বিজ্ঞাপনচিত্রের নারী-পুরুষদের কাজ-অকাজ

অলংকরণ: তুলি    প্রথম আলো
অলংকরণ: তুলি প্রথম আলো

প্রায় দুই মাস পর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বসেছি টেলিভিশন সেটের সামনে। উদ্দেশ্য বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল উপভোগ করা। ইদানীং আমি বাচ্চাদের সঙ্গে বসে দেখতে দেখতে অনেকটাই আসক্ত হয়ে পড়েছি কার্টুনে। আর বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান এতটাই গতানুগতিক যে মাঝেমধ্যে মনে হয়, এর চেয়ে রন্ধনকর্ম সম্পাদন করাও বুঝি অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় ও বিনোদনমূলক। কারণ, সেখানে অন্তত সৃষ্টির অবাধ স্বাধীনতা আমার থাকছে। নিজের ইচ্ছেমতো টিভি চ্যানেল দেখতে না পারা নিয়ে তাই তেমন কোনো আপত্তিও নেই আমার মধ্যে। 


সন্ধ্যা সাতটার কাছাকাছি সময়ে বসে গেলাম টিভি সেটের সামনে। দেখলাম, প্রায় প্রতিটি চ্যানেলে শুরু হয়েছে সংবাদ সম্প্রচারের ব্যাপক তোড়জোড়। প্রতিটি চ্যানেলে বিজ্ঞাপনচিত্রের উপর্যুপরি উপস্থিতি নিউজ আওয়ারের আগমনবার্তা নিশ্চিত করছে। কয়েকটি চ্যানেল পরিবর্তনের পর সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার মনপ্রাণ উজাড় করে নাহয় বিজ্ঞাপনই দেখি। এখান থেকেই নাহয় খুঁজে নেব বিনোদন। কিছুক্ষণ পর বেরসিকভাবে বিজ্ঞাপনের রথ থামিয়ে আরম্ভ হলো সংবাদ। কিন্তু বেশিক্ষণ যেতে পারল না! বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে সংবাদের পরিবেশন জানিয়ে দিল, ‘আমি বন্দী বিজ্ঞাপনের কারাগারে!’

বিজ্ঞাপনের সেই প্রদর্শনীতে দেখলাম অনেক সংযোজন-বিয়োজন ঘটেছে। কিন্তু বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি বিজ্ঞাপনচিত্রে নারী ও পুরুষকে উপস্থাপনের চিরাচরিত ছকে বাঁধা ধারার। এসব বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়, নারী সর্বদাই সুন্দরী হতে চান আর পুরুষ চান শক্তিশালী, সাহসী আর অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হতে। নারীরা শুধু মেখেই চলেছেন রং ফরসাকারী ক্রিম আর চুল লম্বা হওয়ার তেল কিংবা শ্যাম্পু। যেন ধরেই নেওয়া হয়েছে, এর বাইরে নারী-পুরুষের আর কোনো চাওয়া নেই। এই যে নানা রকম পণ্য সেবন, জানি না কবে তাঁরা এই সমস্ত মহৌষধের সুফল পাওয়া শুরু করবেন! ইদানীং ছেলেদের জন্য রং ফরসাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপনও চোখে পড়ছে। কিন্তু নারীদের জন্য ব্যবহৃত ক্রিমের প্রচারাধিক্যের ভিড়ে ছেলেদের ব্যবহৃত ক্রিমের প্রচার তেমন একটা চোখে পড়ে না। অন্যদিকে বাসায়, অফিসে, রাস্তাঘাটে সর্বত্র ক্রমহ্রাসমান চুলের পুরুষদের চোখে পড়লেও বিজ্ঞাপনে পুরুষের চুল নয়, নারীর চুল পড়াই জাতীয় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত। টেলিভিশন দেখলে মনে হবে, এই সমস্যা নিয়ে মেয়েরা যতটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, ছেলেরা ততটা নন। এই সমস্ত বিজ্ঞাপনচিত্রের কোনোটিতে কোনো পুরুষকে দেখিনি চুল পড়া সমস্যা সমাধানের মহৌষধ খুঁজতে। অথচ একমাথা দিঘল কালো আকর্ষণীয় কেশ নিয়ে নারীরা কী অবলীলায় বলে চলেছেন চুল পড়া নিয়ে তাঁদের দুশ্চিন্তার¯কথা!

ওদিকে বিজ্ঞাপনের পুরুষেরা অর্থ লেনদেনসংক্রান্ত যাবতীয় ভূমিকায় নারীর চেয়ে এগিয়ে। খেলার মাঠে শক্তি-সামর্থ্য প্রদর্শনে, স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য নিরাপদ পানি, শক্তিবর্ধক হেলথ ড্রিংক, দুধ বা এ ধরনের অধিকাংশ পণ্যের বিজ্ঞাপনে লক্ষ করা যায় পুরুষের সগৌরব উপস্থিতি। নারীরা ব্যস্ত বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া, বাথরুম পরিষ্কার, রান্নাবান্না ইত্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পণ্যের প্রচারে। অথচ বাস্তবে অনেক নারীই সংসারে আয়-ব্যয়ে ভূমিকা রাখেন, অনেক পুরুষও আজকাল সন্তান দেখাশোনাসহ আরও অনেক গেরস্থালি কাজে হাত লাগান। কিন্তু অধিকাংশ বিজ্ঞাপনের জগতে নারী ও পুরুষ সনাতন শ্রমবিভাজনের খোপেই যেন আটকা।

আজ পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞাপনচিত্রে শিশুর ডায়াপার পরিবর্তনের দৃশ্যে পুরুষের উপস্থিতি চোখে পড়েনি। সংসার সামলানো, বাচ্চার দেখাশোনা, চা-বিস্কুট খাইয়ে কিংবা রান্না করে শাশুড়ির মন জোগানোর যাবতীয় দৃশ্যে মডেল হয়েছেন নারীরা। হাস্যকরভাবে নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে কাপড় যথাযথভাবে পরিষ্কার করতে পারার আনন্দ প্রকাশে। যেন এটাই নারীর আত্মবিশ্বাস অর্জন, ক্ষমতায়ন এবং পুরুষের প্রিয় হওয়ার একমাত্র পদ্ধতি। অন্যদিকে, নারীর হাতে ধোয়া কাপড় পরে পুরুষ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তীর্ণ হচ্ছেন চাকরির ইন্টারভিউতে কিংবা সুযোগ পাচ্ছেন টিমে খেলার। পুরুষেরা উৎপাদনমূলক কাজে সম্পৃক্ত হয়েছেন আর নারীরা যথারীতি পুনরুৎপাদনমূলক কাজে। পুরুষের ও নারীকে কাজ-অকাজের বিভাজনে ভাগ করা কি বৈষম্যমূলক নয়?

একই বিভাজন বিজ্ঞাপনের শিশুদের জগতেও। কন্যাশিশুরা বারবারই পুতুল হাতে হাজির হয়েছে কিংবা তাকে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে রান্নাবান্না খেলায়। অন্যদিকে, ছেলেশিশুটি তার অভিভাবকদের চমৎকৃত করছে তার উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।

আমরা এখন বসবাস করছি এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে, যেখানে নারীরা ব্যাপক হারে বাইরে বেরিয়ে আসছেন জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে। আজ নারী তাঁর ঘরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের পাশাপাশি কাঁধে নিচ্ছেন অর্থ উপার্জনের মতো গুরুদায়িত্ব। শুধু এখনই কেন, সাবেক যুগেও কি নারী সংসার সামলানোর পুরোটার পাশাপাশি পরিবারের কৃষি ও উৎপাদনমূলক কাজের কখনো অর্ধেক, কখনো সিকিভাগের দায়িত্ব পালন করে আসেননি? পরিবারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং দেখাশোনা সম্পন্ন না হলে, পরিবারের পুরুষেরা কি তাঁদের অর্থনৈতিক কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারতেন? তা ছাড়া দেখুন, বাংলাদেশের নারীরা দেখিয়ে দিয়েছেন, দেশ পরিচালনা কিংবা পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া জয় করা—কোনোটাই তাঁর জন্য অসম্ভব নয়। তাই আজকের বাস্তবতায় পণ্যের বিজ্ঞাপনচিত্রে নারী-পুরুষের শ্রমবিভাজনের এই পশ্চাৎপদ উপস্থাপন চিরাচরিত পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতাকেই উৎসাহিত করছে।

এমনিতেই নারীরা ঘরের ভেতরের এবং বাইরের কাজের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তার ওপর পণ্যের বিজ্ঞাপনচিত্রে নারী-পুরুষের কাজের পরিধিকে যদি বৃত্তের মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয় কিংবা নারীদের কেবল তথাকথিত ‘মেয়েলি’ কাজেরই যোগ্য এবং সেসবে পারদর্শিতাই যদি তাঁদের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে দেখানো হয়, তাহলে সমাজ এগোবে কী করে? নারী-পুরুষের গুণাবলিকে যদি পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা দিয়ে উপস্থাপন করা হয়, তবে নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রযাত্রা নিশ্চিতভাবেই বাধাগ্রস্ত হয়। আর যা-ই হোক, এভাবে দেখানো নারীর জন্য মর্যাদাপূর্ণ বিষয় নয়।

এসব বিজ্ঞাপনচিত্রে যে শিল্পীরা কাজ করেন, তাঁদের অনেকেরই তারকাখ্যাতি আছে। তাঁদের একটি কথা কিংবা একটি আচরণ যত তাড়াতাড়ি সাধারণ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সারা বছরের লিঙ্গসমতা আনয়নের প্রচেষ্টাও সেই গ্রহণযোগ্যতা এনে দিতে পারে না। তাই সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের প্রতি সমব্যথী হওয়া প্রয়োজন। যেকোনো পণ্যের মডেল হিসেবে নিজেদের উপস্থাপনের আগে একটিবারের জন্য হলেও তার সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটি তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমরা কি পারি না এমন বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করতে, যেখানে ঘরে ও বাইরে, গৃহস্থালি ও প্রাতিষ্ঠানিক সকল কাজে পুরুষেরা নারীর সহযোদ্ধা হিসেবে আবির্ভূত হবেন! পুরুষেরাও বদলে দেবেন শিশুর ডায়াপার, শিশুর টিফিন বক্স ভরে দেবেন তার ব্যাগে, শিশুকে বানিয়ে খাওয়াবেন মজাদার খাবার কিংবা পুষ্টিকর হেলথ ড্রিংক? পুরুষ পার্টি আমেজে শুধু একটি দিন রান্না করে স্ত্রীকে চমৎকৃত করবেন না, বরং তিনি উপস্থাপিত হবেন রান্নাঘরে নারীর নির্ভরতার উৎস হিসেবে! নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে চাই পণ্যের নির্মাতা ও বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠান এবং একই সঙ্গে বিজ্ঞাপনচিত্রের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সুবিবেচক আচরণ।

(লেখায় ব্যক্ত মতামত লেখকের নিজস্ব)

নিশাত সুলতানা: কর্মসূচি সমন্বয়ক, জেন্ডার জাস্টিস ডাইভার্সিটি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক