ইরান-সৌদি প্রক্সি যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে দেশে দেশে

ইয়েমেন থেকে রিয়াদমুখী ব্যালিস্টিক মিসাইল। ছবি: রয়টার্স
ইয়েমেন থেকে রিয়াদমুখী ব্যালিস্টিক মিসাইল। ছবি: রয়টার্স

লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি শনিবার যখন ইরানকে তাঁর দেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপের দায়ে নানানভাবে দোষারোপ করে পদত্যাগ করেন, তখন বিষয়টি হাস্যকর হয়ে ওঠে এ কারণে যে কাজটি করছিলেন তিনি সৌদি আরবে বসে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ রকম পদত্যাগের দৃষ্টান্ত বিরল।

তবে সৌদদের আশ্রিত হওয়ায় সাদ হারিরিকে বেশি দোষ দেওয়া যায় না, কারণ তাঁকে তাড়া করছে পিতার খুনের স্মৃতি। প্রায় ১৩ বছর আগে রফিক হারিরি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় দুই হাজার পাউন্ড ওজনের এক বোমায় খুন হয়েছিলেন এবং সেই মৃত্যুর জন্য দায়ী হিসেবে সন্দেহ করা হয় দেশটির শিয়াশক্তি হিজবুল্লাহকে।

এদিকে হারিরির পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইয়েমেন থেকে রিয়াদে এসে আঘাত হানে এক ব্যালিস্টিক মিসাইল। ঠিক এই সময়ই কেন ইরান-সমর্থিত হুতি যোদ্ধারা রিয়াদে মিসাইল ছুড়ল, সেটা কৌতূহলোদ্দীপক; তবে এই ঘটনায় সমগ্র বিশ্ব, বিশেষ করে মুসলমান দেশগুলো নিশ্চিতভাবেই আরেকটি ব্যাপকভিত্তিক প্রক্সি যুদ্ধের আলামত ভালোভাবেই টের পাচ্ছে। আসলে বাস্তবে সে যুদ্ধ শুরুও হয়ে গেছে—আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাহরাইন, ইয়েমেন, লেবানন, ইরাক, কাতার ও সিরিয়ায়। এসব দেশে এবং আশপাশের আরও অনেক দেশে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সৌদি-ইরান সংঘাতের ছাপ পড়ছে সরাসরি এবং বিধ্বংসীরূপে।

ইয়েমেনে ২০১৫ সালের মার্চ থেকে সৌদি আগ্রাসন চলছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১০ হাজার বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে এতে। সর্বশেষ মিসাইল হামলার পর সৌদিরা দেশটির বিরুদ্ধে নৌ-বিমান-স্থল অবরোধ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। এতে দেশটিতে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে যাবে। সংকটের মূল কারণ ইয়েমেনের প্রেসিডেন্টের দাবিদার মনসুর হাদিকে রক্ষা করতে সৌদিদের মরিয়া চেষ্টা থেকে। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ প্রবল। সে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে উত্তর ইয়েমেনের জায়েদি শিয়াদের সংখ্যাধিক্য থাকায় এবং তাদের ওপর ইরানের প্রভাব থাকায় সৌদিদের জন্য তা মাথাব্যথার কারণ।

স্থলযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো সফলতা না থাকলেও সৌদিদের পুনঃপুন বিমান হামলায় ইয়েমেন এখন বিধ্বস্ত। শরণার্থীশিবিরগুলোতেও নির্বিচারে বোমা ফেলা হচ্ছে। এই মুহূর্তে দেশটিতে খাদ্য ছাড়াও ওষুধের তীব্র অভাব।

সাদ হারিরি। ছবি: রয়টার্স
সাদ হারিরি। ছবি: রয়টার্স

সাদ হারিরির ঘটনার পর লেবাননের বাসিন্দারাও ইয়েমেনের মতো দুর্দশার আশঙ্কা করতে পারেন। কারণ, এতে করে সেখানের রাষ্ট্রকাঠামোতে সুন্নি-শিয়া-খ্রিষ্টান নাজুক ঐক্য ভেঙে পড়তে পারে। ১৯৭৫ থেকে পরবর্তী ১৫ বছর যা ঘটেছিল, সেই ভয়ে এখন থেকেই দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাবে। সুন্নি হারিরিকে নিজ দেশে ডেকে এনে পদত্যাগে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট যে লেবাননে শিয়াপন্থী হিজবুল্লাহর পক্ষে রাজনৈতিক ভারসাম্য হেলে থাকা সৌদিদের একদম পছন্দ নয়, কারণ সৌদিদের দৃষ্টিতে হিজবুল্লাহ হলো অনেকাংশেই ইরানের প্রক্সি।

সৌদিদের এ রকম আরেক অপছন্দের বলি কাতার। বরাবর সৌদি আরব থাকলেও ইরানের সঙ্গে কাতারের শাসক পরিবারের ঘনিষ্ঠতায় বিরক্ত হয়ে গত জুন থেকে দেশটির বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে সৌদিরা। এই অবরোধে তারা অংশ নিতে বাধ্য করেছে আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসরকেও। তবে তার্কি ও ইরান চটজলদি কাতারের পাশে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় অবরোধের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল সামান্যই। এতে সৌদিরা ইরানের ওপর বাড়তি ক্ষুব্ধ। যত দূর মনে হয়, কাতারের শাসক পরিবার বদলাতে সৌদি-সমর্থিত একটা ক্যুদেতা সেখানে আসন্ন। তবে তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দসই কাউকে খুঁজে পেতে হবে সৌদি পরিকল্পকদের।

অথচ সিরিয়া যুদ্ধে আসাদের বিপক্ষ শক্তিকে সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে কাতার ছিল সৌদি মিত্র। সিরিয়ায় ইরানের এলিট ফোর্সগুলোর পাশাপাশি মূলত হিজবুল্লাহর যোদ্ধাদের কারণেই বাশার আল-আসাদকে সরাতে ব্যর্থ হয়েছে সৌদিরা। যে কারণে হিজবুল্লাহর প্রতি বর্তমানে ইসরায়েলের চেয়েও সৌদিদের আক্রোশ বেশি। সাদ হারিরিকে দিয়ে তাই দেশটির পুরোনো জাতিগত বিভেদে অনেকখানি জ্বালানি ঢেলে দেওয়া হলো।

সিরিয়া যুদ্ধে ২০১৫ থেকে রাশিয়াও পরাশক্তির রূপ ধারণ করে ইরান-হিজবুল্লাহ জোটকে সহায়তা করেছে। ঠিক তার ভিন্ন পরিস্থিতি দেখব আমরা ইয়েমেনে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দিচ্ছে হুতিবিরোধী সৌদি সামরিক জোটকে। হুতি তথা ‘আনসার-আল্লাহ’ আন্দোলন জন্মগতভাবে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী। ফলে লেবানন ও সিরিয়ার মতোই ইয়েমেনেও সৌদি-ইরান প্রক্সি যুদ্ধে সরাসরি স্বার্থ রয়েছে ইসরায়েলের। কেউ কেউ এও মনে করেন যে ইরানের বিরুদ্ধে সৌদিরা আসলে ইসরায়েলের প্রক্সি দিচ্ছে। ছদ্মযুদ্ধটি হচ্ছে প্রধানত ইরান ও তার সহযোগীদের সঙ্গে ইসরায়েলের। ইসরায়েল বহু আগেই প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকেই তারা প্রধান প্রতিপক্ষ ভাবে। সিরিয়ার ধ্বংসযজ্ঞ তাই ইসরায়েলের জন্য একটি নীরব বিজয়।

সৌদি আরবের বাদশা সালমান। ছবি: রয়টার্স
সৌদি আরবের বাদশা সালমান। ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলের মতোই ইরান-সৌদি প্রক্সি যুদ্ধে সর্বত্রই রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রও কোনো না কোনোভাবে শরিক আছে। যার এক দফা ঐতিহাসিক সূচনা ঘটেছিল ১৯৭৮-পরবর্তী আফগানিস্তানে ‘সাউর বিপ্লবে’র বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি হিসেবে সৌদি-পাকিস্তান-মুজাহিদিন জোটের মধ্য দিয়ে। আর এই জোটের মেঠো শক্তি পশতুনদের খাবার হয়ে উঠেছিল তখন দেশটির ১২ ইমামপন্থী শিয়া হাজারারা। যাদের সঙ্গে ইরানের রয়েছে বিশেষ নৈকট্য। বর্তমানে আবার হাজারারা আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর মিত্র এবং পশতুন তালেবানরা রুশদের বেশ ঘনিষ্ঠ। পাশাপাশি সৌদিরাও তালেবানদের পুরোনো সাহায্যকারী হিসেবে আছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-সৌদি সংঘাতের স্পষ্ট ছাপ পড়বে শিগগির কাবুলের গ্রিন জোনে এবং পাকিস্তানেও। সেই কারণেই হয়তোবা এ সপ্তাহে হুতিদের রহস্যময় মিসাইল যখন রিয়াদে পড়ছিল, তখন পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান জাভেদ বাজোয়া তেহরান সফর করছিলেন। আর দেশটির পূর্বতন চার তারকা জেনারেল রাহেল শরিফ ইয়েমেনে সৌদি সামরিক জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন গত এপ্রিল থেকে।

বরাবরই রিয়াদ ও তেহরানের প্রক্সি যুদ্ধের অন্যতম রক্তাক্ত বলি পাকিস্তানের সমাজ। প্রায়ই সেখানে শিয়া মসজিদগুলোয় যে আত্মঘাতী হামলা হয়, তার জন্য পাকিস্তানের গোয়েন্দারা সৌদিপন্থী সালাফিস্টদেরই দায়ী করে থাকে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার চোরাগোপ্তা এরূপ হামলা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি স্থানীয় শিয়া তরুণদের অনেকেই এখন ইরানের প্রতি আকৃষ্ট এবং তারা যোগ দিচ্ছে শিয়া লিবারেশন আর্মিতে।

ইউনাইটেড গ্লোবাল ‘শিয়া লিবারেশন আর্মি’ বা এসএলএর বিষয়টি প্রথম প্রচারমাধ্যমে আসে গত বছর ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর খ্যাতনামা জেনারেল মোহাম্মদ আলী ফালাকির স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে। এই বাহিনীর সদস্যরা এসেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিশেষ করে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইরাকের শিয়া জনগোষ্ঠী থেকে। ইরাকে প্রথম এরূপ বাহিনীর গোড়াপত্তন করেছিলেন ইরানি জেনারেল কাসিম সোলায়মানি। সেই কাসিম সোলায়মানিই এসএলএর কমান্ডার হিসেবে থাকছেন। যদিও এই বাহিনীর শক্তিসামর্থ্য সম্পর্কে ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলে না।

বলা বাহুল্য, এরূপ বাহিনীর বিপরীতে আরেকটি সুন্নিপ্রধান বাহিনী তৈরির জন্যই সৌদিরা সম্ভবত পাকিস্তান থেকে রাহেল শরিফকে পছন্দ করেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দুটি সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, সৌদি সমর আকাঙ্ক্ষার আদর্শিক আবেগ দুর্বল। মুসলিম বিশ্বে তরুণদের মাঝে সৌদদের ইমেজ ভালো নয়। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি কোনো জেনারেলের পক্ষে সৌদি অভিলাষ মেটানো দুরূহ, কারণ তাতে দেশটির সেনাবাহিনীতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। সৌদিদের সঙ্গে ইসরায়েলের নিবিড়তা এবং ভারত-ইসরায়েল চলমান সামরিক সহযোগিতা পাকিস্তানিদের অজানা নেই।

ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ছবি: রয়টার্স
ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ছবি: রয়টার্স

এটা সত্য যে সৌদি আরবের প্রতি পাকিস্তানের বিপুল অর্থনৈতিক নির্ভরতা রয়েছে। দেশটির লাখ লাখ কর্মী সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে কাজ করছে। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই সৌদিরা ইয়েমেন যুদ্ধে জড়াতে চাইছে পাকিস্তানকে (এবং বাংলাদেশকেও)। এতে পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় ১৫ ভাগ—শিয়া জনগোষ্ঠী নিশ্চিতভাবেই অসুখী হবে।

পাকিস্তানের জনসংখ্যার শিয়া-সুন্নি বিন্যাসের উল্টো চিত্র দেখা যায় ইরাকে। তবে সৌদ ও ইরানিদের প্রভাব সেখানে আরও প্রত্যক্ষ। ইরাকে সুন্নি প্রায় ৩০ ভাগ এবং শিয়া প্রায় ৭০ ভাগ। ২০০৩ থেকে সুন্নি শাসক বাথপার্টি ক্ষমতাচ্যুত হওয়া মাত্র শিয়ারা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে দেশটিতে এবং তার সরাসরি সুবিধাভোগী হয়ে উঠে ইরানের ক্ষমতাসীনেরা। তবে এ অবস্থার মোকাবিলায় সেখানে দায়েশকে (আইএস) ঠেলে দেওয়া হলেও হাজার হাজার শিয়া স্বেচ্ছাসেবীর মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করে ইরানি জেনারেলরা তিকরিত, ফালস্নুজা ও মসুলের পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভালোভাবেই সাহায্য করেছেন। সৌদি প্রভাবিত মার্কিন প্রশাসন ইরাক থেকে ‘পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্স’ ধাঁচের শিয়া বেসরকারি মিলিশিয়া বাহিনীগুলো তাড়াতে এখন তাই খুবই তৎপর। অথচ বাহরাইনে বিপুল সৌদি সামরিক উপস্থিতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একই প্রশাসন চোখ বন্ধ করে আছে।

বাহরাইনে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া হলেও শাসন পরিসরে তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। ইরান একদা বাহরাইনকে তার অংশ দাবি করলেও এখন আর তেমন অবস্থান নেই তাদের। তবে বাহরাইনের শিয়াদের মাঝে ইরানের প্রভাব খুবই স্পষ্ট। সৌদি আরব তাই তার জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছোট এই দেশে সরাসরি সামরিক উপস্থিতি কায়েম করে রেখেছে।

বাহরাইন, লেবানন, সিরিয়া, কাতার, ইয়েমেনসহ উপরিউক্ত বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা এবং সৌদি রাজপরিবারের নতুন প্রভাবশালী চরিত্র যুবরাজ সালমানের আগ্রাসী মনোভাব থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কোনো কোনো বিশ্লেষকের অনুমান ইরান-সৌদি সংঘাতের অংশ হিসেবে মুসলমানপ্রধান অনেক দেশেই আসন্ন দিনগুলোয় বহুরূপী অস্থিরতা বাড়বে। আর যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং বিশেষভাবে ইসরায়েল নিজ নিজ স্বার্থের জায়গা থেকে এ ক্ষেত্রে ইন্ধন দিয়ে যাবে। মুসলমানপ্রধান দেশগুলো যত বেশি দুই শিবিরে যুদ্ধসাজে সজ্জিত হবে, ততই ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমির লড়াইকে দমন করা ইসরায়েলের জন্য সহজ হবে।
আলতাফ পারভেজ: সাংবাদিক ও লেখক