পাহাড়ি অঞ্চলে রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না

আফ্রাসিয়াব খটক
আফ্রাসিয়াব খটক

পাকিস্তানের দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের মাসুদ অঞ্চলে অঘোষিত সামরিক অভিযান সম্পর্কে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে টুকরো টুকরো খবর পাওয়া গেছে। কারণ, সরকার এ ব্যাপারে প্রথম দিকে ঢাক ঢাক গুড় গুড় করেছে। ওই অঞ্চলের শাবি খেল আদিবাসী গোষ্ঠীর ১ হাজার ১০০ পরিবারসহ আরও কিছু গোষ্ঠীর মানুষকে ৩ নভেম্বর অত্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়। ফলে খবরটি ধামাচাপ দেওয়া সম্ভব হয়নিপার্বত্য অঞ্চলের হাজার হাজার নারী-পুরুষকে দুই দিন ধরে হেঁটে বান্নু জেলার বাকাখেল অঞ্চলের দিকে চলে যেতে হয়েছে।

২০১৪ সালে উত্তর ওয়াজিরিস্তানের জর্ব-ই-আজব অভিযানের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য যে শিবির বানানো হয়েছিল, তাদের সেখানে যেতে হয়েছে। অথচ ডুরান্ড লাইন থেকে শাবিখেল মাসুদ অঞ্চলের দূরত্ব যথেষ্ট। তাহলে হঠাৎ এই অঞ্চলের হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হলো কেন?

শরণাগত মানুষ হলেও তাদের সঙ্গে যুদ্ধবন্দীদের মতো আচরণ করা হয়েছে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের মানুষকে এই শিবিরে যেতে দেওয়া হয়নি। ফেডারেলি অ্যাডমিনিস্টার্ড ট্রাইবাল এরিয়ার সচিবালয় ও গভর্নর হাউস প্রাথমিকভাবে এ ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকলেও তারা গাঁইগুঁই করে শেষমেশ ‘দুই শতাধিক মাসুদ’ পরিবারকে গ্রহণ করে নিয়েছে। গত ১৫ বছরে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় সামরিক অভিযান হওয়া সত্ত্বেও এই ফেডারেলি অ্যাডমিনিস্টার্ড ট্রাইবাল এরিয়া এখনো যেন এক কৃষ্ণগহ্বর। সেখানে অভিযানের সময় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকলেও এসবের তদন্ত হয়নি। সেখানে যেসব সামরিক অভিযান হয়েছে, তার ওপর বেসামরিক কর্তৃপক্ষের নজরদারি ছিল না।

চলমান বছরে ওই অঞ্চল থেকে বৈপরীত্যমূলক ও বিভ্রান্তিকর খবর আসছে। একদিকে এই ফেডারেলি অ্যাডমিনিস্টার্ড ট্রাইবাল এরিয়ার সংশোধনীর জন্য যেমন সংসদে সংবিধান সংশোধনীর বিল আনা হয়েছে, অন্যদিকে ওই অঞ্চলে বেশ কিছু সন্ত্রাসী হামলা ও সামরিক অভিযানও হয়েছে।

খাইবার চার অভিযান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ ওই অভিযানে ভারী অস্ত্র ও বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। খাইবার এজেন্সি থেকে তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে যুক্ত সন্ত্রাসীদের তাড়াতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। বস্তুত আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে আইএসের যে যোদ্ধারা আছে, তারা ছিল মূলত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) যোদ্ধা। পাকিস্তানে এখনো তাদের যোগাযোগ আছে। আফগান তালেবানদের পাকিস্তানি পরামর্শদাতারা টিটিপি ও আফগান তালেবানদের মধ্যে পার্থক্য খোঁজার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো এরা মূলত একই মুদ্রার দুই পিঠ। টিটিপির যোদ্ধারা সব সময় আফগান তালেবানদের সব নতুন আমিরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। আর আফগান কমরেডদের সমর্থন ছাড়া তাদের পক্ষে আফগান সীমান্তে ঘাঁটি করা সম্ভব হতো না।

ওদিকে বাজুর মুমান্দ ও ওয়াজিরিস্তান থেকেও সংঘাতের খবর আসছে। এসব এলাকায় সরকার হরহামেশাই কারফিউ জারি করত। উত্তর ওয়াজিরিস্তানে বহুকাল ধরে রোববার কারফিউ দেওয়া হয়েছে। আগে যারা বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই ঘরে ফেরার চেষ্টা করছে, যেখানে নতুন নতুন যুদ্ধে আরও অনেকেই গৃহচ্যুত হচ্ছে।

দুর্ভাগ্যবশত এগুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে কেবল তথ্য ছাড়া কিছু নয়। মিরান শাহের পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে, এটা দেখানোর জন্য কর্তৃপক্ষ যে সেখানে বড় এক ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করল, সেটা কি উদ্ভট নয়? আইএসের পদচিহ্ন কি স্বাভাবিকতার লক্ষণ?

দেশটির নিরাপত্তাকাঠামো যত দিন আফগান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তালেবানদের যুদ্ধ সমর্থন করবে, তত দিন তারা এই ফেডারেলি অ্যাডমিনিস্টার্ড ট্রাইবাল এরিয়াকে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করবে। পাকিস্তানের আফগান নীতি পরিবর্তন না করলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না, যা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে দেশটির নিরাপত্তা মহল।

গত কয়েক বছরে পাকিস্তানের যে শত শত কোটি ডলার বিদেশি সাহায্য এসেছে, সেটা যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের পুনর্গঠন এবং ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে। তারপরও সেখানকার দারিদ্র্য পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি। ২০১৬ সালে পাকিস্তানের প্ল্যানিং কমিশন যেসব তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, পাকিস্তানে সামগ্রিকভাবে ৪০ শতাংশ নাগরিক দরিদ্র, যেখানে এই অঞ্চলে তা ৭৩ দশমিক ৭ শতাংশ।

এই সংখ্যাটা এখন বাড়ছে। কারণ, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তোরখাম ও স্পিন বোলডাক অঞ্চলের ঘন ঘন অবরোধ এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাওয়ার কারণে সীমান্ত অঞ্চলের সাত লাখ পরিবার আক্রান্ত হতে পারে। কেউ এটা বিবেচনা করছে না যে আফগানিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য কমে গেলে পাকিস্তানের অর্থনীতি ও বিশেষ করে পশতুন অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে।

কথা হচ্ছে আফগানিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা কমে গেলে বাস্তবে সেখানে মাদক ও অস্ত্রের ব্যবসা ছাড়া কিছু থাকবে না, যে কারণে নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসবাদের বাড়বাড়ন্ত হবে। ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা কি বিপর্যয় ডেকে আনবে না? কিন্তু নীতি যখন এমন হয় যে বড় খেলার জন্য কৌশলগতভাবে জায়গা ব্যবহার করা এবং লাখো পশতু নাগরিকের ভাগ্যের থোড়াই কেয়ার করা, তখন আর কী হবে।

এমনকি তা সত্ত্বেও পাঞ্জাবি বেসামরিক ও সামরিক আমলাতন্ত্রের ক্ষীণ দৃষ্টি বিস্ময়কর। পাখতুনখাওয়ায় রোমাঞ্চকর নীতির কারণে যতবার নরক নেমে এসেছে, ততবার সেটা পাঞ্জাব ও পাকিস্তানের বাকি অংশেও ছড়িয়ে পড়েছে। আর এবার সেটা অতটা ভিন্ন না-ও হতে পারে।

দ্য নেশন ডট কম থেকে নেওয়া, অনুবাদ:  প্রতীক বর্ধন।

আফ্রাসিয়াব খটক: পাকিস্তানের আঞ্চলিক রাজনীতি বিশ্লেষক।