প্রথম আলো কেন এক নম্বর

১. এটা কী করে সম্ভব যে প্রথম আলো ফেসবুক পেজ বাংলাদেশের এক নম্বর ফেসবুক পেজ?

ফেসবুকে তো কত বিষয়েই পেজ আছে। ধরা যাক, ক্রিকেট নিয়ে পেজ আছে, সিনেমা, গান নিয়ে আছে। মাশরাফি বিন মুর্তজারও পেজ আছে, বাংলাদেশ ক্রিকেট সমর্থকদের আছে, সাকিব খান কিংবা তিশারও পেজ আছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি লাইক কেন প্রথম আলো ফেসবুক পেজের?

২. প্রথম আলো ডট কম কেন পৃথিবীর এক নম্বর বাংলা সাইট? প্রথম আলো ডট কম কেন পৃথিবীর এক নম্বর বাংলাদেশি সাইট?

আরও কত কত ওয়েবপেজ, ওয়েব পোর্টাল তো আছে। সেসবের মধ্যে বাঙালি আর বাংলাদেশিরা কেন প্রথম আলো ডট কমেই সবচেয়ে বেশি সময় ক্লিক করেন?

৩. এবং কেন প্রথম আলো নামের কাগজটি, আমি কাগজ কথাটা ভেবেচিন্তে লিখছি, রোজ ৫৩ লাখ লোক পড়েন? কেন তা রোজ পাঁচ লাখের মতো ছাপা হয়? কেন তা এত দিন ধরে বাংলাদেশের এক নম্বর খবরের কাগজ? আর ১২ লাখ অনলাইন পাঠক ধরলে রোজ এই সংবাদমাধ্যমটি পড়েন ৬৫ লাখ পাঠক।

প্রিয় পাঠক, আপনারা যদি উত্তরটা দেন, তাহলে আলোচনা জমে উঠবে। আমরা হয়তো কিছু আলো পাব, কিছু দিশাও পাব। প্রথম আলো অনলাইনে, ফেসবুক পেজের কমেন্টসে কিংবা চিঠি লিখে আপনারা এই আলোচনায় অংশ নিতে পারেন। আমার ফেসবুক পেজের কমেন্টসেও আপনারা আলোচনায় অংশ নিতে পারেন।

আমার নিজের কাছে তিন নম্বর প্রশ্নটির একটা উত্তর আছে। প্রথম আলো কাগজটি কেন দেশের এক নম্বর সংবাদপত্র? আমি অনেক ভেবে একটা উত্তর বের করেছি। আর তা হলো প্রথম আলোয় কোনো খবর প্রকাশিত হলে মানুষ তা বিশ্বাস করে। এটা কি কাগজে, কি অনলাইন সংস্করণে। খবর পাওয়ামাত্রই প্রথম আলো তা প্রকাশ করে না, নানা দিক থেকে খবরটা সত্য কি না, যাচাই-বাছাই করার চেষ্টা করে। যখন সে নিঃসন্দেহ হয় যে খবরটা সত্য, তারপরই কেবল প্রথম আলো তা প্রকাশ করে।

আমাদের যে বন্ধুরা অন্য সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন, তাঁদের অনেকেই এ কথা আমাকে বলেছেন। যখনই কোনো খবর ছড়িয়ে পড়ে, তাঁরা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করেন, প্রথম আলো কি এই খবর দিয়েছে? যদি না দেয়, তাহলে অপেক্ষা করো। এখনই এটা বিশ্বাস করার দরকার নেই। কী বলছ! প্রথম আলো দিয়েছে? তাহলে ধরেই নাও যে এই খবরটা সত্য। এটা আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা, যাঁরা অন্য অনলাইনে, টিভিতে, কাগজে কাজ করেন, তাঁরা আমাদের বলেন।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দুই বোলারকে একবার সন্দেহজনক অ্যাকশনের জন্য বিশ্বকাপ খেলা থেকে বিরত রাখা হয়। এই নিয়ে সারা দেশে প্রবল হইচই। একদিন অনেক টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমে বলা হতে লাগল, তাসকিনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এত বড় খবর! কিন্তু প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে না। আমরা অধৈর্য হয়ে পড়লাম। আরও খানিক পরে প্রথম আলো খবর প্রকাশ করল উল্টোটা, তাসকিনের নিষেধাজ্ঞা বহালই আছে।

আসলে প্রথম আলোই ছিল সঠিক।

গতকাল প্রথম আলোয় মশিউল আলম একটা কলাম লিখেছেন, ভুয়া খবরের যুগে সাংবাদিকতা। তাতে তিনি আমাদের জানাচ্ছেন, কলিন্স ইংলিশ ডিকশনারি ‘ফেইক নিউজ’ শব্দবন্ধকে ২০১৭ সালের ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার ঘোষণা করেছে। ‘ভুয়া খবর’ হলো এ বছরের সর্বাধিক আলোচিত শব্দ। আর এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইটারে বারবার ফেইক নিউজ ফেইক নিউজ বলে বলে শব্দটার ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছেন।

এ থেকে দুটি ভাবনাসূত্র আমরা পেয়ে যাই। এক. ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের সম্পর্ক। দুই. অনলাইনের এই যুগে ফেইক নিউজ আর আসল খবর আলাদা করার জটিলতা।

ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় একটা রম্য রচনা পড়লাম। তাতে বলা হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন, তাঁকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী করাটা আসলে ছিল হিলারি ক্লিনটনের একটা ষড়যন্ত্র। হিলারি ইচ্ছা করে হেরে গেছেন, যাতে করে ট্রাম্পকে অভিশংসিত করা যায়! রম্য রচনা। এটা সত্যিকারের খবর নয়। তবে এই রম্য রচনার মোরাল হলো, ট্রাম্প এমন একজন ব্যক্তি, যিনি এখনো কেন অভিশংসিত হচ্ছেন না, এটাই একটা বিস্ময়। তিনি ক্ষমতাসীন হয়েই সংবাদমাধ্যমের ওপর হম্বিতম্বি শুরু করেছেন। হোয়াইট হাউসে কে ঢুকতে পারবেন, কে পারবেন না, সেটা ঠিক করে দিয়ে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন। তবে আসলে তাঁর এসব কীর্তিকলাপ সংবাদমাধ্যমের জন্য শাপে বর হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, বেড়ে গেছে টেলিভিশনের টিআরপি বা জনপ্রিয়তার হার।

অন্যদিকে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে অসত্য খবরের ছড়াছড়ি। গুজবকে খবর হিসেবে ছড়ানো হচ্ছে। অনেক অনলাইন পোর্টাল তার হিট বাড়ানোর জন্য শিরোনাম করছে চটকদার। খবর পড়ার পর বোঝা যাচ্ছে খবরটাতে আসলে কিছু নেই। কাজেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধুলায় অন্ধকার সময়েই সঠিক খবরের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। ফলে একটা প্রতিষ্ঠান যদি এই সুনাম অর্জন করতে পারে যে তাদের খবর বিশ্বাসযোগ্য, তাহলে তার বিজয় অনিবার্য। আমার ধারণা, প্রথম আলো সেই বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাটা অর্জন করেছে। কাজেই প্রথম আলোর উচিত এই জায়গাটাতেই সবচেয়ে জোর দেওয়া—খবরের সত্যতা বারবার করে যাচাই করা, নিশ্চিত হওয়ার পরেই কেবল খবর প্রকাশ করা।

আমার উত্থাপিত তিনটা প্রশ্নের তিন নম্বরটা নিয়ে আমি আলোচনা করতে পারলাম। কেন প্রথম আলো নামের সংবাদপত্রটি বেশি লোকে পড়েন। কিন্তু প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর কী? কেন এত পেজ থাকতে প্রথম আলো ফেসবুক পেজ এক নম্বর? দুই. কেন এত বিচিত্র অনলাইন পোর্টাল থাকতে প্রথম আলো ডট কম এক নম্বর? নিউজ পোর্টালের মধ্যে এক নম্বর হলে তা বিস্ময়কর হতো না। কিন্তু বিনোদন, রম্য, স্বাস্থ্য, খেলা, বেচাকেনা—যত ধরনের পোর্টাল বাংলাদেশে আছে, তার মধ্যে কেন প্রথম আলো ডট কমই এক নম্বর?

আমার কাছে কোনো উত্তর নেই। কিন্তু আমি সরবে চিন্তা করতে পারি। হয়তো একটা কারণ, প্রথম আলো সংবাদপত্রের চেয়ে একটু বেশি। প্রথম আলো গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যুক্ত, প্রথম আলো ভাষা প্রতিযোগ করে, প্রথম আলো মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করে, প্রথম আলো অ্যাসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং দেশে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের হার কমেও গেছে। প্রথম আলো বর্ণমেলা করে। প্রথম আলো অদম্য মেধাবীদের বৃত্তি দেয়। প্রথম আলো সেরা বই পুরস্কার দেয়, বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ পুরস্কারের আয়োজন করে, সেরা তারকা নির্বাচনের আয়োজন করে এবং তারকাদের পুরস্কার দেয়। প্রথম আলো নারীদের কথা বলে, নারীদের মুখপত্র হয়ে ওঠে। প্রথম আলো কৃতী ছাত্রদের সংবর্ধনা দিয়েছে। প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে এবং গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, রাজনৈতিক আলোচ্যসূচি সামনে নিয়ে আসে। প্রথম আলোর নকশা বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপনকে সুন্দর করে তুলেছে, বর্ণিল করে তুলেছে। প্রথম আলো খেলার খবরে গুরুত্ব দেয়। প্রথম আলো সময়ের সঙ্গে থাকে, তারুণ্যের মুখপত্র হয়ে উঠতে চায়।

আসলে প্রথম আলো ১৯ বছরে একটা প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সঙ্গী হয়ে উঠেছে। ১৯ বছর আগে যে শিশুটির ছিল ১০ বছর বয়স, এখন সে ২৯। প্রথম আলো তার দিনযাপনের অংশ, অভ্যাসের সঙ্গী। সে হয়তো তখন গোল্লাছুট পড়ত, এখন খেলার খবর বেশি পড়ে।

প্রথম আলো এত বেশি চলে বলে প্রথম আলোর খবরে প্রতিক্রিয়াও হয় বেশি। ইতিবাচক অর্থে এবং নেতিবাচক অর্থে। প্রথম আলোয় কোনো খবর প্রকাশিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়। বিহিত হয়। সমস্যার সমাধান হয়। এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। আবার একই খবর পাঁচটা কাগজে প্রকাশিত হয়েছে, যা তীব্রভাবে সমালোচিত হচ্ছে, অন্য চারটা কাগজের কথা কেউ বলে না, সবাই সমালোচনা করে প্রথম আলোরই। প্রথম আলোর একটা কমা, একটা সেমিকোলনও পাঠকের চোখ এড়ায় না।

সারা পৃথিবীতে সংবাদমাধ্যমের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। কুড়ি বছর আগে আমরা কার্টুন দেখেছি, রিকশাওয়ালার হাতে, তরকারিওয়ালার হাতে মোবাইল ফোন। মানে, সেটা একটা হাসির বিষয় ছিল। এখন তো সবার হাতেই ফোন। এবং স্মার্টফোন। কাজেই আমরা জানি না ১০ বছর পরে স্মার্টফোন জিনিসটা কোথায় যাবে।

কিন্তু তিনটা মৌলিক প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে থাকবেই।

১. ঘরের কাছে যদি ঠাস করে বিকট একটা শব্দ হয়, মানুষ জানতে চাইবে, ওখানে কী ঘটল।

২. ঘটনাটা কী জানার পর মানুষ জানতে চাইবে, কেন ঘটল।

৩. ঘটনা ঘটে গেছে। কেন ঘটেছে, কীভাবে ঘটেছে, তা-ও আমরা জানি। তারপরও আমরা জানতে চাইব, এ বিষয়ে অমুকে কী বলে!
এই অমুকটা বিশেষজ্ঞ হতে পারেন, প্রিয় কোনো ব্যক্তিত্ব হতে পারেন। আবার সাকিব আল হাসান যখন বলেন, শিশির আমাকে বলেছিল, পারলে তুমিই পারবা, তখন কেউ যদি শিশিরের মন্তব্য প্রকাশ করে, তখন সেটাও আমরা পড়ি বা শুনি।

কিন্তু এরপরও একটা জিনিস আছে। মিডিয়াম ইজ দ্য মেসেজ। ভণিতা না করে সোজাসুজিই বলি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা জানতে চাই এ বিষয়ে প্রথম আলো কী বলছে। প্রথম আলো কি ওই ব্যক্তির ফটোগ্রাফ প্রকাশ করল নাকি কার্টুন প্রকাশ করল?

প্রথম আলো প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেই গুরুত্বটা অর্জন করেছে। তাই তো প্রথম আলো এক নম্বর। ভালোবাসা অর্জনের ক্ষেত্রেও এক নম্বর। আবার স্বার্থবাদীদের বিরাগভাজন হওয়ার বেলায়ও এক নম্বর।

অন্য ক্ষেত্রে সাধারণ পাঠকেরাও যে পান থেকে চুন খসামাত্রই প্রথম আলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেন, তা-ও প্রথম আলোর প্রতি তাঁদের প্রত্যাশা বেশি বলেই।

প্রথম আলোর ১৯ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমি এই আলোচনার সূত্রপাত করলাম। শুরু করলাম মাত্র। আপনারা সবাই যদি আলোচনায় অংশ নেন, তাহলে হয়তো সত্যি সত্যি কিছুটা আলো আমরা লাভ করব।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।