সামরিক অভ্যুত্থানে স্থিতিশীলতা আসবে না

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

হারারের মধ্যাঞ্চলের সামোরা ম্যাচেল অ্যাভিনিউয়ে বড় বড় সামরিক ট্যাঙ্ক সশব্দে ছুটে যাওয়া যানবাহনের চাঞ্চল্য থামিয়ে দিয়েছে, রাস্তার দোকানগুলোতেও প্রাণচাঞ্চল্য নেই। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, জিম্বাবুয়ে ব্রডকাস্টিং করপোরেশন সেনাদের দখলে। এই অভ্যুত্থানে সাংসদ, গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে অন্তরীণ করা হয়েছে, পুলিশের দপ্তর অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। রেডিও আর টেলিভিশনে যুদ্ধকালীন গান পরিবেশন করা হচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে সেনাদের অতীত ‘শক্তিমত্তা’ ও ‘বিজয়ের’ প্রতি রহস্যজনক অভিবাদন জানানো হচ্ছে।

প্রেসিডেন্টের কাছের ‘অপরাধীদের মূলোৎপাটন’ এবং দেশটির সংবিধানের ২১২ নম্বর ধারা অনুসারে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হলে সেনাবাহিনী ‘জিম্বাবুয়ের জনগণ, জাতীয় নিরাপত্তা, স্বার্থ, ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা এবং সংবিধান সমুন্নত রাখতে’ হস্তক্ষেপ করতে পারবে। কিন্তু যখন সেনাবাহিনীর স্বার্থ লঙ্ঘিত হলো, তখনই তারা এই হস্তক্ষেপ করল। দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল কনস্টাতিনো চিয়েংগার বক্তৃতায় বিষয়টি পরিষ্কার। তিনি বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীকে খাটো করে রাজনীতিকদের অপরিণামদর্শী বক্তব্য নিচের সারির সেনাদের শঙ্কিত ও নৈরাশ্যবাদী করে তুলছিল... আর দলটির মধ্যে যাঁরা স্বাধীনতাসংগ্রামে জড়িত ছিলেন, সুনির্দিষ্টভাবে তাঁদের বিতাড়ন করার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।’

জিম্বাবুয়ের রাজনীতিকেরা উন্মত্তভাবে পরিচিত মানুষদের খুদে বার্তা পাঠিয়ে ঘটনাপ্রবাহের ব্যাপারে সর্বশেষ গোয়েন্দা তথ্য জানার চেষ্টা করছেন। অন্যরা রেডিওতে কান পেতে নানা গুজব শুনছেন। আর জনগণের বড় একটি অংশ প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের পতনে উল্লাস করছে। দেশটির রাজনৈতিক কর্মী তিনাশ বলেছেন, ‘মাঠে-ঘাটে মানুষ মুগাবের পরিবারতন্ত্র ও জুলুমের বিরুদ্ধে বিজয় উদ্‌যাপন করছে। মানুষ বিদ্রোহ করবে, এমন সম্ভাবনা নেই।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘জিম্বাবুয়ের মানুষ মুগাবে ছাড়া আর যে কারও জমানায় খুশিমনে থাকবে, তা সে সামরিক বা বেসামরিক যা-ই হোক না কেন।’

সাংবাদিক ও আফ্রিকাবিষয়ক বিশ্লেষক আইজাক খোমো অভ্যুত্থান সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলেছেন। তাঁর ভাষ্য, ক্ষমতাসীন জানু-পিএফ দলের অভ্যন্তরীণ বিভেদের কারণে এটি ঘটেছে। দলটি এখন এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠবে, এমন সম্ভাবনাও নেই। দলটির ভেতরে যে অনেক দিন ধরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই ধসের ব্যাপারে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।

তবে সামরিক বাহিনী দেশটির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করবে, এটা আশা করা বিস্ময়কর। জিম্বাবুয়ের এই ঘটনাপ্রবাহের ওপর সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে নিউজরুম টুইটার পাঠকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছে, ‘সামরিক বাহিনী কি জিম্বাবুয়েতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারবে?’ যে হাজারখানেক মানুষ এই জরিপে অংশ নিয়েছিলেন, তার মধ্যে ৭০ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ বলেছেন। এটা জিম্বাবুয়ের জনগণের মতামতের প্রতিফলন না হলেও আমাদের বিবেচনা করতে হবে, সামরিক অভ্যুত্থান বলতে কী বোঝায়, এটা অভ্যুত্থান কি না, তা নিয়ে বিতর্ক করা নয়। জিম্বাবুয়ের অনেক নাগরিকই ‘বাবা’ মুগাবের নির্মম শাসনের অবসান চেয়েছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁদের কাছে মনে হয়েছে, সামরিক বাহিনীই কাজটা করতে পারে।

এখন কথা হলো, সামরিক হস্তক্ষেপ ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা’ আনতে পারে কি না, সেটা অনিশ্চিত। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে এখনই চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ দেওয়া ঠিক হবে না। তা সত্ত্বেও কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে আমাদের অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা উচিত, আমরা কি অভ্যুত্থান সম্পর্কে সঠিক বিবেচনাটা করছি? ইতিহাস বলে, সামরিক অভ্যুত্থান কীভাবে মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত পরিণতি বয়ে আনতে পারে। বিখ্যাত অভ্যুত্থানগুলোর মধ্যে ১৭৯৯ সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের অভ্যুত্থানের কথা বলা যায়, যেটা কার্যত ফরাসি বিপ্লবের বিজয়রথ ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ ছাড়া নাইজেরিয়ার ১৯৬৬, ১৯৭৫, ১৯৮৩, ১৯৮৫, ১৯৯০ ও ১৯৯৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, অভ্যুত্থান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারে, এমন ধারণা ভুল।

যেসব সামরিক অভ্যুত্থানে জনতার অংশগ্রহণ ও মত ছিল না, সেসব অভ্যুত্থানে নিপীড়িত জনতার মুক্তি এসেছে—এমন ঘটনা খুব একটা দেখা যায় না। রাশিয়াতে ১৯১৭ সালের অভ্যুত্থান (অক্টোবর বিপ্লব—অনুবাদক) সফল হয়েছিল, কারণ তার সঙ্গে প্রতিবাদী জনতার যুক্ততা এবং মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। সঙ্গে ছিল খুবই প্রয়োজনীয় সামরিক সমর্থন।

অনেকেই এসব সামরিক ভাষ্য শুনতে অভ্যস্ত। জিম্বাবুয়ের রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও দীর্ঘকালের কর্মী পিসাই মুচাওরায়া বলেছেন, ‘অন্য দেশ যাতে তাদের (সামরিক বাহিনী—অনুবাদক) দোষারোপ করতে না পারে, সে জন্য তারাও সহিংসতায় না জড়িয়ে এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চৌকস হওয়ার চেষ্টা করছে...এটা রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান।’ তিনি আরও বলেছেন, সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে না। ক্ষমতাবান চক্রের কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান হবে এবং জাতির সম্পদে কারা বেশি ভাগ বসাবে, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেটা নির্ধারিত হয়।

ব্যাপারটা অন্ধের হাতি দেখার মতো, প্রত্যেক অন্ধ ব্যক্তি যেমন হাতির একটি অঙ্গ ধরে মনে করেছিল, হাতিটা এমন; আমাদের অবস্থাও এখন তেমনই। তবে ভুল করবেন না, সব অন্ধের কাছেই হাতি এক বিশাল স্তন্যপায়ী। ব্যাপারটা হলো, জিম্বাবুয়েতে শাসকগোষ্ঠীর একটি চক্র নানা কারণে অসন্তুষ্ট হয়ে নিজেদের একাধিপত্য বিস্তার করেছে। এতে এই সমাজের মৌলিকভাবে নিপীড়নমূলক ও অনুদার কাঠামোটা বদলে যাবে না। দেশটির মানুষের এ ব্যাপারে একমত হতে হবে, তা না হলে পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে। মুগাবেকে হটানোর মধ্য দিয়ে কোন কোন অর্গল খুলে যায়, সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তবে সামরিক জমানা আসার সঙ্গে যে ধরপাকড় হবে, সেটা ভুলে থাকলে চলবে না।

দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাভারিক ডট কো থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

মিকায়েলা নোনদো এর্সকগ: উগান্ডা–ভিত্তিক প্যান আফ্রিকা টুডের গবেষক।