উন্নয়ন ও সুশাসন আলাদা কিছু নয়

এক–একজন জীবন্ত মানুষ উধাও হয়ে যাচ্ছেন, হয় প্রাণহীন দেহ পড়ে থাকছে কোথাও অথবা তার কোনো চিহ্নই থাকছে না। এই রাষ্ট্রেরই নাগরিক তাঁরা। সর্বজনের টাকায় রাষ্ট্র চলে, তার শানশওকত বাড়ে। সেই রাষ্ট্র চালায় যে সরকার, তারা এসব নিয়ে তামাশা করে, মিথ্যা কথা বলে, চুপ করিয়ে দেয়, পাগল বানায়। প্রতিবাদের ওপর চড়াও হয়।

প্রায় প্রতিদিন গুম, খুন, ধর্ষণ, প্রশ্নফাঁস/ জালিয়াতি/পরীক্ষা কেলেঙ্কারি, ব্যাংক দখল, ঋণখেলাপিদের দাপট, ক্রসফায়ার নামের বিচারবহির্ভূত খুন, বন উজাড়, নদী দখল/দূষণ খবরে সমাজের মগজে চিন্তায় ময়লার স্তূপ জমে সক্রিয়তা লোপ পেতে থাকে। সমাজের চৈতন্য ভোঁতা করে দেওয়া, প্রত্যাশার মাত্রা ক্রমেই নামিয়ে আনা সরকারের একটা বড় সাফল্যই বটে। গণমাধ্যম সব সময় ইতিবাচক খবর দিতে চায়। কী সেগুলো? সাফল্যে একের পর এক পুরস্কার, সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর বাহারি অভিযান, সব খারাপ খবর সম্পর্কে কর্তা-মন্ত্রীদের অস্বীকৃতি আর নতুন নতুন প্রতিশ্রুতি। কর্তাদের চোখেমুখে আনন্দ আর উল্লাস। সাফল্যের প্রচারে টিভি, পত্রিকা, সড়ক-মহাসড়ক সয়লাব হয়, আনন্দের বাদ্যবাজনা বাজতে থাকে। তার নিচে আমাদের প্রতিদিনের দুর্ভোগ, ক্ষোভ, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, সন্তান-স্বজন হারানো মানুষের কান্না, বন-নদী-হাওরের দীর্ঘশ্বাস, দেশের আসন্ন বিপদ নিয়ে অস্থিরতা চাপা পড়ে যায়।

সরকারের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত বিজয়ের সুর। এই বিজয় চিরস্থায়ী এবং অপ্রতিরোধ্য এ রকম একটি ভাব থেকে তৈরি হয়েছে অতি-আত্মবিশ্বাস। সেখান থেকে এসেছে বেপরোয়া এবং থোড়াই কেয়ার মনোভঙ্গি। বিদেশি বৃহৎ ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো তাদের চাহিদা পূরণ হওয়ায় খুশি, দেশের ভেতর ক্ষমতার নানা কেন্দ্র নিজ নিজ চাহিদার চেয়ে বেশি পেয়ে খুশি। সরকারের তাই এ রকম ধারণা হয়েছে যে তার আর জবাবদিহির কোনো দরকার নেই। যা খুশি তা–ই করলে কোনো কিছু যায়-আসে না।

দেশে গত প্রায় এক দশকে, আইয়ুব ও এরশাদের পর, তৃতীয় উন্নয়ন দশকের চাপে আছি আমরা। প্রবৃদ্ধি খুব ভালো। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে বিস্তর। সবকিছুই এখন ব্যবসার অন্তর্গত। শিক্ষা-চিকিৎসাও দ্রুত সম্প্রসারণকালীন বাণিজ্যিক খাত। নির্মাণ খাত সবচেয়ে গতিশীল। গ্রাম, গঞ্জ, শহর, বন্দর, খাল, বিল, কৃষিজমি সর্বত্রই নির্মাণের উৎসব। ইটভাটা অসংখ্য, বৈধ যত তার চেয়ে অবৈধের সংখ্যা বেশি। সিমেন্ট কারখানার সংখ্যাও বেড়েছে। শীতলক্ষ্যাসহ বিভিন্ন নদীর বাতাসে-পানিতে এর প্রবল ছোঁয়া পাওয়া যায়। দূষণ রোধের কোনো ব্যবস্থা কাজ করে না। রডের উৎপাদন বেড়েছে। নিয়ম মেনে বা না মেনে বালু তোলার পরিমাণ বেড়েছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ফার্নিচারের ব্যবসাও বেড়েছে। এর জন্য বনের গাছের ব্যবসা ভালো। দেশে নির্বিচারে বন-জঙ্গল উজাড় করায় প্রশাসন বরাবর সক্রিয় সহযোগী। সরকারি তথ্যই বলছে, ‘দেশে সবচেয়ে বেশি বন উজাড় হয়েছে উচ্চ প্রবৃদ্ধির এই এক দশকেই। ...শুধু গাজীপুরেই এক দশকে ধ্বংস হয়েছে প্রায় ৭৯ শতাংশ বনাঞ্চল।’ (বণিক বার্তা, নভেম্বর ৪, ২০১৭)

নির্মাণকাজে সরকার যেসব বৃহৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তার আকার ও বরাদ্দ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এসব প্রকল্পে ব্যয় বরাদ্দের কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই, এর যৌক্তিক বিন্যাসেরও কোনো ব্যবস্থা নেই, যৌক্তিকতা বিচারের কোনো স্বাধীন প্রতিষ্ঠানও আর কার্যকর নেই। তার ফলে এগুলোর ব্যয় অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় দু-তিন গুণ বেশি হলেও সরকার তা নিয়ে কোনোভাবেই বিচলিত নয়। বরং সরকারি অনুমোদন নিয়েই এগুলোর ব্যয় শনৈঃ শনৈঃ বেড়ে যাচ্ছে। সরকার নিয়মনীতি অমান্য করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানিকে উচ্চমূল্যে কাজ দিচ্ছে, আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য ২০১০ সাল থেকে সরকার চলছে ‘দায়মুক্তি আইন’ ঢাল দিয়ে, নানা সুবিধা ছাড়াও ভয়াবহ দুর্ঘটনার ক্ষতির দায় থেকে বাঁচানোর জন্য দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিকেও (রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প দ্রষ্টব্য)।

দেশের আইনকে তুড়ি মেরে বন উজাড় করে ভবন ও কারখানা হচ্ছে, নদী দখল করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে। সর্বজনের বন, নদী, খাল, উন্মুক্ত স্থান কিছু ব্যক্তির ব্যবসায়িক কাজে দখল কার্যক্রমে যাচ্ছে। সরকারের সব প্রতিষ্ঠান এসবে বাধা দিতে অনিচ্ছুক। রাজধানীতে সরকারি কেন্দ্রের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে নদী, খাল, বিল দখলের চিত্র দেখায় যে সরকার এর অনুমোদক। সমাজে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আছে। কিন্তু সরকার প্রতিবাদ দমনে সক্রিয় আর সমস্যা নিয়ে নির্লিপ্ত।

সরকারের নির্লিপ্ততা আরও বহু ক্ষেত্রে। অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ পানি নেমে যাচ্ছে। প্রতিবছর বহু হাজার কোটি টাকা মেরামত বাবদ বরাদ্দ থাকলেও সারা দেশে প্রায় সর্বত্রই রাস্তার অবস্থা খারাপ। সরকার বরাদ্দ দিচ্ছে, কিন্তু টাকা কোথায় যাচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই। প্রতিদিন জনগণের দুর্ভোগ, ক্ষোভ কোনো কিছুই সরকারকে স্পর্শ করে না। কেননা তাদের ধারণা, এতে তাদের ক্ষমতার কিছু আসে-যায় না।

নির্মাণ ছাড়া সরকারের প্রশাসনের আরেকটি আগ্রহ কেনাকাটায়। যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে, কাজ নেই; বাস কেনা হচ্ছে, কিছুদিন পরই সেগুলো হাওয়া; ডেমু ট্রেন কেনা হচ্ছে, কিছুদিন পরই তার কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হচ্ছে; সিসিটিভি কেনা হচ্ছে কিন্তু প্রয়োজনের সময় তা নষ্ট; ঋণ করে সাবমেরিনসহ সমরাস্ত্র কেনা হচ্ছে। কেনা হচ্ছে গাড়ি, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে গাড়ির মডেল পরিবর্তন করা, আরও বড় আরও দামি গাড়ি কেনার পথে প্রবল উৎসাহ। সর্বজনের অর্থ যেকোনোভাবে বরাদ্দে কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। লাগাম টানার কেউ নেই।

শিক্ষা খাতে বাণিজ্য প্রসারের কারণে এর সঙ্গে যুক্ত অনেকেই দ্রুত টাকার মালিক হচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষা খাতে শিক্ষার কী অবশিষ্ট থাকছে, সেটাই খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রশ্ন ফাঁস নিয়মিত, কোচিং আর টিউশনি-নির্ভরতার কারণে শিক্ষার্থীদের জীবন বিষময়। শিক্ষাব্যবস্থাকে পরীক্ষাব্যবস্থায় রূপান্তর করার কারণে গাইড বই, কোচিং বাণিজ্যের পথ খুলেছে। চলছে নিয়োগ-বাণিজ্য। এতে যাদের লাভ তারা খুশি। তারা এই ব্যবস্থাই টিকিয়ে রাখতে চায়। শুধু শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদেরই ভবিষ্যৎ অন্ধকার। অন্য সব মন্ত্রণালয়ের মতো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও সব অভিযোগ অস্বীকার করে নিশ্চিন্ত। চিকিৎসা খাতের অবস্থাও তা–ই।

বলাই বাহুল্য, এ সবকিছুই জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। অনেকে বলেন, সরকার ভালো উন্নয়ন করছে, সমস্যা হচ্ছে সুশাসনে। আমি এর সঙ্গে একমত নই। কেননা দুটোকে আলাদা করা যায় না।

উন্নয়নের ধরনে যদি দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, জবাবদিহিহীনতা, দখল, দূষণ থাকে অর্থাৎ যদি উন্নয়ন প্রকল্প অতি-উচ্চমাত্রায় সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষতি/বিপর্যয়ের কারণ হয়, তাহলে তা কুশাসন অবধারিত করে তোলে। নদী-নালা-খাল-বিল যারা দখল করে, যারা ব্যাংক লুট করে, যারা সম্পদ পাচার করে, তাদের দরকার হয় প্রশাসনের সমর্থন, এই সমর্থন পেলে তার অপরাধের গতি আরও বাড়ে। এর মধ্যে দুর্নীতি, অনিয়ম, সন্ত্রাস—সবই প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতা অর্জন করে। সেটাই ঘটছে অবিরাম।

প্রকল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কিংবা প্রকল্প ব্যয়ের ক্ষেত্রে যদি স্বচ্ছতা না থাকে, যদি কোনো স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের এগুলো তদারকি বা অনিয়ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা না থাকে, তাহলে তৈরি হয় যথেচ্ছাচার। যারা ঠিকাদার, তারাই যদি কর্তাব্যক্তিদের সমর্থন/অংশগ্রহণে প্রকল্প নির্ধারণ করে, তাহলে ব্যয় বরাদ্দ অনিয়ন্ত্রিত না হওয়ার কারণ নেই। যদি কমিশনপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে প্রকল্প বাছাই, তাহলে কমিশন যত বাড়ে প্রকল্প ব্যয়ও তত বাড়তে থাকে। আগে ঘুষ-কমিশনের একটা সীমা ছিল, এখন তা–ও নেই বলে জানা যায়। বাংলাদেশে প্রকল্প ব্যয় যে বিশ্বে রেকর্ড করছে, তা এই গতিতেই হয়েছে।

ব্যবসা-লবিস্ট-রাজনীতিবিদ-প্রশাসনের দুষ্ট আঁতাত আরও অনেক অপরাধ-সহিংসতাকেও ডাকে। বলপূর্বক টেন্ডার দখল, জমি-ব্যবসা দখল করতে গিয়ে খুন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় গুম, আটক-বাণিজ্য, দর-কষাকষি এগুলোও অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় চলে যায়। প্রশাসন আর দল একাকার হয়ে গেলে দ্রুত অর্থ উপার্জনের বল্গাহীন প্রতিযোগিতা চলবেই। বাড়তেই থাকবে ধর্ষণ, নারী-শিশু-সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা, ক্রসফায়ার, হেফাজতে নির্যাতন এবং সরকারি দলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর হানাহানি।

গত কিছুদিনে দেশে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, হেফাজতে খুন, গুম, ধর্ষণ ইত্যাদির তাই কোনো বিরতি নেই। সাম্প্রদায়িক হামলার সংখ্যাও বেড়েছে। ক্রসফায়ার, খুন, গুম, সাম্প্রদায়িক হামলা সম্পর্কে সরকারি ভাষ্য খুবই সরল, একঘেয়ে ও কৃত্রিম। ভাষ্যকারদের অবিরাম মিথ্যা ভাষণ এবং নির্লিপ্ত অবস্থান থেকে বোঝা যায় যে তাদের আদেশ অনুযায়ী, অসার কথাগুলোই জনগণকে বিশ্বাস করতে হবে এবং যদি কেউ না করে তাতে তাদের কিছু এসে-যায় না। এসব মিথ্যা ভাষণের পক্ষে কথা বলার মতো সুবিধাভোগী সুধীসমাজও দেশে তৈরি হয়েছে! তাতে সরকার খুবই নিশ্চিন্ত।

সরকার তাই পূর্ণ বিজয়ীর বেশে। বাংলাদেশে বিচার বিভাগসহ সব প্রতিষ্ঠান এখন সরকারের করায়ত্ত। নির্বাচনও তার হাতের মুঠোয়। তাই সর্বজনের অর্থ দিয়ে, দেশের উন্নয়নের কথা বলে, যা খুশি তা করায় তার কোনো দ্বিধা নেই, ফাঁসির আসামির দণ্ড মওকুফ করে নেতার ট্যান্ডল হিসেবে কাজ করতে দিতে কোনো সংকোচ নেই, বিচারব্যবস্থা চুরমার করতে কোনো দুশ্চিন্তা নেই, সুন্দরবন বিনাশে বা রূপপুর মহাবিপদ প্রকল্প নিয়ে তার বুকে কাঁপুনি নেই। শত শত মানুষ বিনা বিচারে খুন-গুম হয়ে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা তো নেই–ই বরং এসব নিয়ে সরকারের তরফে এমন অনেক কিছু বলা হয়, তা অনেকটাই তামাশার মতো।

সরকার যাকে বিজয় হিসেবে দেখাতে চায়, প্রতিক্ষণের যন্ত্রণা থেকে আমরা তার উল্টোটাই টের পাই।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।