মোবাশ্বারকে ফিরিয়ে দিন

মোবাশ্বার হাসান
মোবাশ্বার হাসান

আমরা শঙ্কিত! আমরা অসহায়!! আমরা হতাশ!!! এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত শিক্ষক ও গবেষক মোবাশ্বার হাসান সিজারের কোনো খোঁজ মেলেনি। এতে পরিবারের পাশাপাশি আমাদের উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বেড়েই চলেছে। মোবাশ্বার কেমন আছেন, কোথায় আছেন, তাঁকে কারা ও কেন নিয়ে গেছে, তার কোনো কিছুই আমরা জানি না। সরকারের পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য আসেনি। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কেবল আশ্বাসের পর আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। ফলে আমরা অসহায় ও হতাশ হয়ে পড়ছি। অজানা উত্কণ্ঠায় ভুগছি।

মোবাশ্বার আমাদের কারও প্রিয় ছাত্র, কারও কাছের বন্ধু, কারও সহকর্মী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। দেশের বাইরের সব সুবর্ণ সুযোগ পেছনে ফেলে শুধু দেশের টানে এবং দেশের সার্বিক কল্যাণে নিজের জ্ঞান ও মেধা কাজে লাগাবেন বলে তিনি ফিরে আসেন। যোগ দেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। অধ্যাপনার শুরু থেকেই তিনি মেধা আর যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। নিজেকে তৈরি করেছেন দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক এবং তুখোড় এক গবেষক হিসেবে। বিদ্যমান চিন্তাধারা, সামাজিক বাস্তবতা, রাজনীতি, ধর্ম প্রভৃতি বিষয় গবেষণার মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবং তা অনুধাবন করা ও করানোর এক সুশৃঙ্খল ও নির্দেশনামূলক রূপরেখা অনুসরণ করেছেন তিনি। ফলে তাঁর গবেষণার ফলাফল রাজনৈতিক পরিমণ্ডল—হোক তা রাজনীতির মাঠ কিংবা পাঠ—উভয় ক্ষেত্রেই হয়ে উঠেছিল সমান গুরুত্ববহ ও আলোচনার বিষয়।

আমরা শিউরে উঠেছি, যখন পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম, মোবাশ্বারের তাঁর গবেষণা ও লেখালেখির কারণে নিখোঁজ হয়ে থাকতে পারেন। এমনটাই ধারণা করছে তাঁর পরিবার। এ ছাড়া আর কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না পরিবারের সদস্যরা।

আমরা বলতে চাই, যদি পরিবারের অনুমানটিই ঠিক হয়, তাহলে যারাই কাজটি করুক, তারা আসলে দেশের সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি করছে। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ ও ভাবনার মধ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখার যে চর্চা, তাকে ফিকে করে দিতে চাইছে ‘নিখোঁজ কালচারের’ নেপথ্যের কারিগরেরা। 

আমাদের দেশে আগেও অনেকেই নিখোঁজ হয়েছেন। হাতে গোনা কয়েকজন ফিরে এসেছেন জীবিত কিংবা লাশ হয়ে। অনেকের হদিস নেই। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরিসংখ্যানমতে, বাংলাদেশে গত বছর মোট ৯০ জন ‘গুম’ হয়েছেন। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে নিখোঁজ হয়েছেন ৪২ জন (প্রথম আলো, ১০ নভেম্বর ২০১৭)। আর গত আড়াই মাসে সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, ছাত্রসহ নিখোঁজ হয়েছেন ৯ জন (প্রথম আলো, ৯ নভেম্বর, ২০১৭)। আমরা সম্প্রতি সাংবাদিক উত্পল দাসের নিখোঁজের ঘটনা জানি। তাঁর সন্ধানের দাবিতে তাঁর সহকর্মী, বন্ধু ও স্বজনেরা মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাঁর মা-বাবা ও স্বজনেরা অঝোরধারায় কেঁদেছেন। অথচ তাঁর খোঁজ মেলেনি। মা-বাবা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, কখন ফিরবে তাঁদের আদরের সন্তান।

এমনিভাবে অসহায় হয়ে অপেক্ষায় আছেন মোবাশ্বারের মা-বাবা। তাঁরাও জানেন না ছেলে কখন ফিরবে। ছেলের চিন্তায় অসুস্থ ও বেদনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তাঁরা। মোবাশ্বারের অবুঝ সন্তানটিও বাবার অপেক্ষায়। নিষ্পাপ এই শিশুর ধারণা, তাকে না বলে বাবা কোথাও চলে গেছেন। বাবার ওপর তাই বড্ড অভিমান। বাবা ফিরবেন, বাবাকে বকুনি দেবে, তারপর বাবাকে নিয়ে খেলনা কিনতে যাবে—এমন আশা নিয়ে বসে আছে শিশুটি। রাষ্ট্র কি এই শিশুর আকুতি শুনতে পাচ্ছে? আমরা এই শিশুর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। আমরা অসহায় হয়ে শিক্ষক, বন্ধু ও স্বজনেরা মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন করে আকুতি জানিয়েছি, কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট জবাব ও সুসংবাদ মেলেনি।

এমন হতাশার মধ্যে আরেকটি ঘটনা আমাদের যারপরনাই নিরাশ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানববন্ধনের পর গত মঙ্গলবার মোবাশ্বারের ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে মানববন্ধনের আয়োজন করেছিল। সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে, কর্তৃপক্ষের অনিচ্ছার কারণে ওই মানববন্ধন বাতিল করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ছিল, তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থা আছে, তাই ‘চিল্লাচিল্লি’ করে লাভ নেই। কর্তৃপক্ষের এমন বক্তব্য আমাদের লজ্জিত করেছে। কারণ, মানববন্ধন অনাস্থার প্রতীক নয়। মানববন্ধন কোনো বিষয় বা মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা এবং তা সমুন্নত রাখার দাবি সম্মিলিতভাবে প্রকাশের জন্য এক ক্ষুদ্র প্রয়াস। মানববন্ধন করতে না দেওয়ার মাধ্যমে আগামী দিনের প্রজন্ম এই শিক্ষার্থীদের কাছে কী বার্তা পৌঁছে দেওয়া হলো, তা ভাবতেই আমরা শিউরে উঠছি।

মোবাশ্বারের পরিবার ও স্বজনেরা যখন দুর্বিষহ মুহূর্ত কাটাচ্ছে, ঠিক তখনই কয়েকটি পত্রিকার প্রতিবেদন আমাদের চরমভাবে আহত ও ক্ষুব্ধ করেছে। বেনামি সূত্রের বরাত দিয়ে মোবাশ্বারের সঙ্গে ‘জঙ্গি কানেকশনের’ একটি অনুমাননির্ভর প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানোর এক অপচেষ্টা করা হয়েছে। মোবাশ্বারের পরিবার, বন্ধু ও খুব কাছের জনেরা এমন অভিযোগে হতবাক। এ ধরনের সংবাদ সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘনের পাশাপাশি একজন মানুষের নাগরিক অধিকারকে খর্ব ও আইনের শাসনের পথকে রুদ্ধ করেছে। আমরা এ ধরনের প্রতিবেদনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।

আমাদের বোঝা দরকার, এমন নিখোঁজ কালচারের মাধ্যমে আর যা-ই হোক, দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। অথচ নিখোঁজের সংখ্যা বাড়ছে, প্রবণতা বদলাচ্ছে। এর আওতা বাড়ছে। আতঙ্ক বাড়ছে। ভয়ের সংস্কৃতি বিস্তৃত হচ্ছে। এই অশুভ সংস্কৃতির মাধ্যমে জনমনে যে আতঙ্ক আর শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে, তা রাষ্ট্রের ওপর মানুষের আস্থা ও সংহতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

 তবু আমরা আস্থা হারাতে চাই না। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, অচিরেই আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন মোবাশ্বার। আমরা আবারও সরকারের কাছে আকুতি জানাতে চাই, অতি দ্রুত আমাদের প্রিয় মোবাশ্বারকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিন।

রোবায়েত ফেরদৌস, ফাহমিদুল হক, সেলিম রেজা নিউটন, আর রাজী, আ-আল মামুন, খ. আলম, শবনম আযীম, হাবিবা রহমান, সজীব সরকার, মাহবুবুল হক ভূঁইয়া, শেখ শফিউল ইসলাম ও কাজী আনিছ
লেখকেরা বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগের শিক্ষক।