব লিখেছেন, সাধারণত আমন্ত্রিত অতিথি সফরের প্রথম দিন তাঁর প্রতিপক্ষের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করেন। কিন্তু পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, যেহেতু ওই দিন পাকিস্তান হাইকমিশন নৈশভোজের আয়োজন করেছে, সেহেতু তাঁরা পরদিন চণ্ডীগড়ে মধ্যাহ্নভোজে একত্র হতে পারেন। সেখানে সিআরআরআইডি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিল কৃষিক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সহযোগিতা নিয়ে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর প্রণব মুখার্জি তাঁর দপ্তরে চলে যান। সেখানে তিনি রাত সাড়ে আটটা-নয়টা পর্যন্ত কাজ করেন। প্রণব অফিসে থাকতেই সহকর্মীরা মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার খবর দেন। তিনি টিভি খুলে দেখতে পান, বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী হামলা চলছে। মধ্যরাতে বাড়ি ফিরেও টিভির পর্দা থেকে চোখ সরাতে পারেননি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

পরদিন গোয়েন্দা ব্যুরো ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে হালনাগাদ রিপোর্ট পাওয়া যায়। মধ্যরাতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাতিল ও তাঁর সহযোগীরা মুম্বাইয়ে পৌঁছান। পরে তাঁরা দিল্লি ফিরে এসে রিপোর্ট দেন। প্রতিটি টিভি চ্যানেল তাজমহল ও অন্যান্য স্থানে হামলার বিস্তারিত খবর প্রচার করছিল। সন্ত্রাসীরা করাচি বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে।

এরপর প্রশ্ন আসে, পাকিস্তান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর অব্যাহত থাকবে কিনা। প্রণব ইতিমধ্যে তাঁর চণ্ডীগড় যাওয়া বাতিল করেছেন। পাকিস্তান হাইকমিশনার জানান, তাঁদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একদল নারী সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছেন। প্রণব তাঁর পরিচিত এক সাংবাদিককে টেলিফোন করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিতে বলেন। কোরেশি টেলিফোন ধরলে প্রণব মুখার্জি আগেই প্রস্তুত করা নোটটি পড়ে শোনান:

মন্ত্রী মহোদয়, এই পরিস্থিতিতে আপনার ভারতে অবস্থান কোনো ফল দেবে না। আমি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি, আপনি দ্রুত চলে যান। আপনি যখন সুবিধা মনে করবেন, আমার সরকারি বিমান আপনাকে নিয়ে যাবে। এটা প্রত্যাশিত যে যত দ্রুত সম্ভব আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন।

কিছুক্ষণ পর পাকিস্তান হাইকমিশনার থেকে প্রণবকে জানানো হয়, তাঁদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই প্রস্তাবের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন
এবং তাঁকে এ-ও জানানো হয় যে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটি বিমান এসে তাঁকে নিয়ে যাবে। পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার পর কোরেশি গণমাধ্যমকে জানান, ভারতে তাঁকে সব ধরনের সৌজন্য ও কূটনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

প্রণব লিখেছেন, ‘যদিও আমার লিখিত নোটে কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুরো কথোপকথনে আমি সৌজন্য রক্ষা করেছি।’

এরপর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে গণমাধ্যমে নানা ধরনের জল্পনা প্রকাশিত হতে থাকে। পাকিস্তান যথারীতি অস্বীকারের মনোভাব দেখায় এবং কতিপয় পাকিস্তানি নেতা দাবি করেন, সন্ত্রাসীরা নন-স্টেট অ্যাকটর, রাষ্ট্রের কেউ নন। এর জবাবে প্রণবের প্রতিক্রিয়া ছিল শাণিত ও কঠোর। তিনি বলেন, এই নন-স্টেট সন্ত্রাসীরা স্বর্গ থেকে আসেনি। তারা নির্দিষ্ট দেশের ভূখণ্ডেই বসবাস করছে। প্রণব আরও জানান, ‘আমাদের কাছে প্রমাণ আছে, সন্ত্রাসীরা করাচি থেকে এসেছে। তারা গভীর সাগর পর্যন্ত একই জাহাজে ছিল। এরপর তারা একটি ভারতীয় মাছ ধরার নৌকা ছিনতাই করে এবং মুম্বাই উপকূলে এসে এর নাবিককে হত্যা করে।’

প্রণব প্রথম টেলিফোন পান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইসের কাছ থেকে। জবাবে প্রণব বলেন, তিনি যেন পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন, যাতে তারা আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস বন্ধ করে।

পরের তিন দিনে প্রণব শতাধিক দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। প্রত্যেকে ভারতের সঙ্গে তাঁদের সংহতি প্রকাশ করেন এবং আক্রমণের নিন্দা করেন। তবে প্রণব ইসরায়েলের সমর্থন চাননি। কেননা তাতে ৫৪টি ইসলামি দেশ যে ভারতকে সমর্থন করেছে, তা প্রত্যাহারের ঝুঁকি ছিল। অন্যদিকে চীনের নেতারা ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করলেও তাঁরা এটা মানতে রাজি নন যে পাকিস্তানি ঘাঁটি থেকেই এই হামলা হয়েছে।

মুম্বাইয়ের ঘটনা নিয়ে ভারতের মন্ত্রিসভায় উত্তপ্ত বিতর্ক হয়। কেউ কেউ সামরিক হস্তক্ষেপের দাবি করেন। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই যুক্তিতে তা নাকচ করে দেন যে বৈদেশিক নীতিতে ভারত যেমন রোমাঞ্চে বিশ্বাস করে না, তেমনি সেখানে ভাবালুতারও জায়গা নেই।

তিনি বলেন, সব সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় সংলাপ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো পাকিস্তানি সন্ত্রাসীরা এই প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি বাধাগ্রস্ত করছে। অনুকূল পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার প্রস্তাবিত সংলাপ স্থগিত থাকবে। এ সময়ে একটি মজার ঘটনা ঘটে, যার উল্লেখ প্রণব মুখার্জির বইয়ে আছে। ‘ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অফিস থেকে বলছি’ এই পরিচয়ে এক ব্যক্তি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জারদারির দপ্তরে টেলিফোন করে হুমকি দেন যে তাঁরা যেন পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকেন।

তখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণবকে ধরার চেষ্টা করেও পাচ্ছিলেন না। খবর পেয়ে প্রণব তাঁকে টেলিফোন করেন। তখন রাইস জানতে চান, তিনি পাকিস্তানকে কোনো হুমকি দিয়েছেন কি না। প্রণব তাঁকে বলেন, যদি সে রকম কোনো কিছু ঘটে থাকত, তাহলে কী করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাজধানী থেকে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরে থাকেন? প্রণবের ধারণা, পাকিস্তানিরাই তাঁকে এ খবরটি দিয়েছিল।

পরে পাকিস্তানের ডন পত্রিকা প্রকৃত রহস্যের উদ্‌ঘাটন করে। খবরে বলা হয়, যে ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট জারদারির অফিসে টেলিফোন করে বলেছিল, ‘আমি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অফিস থকে বলছি’, সে এখন জেলে।

মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাম পাতিল প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়েন। কংগ্রেস নির্বাহী কমিটির বৈঠকে অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং মন্ত্রী পরিবর্তনের দাবি জানান। প্রণব পরিস্থিতি শান্ত করতে বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে কাউকে দোষারোপ করা ঠিক হবে না। আমাদের সবারই দুর্বলতা ছিল।’

১ ডিসেম্বর সকালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রণবকে টেলিফোন করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। ইতিমধ্যে শিবরামকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জানান, সোনিয়া গান্ধীর পরামর্শ হলো তিনি (প্রণব) যেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন। তবে তিনি সোনিয়াকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে প্রণব যেভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থেকে ‘যুদ্ধাবস্থা’ মোকাবিলা করছেন, তঁাকে পরিবর্তন করা ঠিক হবে না। এরপর পি চিদাম্বরমকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়।

মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে সংসদেও বিতর্ক হয়। সেখানেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা উসকানিতে পা দিইনি। কারও উসকানিতে পা দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্তর্জাতিক প্রচার চালাতে হবে এবং সব দেশকে জানাতে হবে যে এটি ভারত-পাকিস্তানের বিষয় নয়, বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের অংশ।’

এরপর প্রণবের সফল কূটনৈতিক তৎপরতায় পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রাজি হয়। লস্কর–ই–তাইয়েবাসহ কয়েকটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে প্রণব মনে করেন, এটাই যথেষ্ট নয়। পাকিস্তানে সন্ত্রাসীদের যে আস্তানা আছে, তা পুরোপুরি ভেঙে দিতে হবে। তিনি এও বলেন যে আমরা আমাদের প্রতিবেশী বদলাতে পারব না। আবার অব্যাহত উদ্বেগ নিয়ে তাদের সঙ্গে বসবাসও করতে পারব না। এই সমস্যা আমাদের সমাধান করতেই হবে।

১৯ ডিসেম্বর সংসদে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, ‘সন্ত্রাসী এবং যারা তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, অর্থ জোগাচ্ছে তাদের উন্মোচন করা ও বিচারের মুখোমুখি না করা পর্যন্ত ভারত তার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে।’

এভাবেই প্রণব ২০০৮ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ঠেকিয়েছিলেন। (শেষ)

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।