শিশুর সুশিক্ষা ও শিক্ষার পরিবেশ

আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে যেসব নেয়ামত দান করেছেন সুসন্তান তার মধ্যে অন্যতম। কোরআন মজিদে বর্ণিত হয়েছে: ‘আল্লাহ তোমাদের থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের যুগল থেকে তোমাদের জন্য পুত্র ও পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের উত্তম জীবনোপকরণ দিয়েছেন। (সুরা-১৬ নাহল, আয়াত: ৭২)।

শিশুরা পবিত্র ও নিষ্পাপ। শিশুরা মঙ্গলের কারণ, আনন্দের উপকরণ ও প্রেরণার উৎস। শিশু মানব জাতির অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই শিশুর সুশিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে ওঠার জন্য এবং তাদের মনন ও মেধার বিকাশের জন্য প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা। এ দায়িত্ব পিতা, মাতা, অভিভাবক, শিক্ষকসহ সমাজের প্রতিটি দায়িত্বশীল সচেতন নাগরিকের।

শিক্ষায় মেয়েশিশু ও ছেলেশিশু উভয়ের অধিকার রয়েছে

হাদিস শরিফে মহানবী (সা.) বলেন: (প্রয়োজনীয়) ইলম বা জ্ঞান শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর প্রতি ফরজ (অবশ্যপালনীয়) কর্তব্য। (ইবনে মাজাহ শরিফ)। হাদিসে আরও রয়েছে: যে ব্যক্তির তিনজন, দুজন বা একজন কন্যাসন্তান আছে; তিনি যদি তাদের বা তাকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করেন এবং সুপাত্রে পাত্রস্থ করেন, তাঁর জন্য জান্নাতের দরজাগুলো সর্বদা খোলা থাকে। (তিরমিজি শরিফ)।  মহানবী (সা.) ঘোষণা করেন: ‘যার রয়েছে কন্যাসন্তান, সে যদি তাকে (শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে) অবজ্ঞা ও অবহেলা না করে এবং পুত্রসন্তানকে তার ওপর প্রাধান্য না দেয়; আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ 

শিশুকে সুশিক্ষিত না করার কঠিন পরিণতি

শিশুর লালন-পালন ভরণপোষণ, নিরাপত্তা প্রদান ও সুশিক্ষিতকরণ পিতা, মাতা ও অভিভাবকের ওপর অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। কোনো শিশু যদি অভিভাবকের অবহেলার কারণে বিপথগামী হয়, তাহলে সে হাশরের দিনে আল্লাহর কাছে সেই অভিভাবকের বিরুদ্ধে নালিশ করবে: ‘হে আমাদের রব! আমরা আমাদের অভিভাবক ও বড়দের অনুসরণ করেছি, তারা আমাদের বিপথগামী করেছে। হে আমাদের প্রভু! আপনি তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং মহা অভিশাপ করুন।’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৬৭-৬৮)।

শিক্ষার বিষয়বস্তু

শিক্ষা মানে আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন বা মানবিক উন্নয়ন সাধন। অর্থাৎ শিশুর সুকুমারবৃত্তির বিকাশের প্রয়োজনীয় যথাযথ আয়োজন করা। এ জন্য প্রথমে মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা, ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় ভাষা এবং পর্যায়ক্রমে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান। যেমন: পরিবেশ, প্রকৃতি, পরিবার, সমাজ, বিশ্বসভ্যতা ও মানবতা ইত্যাদি। মূলত মনুষ্যত্ব বোধ জাগ্রত করাই শিক্ষা। সত্যের অনুভূতি শিক্ষার চূড়ান্ত পরিণতি। কোথা হতে এসেছি, কোথায় যাব, করণীয় কী? এসব বিষয় মাথায় রেখে বিশ্বাসের সঙ্গে সৃষ্টির কল্যাণে কর্তব্য-কর্ম সাধনই শিক্ষার সার্থকতা।

শিক্ষার লক্ষ্য ও লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষা

শিশুর ওপর কোনো কিছুই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। আমাদের সমাজে সন্তানের পিতা, মাতা বা অভিভাবক অনেকে সন্তান জন্মের আগেই অনাগত সন্তানদের নিয়ে নিয়ত তথা দৃঢ়সংকল্প করেন যে সন্তানকে হাফেজ, আলেম বা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি বিশেষ কিছু বানাবেন। ভালো কাজের জন্য নেক নিয়ত বা সদিচ্ছা থাকা ভালো। তবে এসব ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর হওয়া ঠিক নয়। অনেককে দেখা যায় তাঁর লক্ষ্য পূরণে শিশুর রুচি, প্রকৃতি, পছন্দ, ইচ্ছা এবং সামর্থ্যের বাইরে বোঝা চাপিয়ে দেন। আসলে আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সন্তানকে সৎ আদর্শবান ভালো মানুষ বানানো । দুনিয়াতে চলার জন্য আর্থিক উপার্জন প্রয়োজন হলে, সুযোগ ও সামর্থ্যমতো বৈধ সম্মানজনক সহজলভ্য যেকোনো পেশায় নিয়োজিত করা।

সন্তান জন্মের আগে বা পরে তাকে হাফেজ আলেম বা বিশেষ কিছু বানানোর নিয়ত করে থাকলেও; যদি তাতে সে অক্ষম বা অসমর্থ হয়, এতে অভিভাবক দায়ী থাকবেন না। বরং সে যা হতে পারবে তাকে তা-ই বানানো উচিত। এ দায়িত্ব অভিভাবকের; শিক্ষকের দায়িত্ব অভিভাবকদের বিষয়টি বোঝানো। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আল্লাহ কোনো সত্তাকে তার সামর্থ্যের অধিক কষ্ট দেন না।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৮৬)।

শিশুকে শিক্ষা চাপিয়ে দেওয়া ও শাস্তি

দেওয়া সামাজিক অপরাধ

আমাদের সমাজে অধিকাংশ শিশু শারীরিক শাস্তি ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। এটি পারিবারিক নেতিবাচক মূল্যবোধ থেকে সৃষ্ট ও সামাজিক নৈতিক ও অবক্ষয়ের কুফল। শিশুর পিতা, মাতা ও অভিভাবকেরা নিজেরা এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং তাঁরা শিক্ষকসহ অন্যদের এ বিষয়ে উৎসাহ প্রদান ও সহযোগিতা দান করে থাকেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

মাসুম (নিষ্পাপ) শিশুদের শাসনের নামে এমন শাস্তি প্রদান সম্পূর্ণ হারাম, যা তওবা করলেও ওই শিশু ক্ষমা না করলে মাফ হবে না। শিশুর পিতা, মাতা বা অভিভাবকের নির্দেশক্রমেও শিশুদের শারীরিক শাস্তি প্রদান জায়েজ নয়। কারণ, পিতা, মাতা বা অভিভাবক নিজেই তাঁর নিজের নাবালেগ সন্তানকে শাস্তিদানের অধিকার রাখেন না; সুতরাং তিনি অন্যকে এই অধিকার প্রদান করতে পারেন না। (ফাতাওয়ায়ে শামি, ফাতাওয়ায়ে আলাগিরি)।

 শিশুর জন্য চাই আনন্দঘন শিক্ষার

পরিবেশ ও আদর্শ শিক্ষক

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা ও আনন্দ-বিনোদনের আয়োজন থাকা উচিত। শুধু পাঠদান বা অধ্যয়ন ও পুস্তক মুখস্থ করার নামই শিক্ষা নয়। শিক্ষা হলো বিশ্বাস ধারণ, আশা লালন ও ভালোবাসা বিতরণের অনুরাগ সৃষ্টি করা। নৈতিক শিক্ষাই আসল শিক্ষা। সত্যতা, সততা, সহিষ্ণুতা, মানবিকতা ও পরোপকার হলো শিক্ষার দর্শন। এ জন্য প্রয়োজন আদর্শ অভিভাবক ও আদর্শ শিক্ষক।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।